মনের মধ্যে কাশ্মীরের প্রতি নির্মল প্রেম আর গভীর ভালোবাসা তখন থেকে জন্মেছে, যখন কাশ্মীরের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা জেনেছি। প্রবল ইচ্ছে ছিল, আল্লাহ তায়ালা তওফিক দিলে জীবনে একবার হলেও কাশ্মীর সফরে বেরোব। আমার মনের আশা পূর্ণ হলো গত কয়েক দিন আগে। নাজিম ভাই বললেন, তারা সাতজন মিলে যাচ্ছেন কাশ্মীর। ব্যস, আমিও তাদের সঙ্গে জুড়ে গেলাম। দেওবন্দ স্টেশন থেকে শালিমার এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম সেদিন রাতে। বহু কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণ হচ্ছিল বলে মনের ভেতর রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছিল বারবার। রাতে ডিনার সেরে ট্রেনে শুয়ে পড়লাম। খুব ভোরে মোশতাক ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। ট্রেন তখন জম্মু স্টেশনে দাঁড়িয়ে। আড়মোড়া ভেঙে তড়িঘড়ি করে ছাড়লাম ট্রেনের সিট। একটা মাইক্রো ভাড়া করে রওনা হলাম পর্যটনকেন্দ্র ‘পতিœটপে’র পথে। মিনিট বিশেক পর শহুরে জনপথ ছেড়ে পাহাড়ে চড়া শুরু হলো আমাদের। সারা রাতের নির্ঘুম ক্লান্তি বারবার জড়ো হচ্ছিল দুচোখে। তবুও মহান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি পাহাড় দেখে দেখে এগোচ্ছিলাম। শীতকালীন পাহাড়গুলো গাঢ় সবুজ না হলেও নাম না-জানা ছোট ছোট গাছগুলো হালকা সবুজ আবরণে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল পাহাড়গুলোকে। পাহাড়ি বাঁক ঘুরে ঘুরে যখন আমরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত পতিœটপে পৌঁছলাম, তখন বেলা আড়াইটা। পতিœটপের সৌন্দর্য অপূর্ব। চারদিকে সবুজের সমারোহ। নিচে বিছানো সবুজের গালিচা। বরফ গলে ঘাসের গা ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানির ধারা। মনোরম এ জায়গাটিতে বসার জন্যে রয়েছে কয়েকটি বেঞ্চি। দূরে দেখা যাচ্ছিল বরফে আবৃত্ত যোজন-যোজন পাহাড়। সেগুলো পেছনে নিয়ে ছবি তুলে নিলাম। পর্যটক শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা ও আনন্দে মেতে রইলাম কতক্ষণ। সূর্যটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে ক্রমশ। সন্ধ্যার আগে পৌঁছতে হবে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। দেরি না করে গাড়িতে চড়ে বসলাম সবাই। প্রায় দু’ঘণ্টা পর পৌঁছলাম বাতুট নামক জায়গার একটি মাদরাসায়। আজকের রাত্রিযাপন এখানেই হবে। মাদরাসায় খুব আপ্যায়ন করা হলো আমাদের। আপ্যায়নে কাশ্মীরিরা প্রসিদ্ধ। এবার নিজেই তার সাক্ষ্য হলাম। রাতে খানা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে মুয়াজ্জিনের সমধুর কণ্ঠে ঘুম ভাঙল। কিচিরমিচির সুরে ডাকছে হাজারো পাহাড়ি পাখি। বিছানা ছেড়ে গরম পানি দিয়ে ওজু করলাম। নামাজের পর চা-নাশতা সেরে ফের রওনা হলাম আমরা। আবারো সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। একটু পরপর দেখা মিলে পাহাড়ের গা বেয়ে পড়া ছোট ঝরনার। তার ঠাণ্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে আবার রওনা হই। কখনো রাস্তার পাশে টং দোকানে বসে নাশতা করে নেই। একটু পরপর আসে বিশাল বিশাল গুহা। পাহাড় কেটে বিস্ময়করভাবে তৈরি করা হয়েছে এগুলো। একেকটা গুহা ১৫-২০ মিনিটের আগে শেষ হয় না। কখনো দেখা যায় রাস্তার পাশে টিলার ওপর দেখলাম রাইফেল হাতে পজিশন নিয়ে বসে আছে ইন্ডিয়ান আর্মি। গাড়িতে করে টহল দিচ্ছে কেউ। শত্র“বাহিনীর হামলা থেকে জনগণকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে এ ব্যবস্থা। কাশ্মীর যুদ্ধকবলিত এলাকা। কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ পর্যন্ত বড় বড় তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৪৭, ১৯৬৫ ও ১৯৯৯ সালে। এখনো খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয় হঠাৎ হঠাৎ। ভয়ে ভয়ে এগোতে থাকলাম সামনে। এরপর থেকে পুরো সফরেই জায়গায় জায়গায় আর্মিদের এমন তৎপরতা নজরে পড়েছে। ঘণ্টা চারেক পর পৌঁছলাম বানিহাল রেলস্টেশন। টিকিট নিয়ে চড়ে বসলাম ট্রেনে। সিট পেতে বসলাম এক জায়গায়। লক্ষ করলাম, এখানের স্টেশনগুলো অন্য জায়গার থেকে একটু আলাদা। এতটা ভিড়াভিড়ি নেই, কোলাহল নেই। সব কেমন চুপচাপ। স্টেশনগুলোও উন্নত আর ঝকঝকে পরিষ্কার।
গ্রীষ্মকালীন কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে যখন ট্রেন এসে থামল তখন মধ্যদুপুর। আকাশে গনগনে রোদ। তবুও বেশ ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছিল গায়ে। ট্রেন থামতেই সবাই একরকম দৌড়ে বের হচ্ছিল স্টেশন থেকে। বেশ অবাক হলাম। নতুন জায়গায় বুঝে উঠতে পারছিলাম না তাদের দৌড়ানোর কারণ। পরে জানতে পারলাম, নিরাপত্তার খাতিরে কাউকে স্টেশনে দাঁড়াতে দেয়া হয় না। রাস্তার পাশে সারি সারি ফাস্টফুডের দোকান। মুখরোচক খাবার দেখে ক্ষুধার্ত পেট আরো যেনো চোঁ চোঁ করে উঠল। বসে খেয়ে নিলাম ভেড়ার গোশত দিয়ে তৈরি কাশ্মীরের বিশেষ খাবার ‘চিশতা’। স্থানীয় ছেলে এজাজ ভাই আমাদের স্টেশন থেকে রিসিভ করার কথা। কিন্তু তার দেখা নেই। তিনি আমাদের সঙ্গে দেওবন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। সেখান থেকেই পরিচয় আমাদের। খুব ভালো মানুষ। তাকে না পেয়ে ফোন দিলাম। রিসিভ করে বললেন, একটা ট্যাক্সি নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যেতে। তার কথামতো ট্যাক্সি নিয়ে এগোলাম সামনে। ঝিলাম নদীর তীরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। ঝিলাম নদীর আশপাশটা ঘুরিয়ে দেখালেন আমাদের। নদীর ওপর মাঝারি আকৃতির একটা ঝুলন্ত সেতু। তাতে চড়ে দেখে নিলাম দূরে বয়ে চলা নদীর শেষ মোহনা। দিগন্তে গিয়ে মিশেছে যেন। ব্রিজ পার হয়ে এজাজ ভাই একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলেন। এবার আমাদের গন্তব্য শ্রীনগরের অপরূপ সৌন্দর্যের জলাভূমি ডাল লেক। মিনিট বিশেক পর আমাদের গাড়ি লেকের পাড় ধরে চলতে লাগল। লেকের মুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত লেকটি হ্রদের মতো। লেকের শান্ত জলে বয়ে চলছে সারি সারি বিশেষ একধরনের সজ্জিত ছোট নৌকো। নৌকোগুলো দেখতে বেশ চমৎকার। যেনো সাজানো বাসর ঘর। বিভিন্ন বলিউড সিনেমায় দেখা যায় এগুলো। এজাজ ভাই বললেন, এগুলোর স্থানীয় নাম ‘সিকারা’। এমন নৌকোয় চড়ার ইচ্ছে ছিল বহুদিন ধরে। একটা ঘাটে ড্রাইভারবাবু গাড়ি থামালেন। হুড়মুড় করে নেমে ছুটে গেলাম ঘাটে। সারি সারি বাঁধা রয়েছে কয়েকটা সিকারা। পানির মাঝখানে পানির ফোয়ারা। সেটি পেছনে রেখে ফটো তুললাম। মোশতাক ভাই মাঝির সঙ্গে দাম দরাদরি করলেন। ঠিক হলো, এক ঘণ্টা ঘুরিয়ে জনপ্রতি ১০০ রুপি করে। দুটো সিকারা ভাড়া করে করে চড়ে বসলাম। লেকের ঠাণ্ডা জলে হাত ঢুবিয়ে লেকের সঙ্গে মিতালি করতে করতে এগোতে থাকলাম সামনে। মাঝি জানালেন, এই লেকে দুটি দ্বীপও আছে। একটির নাম সোনা লাঙ্ক আর অপরটি রূপা লাঙ্ক। শীতকালে লেক এলাকার তাপমাত্রা মাইনাস ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এর পানি তখন জমে বরফে পরিণত হয়। লেকের জলে একটু পরপর ভাসতে দেখা যায় ঘরের আকৃতির বড় বোট। যেন আলিশান ফ্লাট। মাঝি চাচাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এগুলো হাউসবোট; অর্থাৎ ভাসমান বাড়ি। ডাল লেকে এমন সাত শতাধিক বেশি হাউসবোট আছে। এর ভেতরে অত্যাধুনিক হোটেলের মতো নানান ব্যবস্থা আছে। শোয়ার ঘর, বসার ঘর, বাথরুম কোনোটাই বাদ নেই। সবকিছুই সুসজ্জিত। বাইরে আছে বারান্দা, যেখানে বসে অনায়াসে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে চাঁদের সঙ্গে পানির অপূর্ব মিতালির দৃশ্য উপভোগ করা যায় মনভরে। যার মধ্যে এত আয়োজন তার ভাড়াটাও বেশি। জনপ্রতি ৫০০ থেকে সাত হাজার পর্যন্ত ভাড়া। তাই তাতে রুমে বুক করার চিন্তাও এল না মাথায়। লেকের নির্মল জলে ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু পানকৌড়ি, সাদা বক ও মাছরাঙা। লেকের অপরূপ সৌন্দর্য ওরা যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। লেকের মধ্যে রয়েছে ভাসমান বাজার। শাকসবজি থেকে নিয়ে ফলমূল ও চা-নাশতাও মিলে স্বল্প দামে। এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করে এখানের মানুষ। এক ঘণ্টা লেকের অপূর্ব সৌন্দর্য অবলোকন করে ফের চড়ে বসলাম গাড়িতে। একটা চেকপোস্ট পেরিয়ে পৌঁছলাম চশমেশাহি গেটে। ২০ রুপির টিকিট নিয়ে কয়েক ধাপ পাহাড়ি সিঁড়ি চড়লাম। চারদিক নাম না-জানা রঙিন ফুলের সমারোহ। ছোট ছোট সবুজ গাছগুলো বাগানটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আরো সামনে এগোতেই দেখলাম স্বচ্ছ পানির নালা। এর উৎস খুঁজতে এগোতে থাকলাম সামনে। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি মসজিদের গম্বুজের মতো একটা ছোট ঘর থেকে বেরোচ্ছে এ পানি। পাহাড়ি ঝরনাকে কৃত্রিম আকারে বানানো হয়েছে। এর নামই চশমেশাহি। একে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বাগানটি। মোঘল সম্রাট শাহজাহান তার বড় পুত্র দারাশিকোকে উপহার দেওয়ার জন্য ১৬৩২ সালে এই সুদৃশ্য বাগানটি তৈরি করেন। এই ঝরনার পানি নাকি ভারতের সবচেয়ে স্বাদু পানি। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই পানি পান করতেন। তথ্যগুলো জানালেন এজাজ ভাই। চশমেশাহি দেখে ফের চড়লাম গাড়িতে। ডাল লেকের কূল ধরে এগোতে থাকলাম সামনে। লেকের মোহনীয় রূপ দেখে মন ভরছিল না যেন। যতই দেখছি মনের পিপাসা যেন ততই বাড়ছে। আধঘণ্টার মাথায় পৌঁছলাম হজরত বাল মসজিদের সামনে। মসজিদ প্রাঙ্গণে খাবার টুকে টুকে খাচ্ছে কয়েক শ কবুতর। এক লোক খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছে। মসজিদের গম্বুজ হুবহু তাজমহলের গম্বুজের মতো বিশাল। সাদা মর্মর পাথরে নির্মিত হয়েছে দেয়াল ও প্রাঙ্গণ। যেন শুভ্র একটি জান্নাতি ঘর। এ মসজিদে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর কয়েকটি চুল মোবারক সংরক্ষিত আছে। প্রতি নামাজের পর মুসল্লিদের তা দেখানো হয়। আমাদের ভাগ্য খারাপ, জোহরের নামাজ কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছে। তাই আর দেখা হলো না হুজুর (সা.) এর বরকতি চুল। মসজিদটি ডাল লেকের পাড়েই অবস্থিত। লেকের তীরে দাঁড়িয়ে মসজিদ পেছনে নিয়ে ছবি তুলে নিলাম কয়েকটা। একটা হোটেলে খাবার খেয়ে রওনা হলাম জামে মসজিদ দেখতে। ঝিলাম নদীর পার ধরে চলতে শুরু করল আমাদের মাইক্রো। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছলাম জামে মসজিদের গেটে। একতলা বিশিষ্ট এশিয়ার সর্ববৃহৎ জামে মসজিদটি দেখতে অনেকটা রাশিয়ার সেইন্ট পিটারসবার্গের মতো। বাইরে থেকে এর নির্মাণশৈলী দেখে ভেতরে প্রবেশ করার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। প্রধান গেটের সামনেও রাইফেল নিয়ে বসে আছে কয়েকজন সেনাবাহিনী। এ মসজিদ নিয়েও ক্ষণে ক্ষণে চলে সংঘর্ষ। এ জন্য অধিকাংশ সময় বন্ধ করে দেয়া হয় মসজিদটি। এজাজ ভাই বললেন, দীর্ঘ ১২ সপ্তাহ পর নাকি গত জুমা আদায় হয়েছে মসজিদে। আমাদের ভাগ্য ভালো যে সেদিন মসজিদ খোলা ছিল। সংরক্ষিত জায়গায় জুতা রেখে প্রবেশ করলাম ভেতরে। মসজিদের ভেতরের আশ্চর্য নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম বারবার। ১৩৯৪ সালে সুলতান শিকান্দার শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের ভেতর রয়েছে ৩৭৮টি সম্পূর্ণ গাছের পিলার, যার মধ্যে ২১ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পিলার ৩৪৬টি ও ৪৮ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট পিলার রয়েছে ৩২টি। কথায় কথায় তথ্যগুলো জানালেন এজাজ ভাই। প্রাচীন আমলে এত বিশাল পিলারগুলো কীভাবে দাঁড় করিয়ে ফিট করা হয়েছে, সেটাই বিস্ময়ের। মসজিদের অভ্যন্তর বিশাল হলরুমের মতো চারপাশে তৈরি হয়েছে। নিচে বিছানো হয়েছে নরম গালিচা। মাঝখানটায় খোলা আকাশের নিচে খালি প্রান্তর। সেখানে রয়েছে ওজু করার স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা, নানা রঙের ফুলের বাগান ও সবুজ প্রান্তর। পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে মিশে যাচ্ছিলাম যেন প্রকৃতির মাঝে। আমাদের তখনো জোহরের নামাজ পড়া হয়নি। ওজু করে নামাজ আদায় করে নিলাম তাড়াতাড়ি। এখান থেকে এজাজ ভাই বিদায় নিলেন। এতটুকু জায়গা আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করলাম বারবার। কোনো সমস্যায় পড়লে বা পরামর্শ লাগলে তাকে ফোন করার অনুরোধ করলেন। এতক্ষণ যে গাড়িতে ছিলাম সেটা নিয়েই রওনা হলাম ভূস্বর্গ কাশ্মীরের অপূর্ব লীলাভূমি গুলমার্গ দেখতে। সমতল ভূমি থেকে একসময় চলা শুরু হলো পাহাড়ে। মেঘের কাছাকাছি হচ্ছি বলে শীত বাড়ছিলো হু হু করে। গরম কাপড় সঙ্গে যা ছিল পরে নিলাম। জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম সবুজ পেইন গাছের অপূর্ব দৃশ্য। লম্বা লম্বা গাছগুলোর পাতায় পাতায় জমে আছে সাদা বরফ। ছবিতে বহুবার দেখছি এমন সুন্দর দৃশ্য। তখন মনের দরজায় ভিড় করত হাজারো স্বপ্ন। ইচ্ছে হতো, ওই বরফগুলোর মতো আমিও যদি পেইন গাছের শাখে শাখে ঘুরে বেড়াতাম! এখন দেখছি অতি কাছ থেকে। আমার জন্যে এর থেকে রোমাঞ্চ আর কিছু হতে পারে না! পরস্পর গল্প আর হাসি-ঠাট্টা করতে করতে একসময় পৌঁছলাম গুলমার্গে। বরফে ঢাকা শুভ্র গুলমার্গ আহ কত সুন্দর! একেবারে ছবির মতো। সন্ধ্যাকালীন আলোয় বরফগুলো নীলচে হয়ে একটা মায়াবী রূপ ধারণ করে রেখেছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল আমিও মিশে যাই নীলচে ওই বরফে! কিন্তু মোশতাক ভাই বললেন, ‘যত আনন্দ করার কাল করা যাবে। আজ বিশ্রাম করুন।’ চারপাশে বরফে আবৃত একটা হোটেলে রুম বুক করা হলো। রাতে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। সারা দিনের ক্লান্তিতে অল্পতেই ঘুম এসে জড়ো হলো চোখে। খুব ভোরে ঘুম ভাঙল একটানা টাপুরটুপুর শব্দে। শিশিরজল গড়াচ্ছে বরফের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আশা ছিল তুষারপাত দেখব। কিন্তু আজ তুষার পড়েনি একটুও। জানালা খুলে বাইরে তাকালাম। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় শুভ্র পরিবেশটা আরো মোহনীয় হয়ে ধরা দিলো দুচোখে। ওজু করে নামাজ পড়লাম। সকাল ১০টার দিকে নাশতা সেরে বেরোলাম হোটেল থেকে। এজাজ ভাই বলে দিয়েছিলেন, বরফে যাওয়ার আগে বুট জোতা ভাড়া করে নিতে। না হয় সমস্যায় পড়তে হবে। পা পিছলে আহত হওয়ারও আশঙ্কা আছে। একটা দোকান থেকে বুট ভাড়া করে নেমে পড়লাম বরফে। গুলমার্গের এই পর্যটন এলাকাকে ঘিরে এখানের মানুষের চলে রমরমা ব্যবসা। কেউ ভাড়া দেয় বরফচালিত কাঠের বিশেষ ধরনের গাড়ি, কেউ স্কাটিং করার যন্ত্রপাতি। তাদের এগুলো ভাড়া নেয়ার জন্য আমাদের ঘিরে ধরল। বরফে স্কাটিং করার ইচ্ছে ছোটবেলা থেকেই। দরদাম করে ১০০ রুপিতে ভাড়া নিলাম স্কাটিংয়ের যন্ত্র। চালক আমাদের বুঝিয়ে দিলেন চালানোর সিস্টেম। দু-একবার করেই বুঝে ফেললাম। তারপরও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলাম একবার। চালক এসে টেনে তুললেন। নরম বরফ হওয়ায় ব্যথা পেলাম না একটুও। বেশ আনন্দ পেলাম স্কাটিং করে। ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত মেতে রইলাম এই আনন্দে। যতদূর চোখ যায় কেবল বরফ আর বরফ। দূরের পাহাড়গুলোও বরফে সাদা হয়ে আছে। দক্ষিণ দিকের কয়েকটি পাহাড়ের চূড়া মেঘের ওপরে। নিচে ভাসছে মেঘের ভেলা। ইচ্ছে হচ্ছিল, আহ, উড়ে গিয়ে যদি মিশে যেতে পারতাম ওই শুভ্রতায়! কিন্তু নির্দিষ্ট উচ্চতার পর ওপরে যাওয়া নিষেধ। সব জায়গায় আর্মিদের পাহারা রয়েছে। তাই বরফে আবৃত এ প্রান্তরটা দেখে সাধ মেটাতে হলো। মাঝেমধ্যে ছোট খালের ওপর নির্মিত হয়েছে সুন্দর সুন্দর সেতু। এসব খালে গরমকালে পানি থাকলেও এখন বরফে ঢাকা। সেতুর ওপর উঠে কাশ্মীরি পর্যটকদের সঙ্গে সেলফি তুলে নিলাম কয়েকটা। কোনো জায়গায় হাঁটু পর্যন্ত বরফ। বুট না নিয়ে আসলে সত্যিই খুব মুশকিলে পড়তে হতো। এত বরফ দেখে আনন্দে সবাই লাফালাফি করতে লাগল। গোল পাকিয়ে পরস্পর ছোড়াছুড়ি করলাম। বরফের বালিতে ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়লাম। শুয়ে বসে সেলফি তুলে নিলাম। বরফে ঘুরে ঘুরে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলাম। ঠাণ্ডায় যেন হাত-পা জমে যাওয়ার অবস্থা। এদিকে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল, জানতেই পারলাম না। বরফে হেঁটে হোটেলে ফিরে এলাম। জোহর পড়ে খানা খেয়ে ফের ছুটে চললাম শ্রীনগরের পথে। পেছনে রেখে গেলাম বরফে ঢাকা অপরূপ সৌন্দর্যের আধার প্রিয় গুলমার্গ। পরদিন সকালে আমরা রওনা হলাম পেহেলগামের উদ্দেশে। একটু পর দেখা মিলল সারি সারি আপেল বাগানের। শীতকালীন আপেল গাছগুলো পাতাহীন দাঁড়িয়ে আছে। খুব ইচ্ছে ছিল টসটসে আপেল গাছ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার। কিন্তু তা আর হলো না। ড্রাইভার বাবু বললেন, জুন-জুলাইয়ে এলে আপেল বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সে সময় কাশ্মীরের সৌন্দর্যও হয় দেখার মতো। সময় হলে গরমকালেও আরেকবার কাশ্মীর সফরের নিয়ত করে ফেললাম মনে মনে। তিন ঘণ্টার মাথায় পৌঁছলাম পেহেলগাম। আমাদের গাড়ি গিয়ে থামলো পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা বিশাল ঝরনার কাছে। পানি ছুয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে শীত শীত অনুভূত হচ্ছিল। ঝরনার নালায় ছোট-বড় পাথর পড়ে আছে। এগুলো ঝরনার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পেহেলগামের সৌন্দর্য দেখতে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত বাইসারান ও কাশ্মীর ভেলিতে। কিন্তু ঘোড়ার মালিক দাম চাইছে জনপ্রতি এক হাজার রুপি করে। এত দাম শুনে হেঁটেই যাওয়ার চিন্তা করতে লাগলাম। শেষমেশ জনপ্রতি ২৮০ রুপিতে রাজি হল। বীরের মতো ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। জীবনের প্রথম ঘোড়ায় চড়ে বেশ রেমাঞ্চ অনুভূত হলো মনে। খাড়া পাহাড় বেয়ে ঘোড়া আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করল ওপরে। আল্লাহ তায়ালা এ প্রাণীটিকে কী পরিমাণ শক্তি দিয়েছেন তা বুঝতে পারলাম এর ওপর চড়ে। নিচে বিশাল খাদ। পা একটু ফসকে গেলেই বিপদ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহিহ সালামতে পৌঁছে দিলেন বাইসারান। মিনি সুইজারল্যান্ড নামে ডাকা হয় জায়গাটিকে। ২০ রুপির টিকিট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। আহ, কী রুপ, কী সৌন্দর্য। পৃথিবীর সব নন্দনরূপ যেনো চোখে এসে ধরা দিল একসঙ্গে। চারপাশে পেইন গাছের বিশাল পাহাড়। মাঝখানে এক টুকরো জান্নাত। সবুজে মোড়ানো চারপাশের প্রকৃতি। সুইজারল্যান্ড যাইনি কখনো, কিন্তু কাশ্মীর এসে যেন সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। হাসি-আনন্দ আর সেলফিতে মেতে রইলাম অনেকটা সময়। ফেরার পথে ঘোড়ার সহিস দেখালেন কাশ্মীর ভেলি। এখান থেকে কাশ্মীরের প্রায় অর্ধেক সৌন্দর্য দেখা যায়। ওপর থেকে নিচের দৃশ্যগুলো দৃশ্যায়ন করে নিচে নামতে আরম্ভ করলাম। পথে কয়েকটি সুটিং স্পটও পড়ল নজরে। এবার বিদায়ের পালা। প্রায় পাঁচ দিন ধরে দেখলাম অপরূপ কাশ্মীরের মোহনীয় সব সৌন্দর্য। তারপরও যেন তৃপ্তি মেটেনি মনের। থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল বারবার। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। গাড়িতে চড়ে ছুটে চললাম আপন গন্তব্যে। যাওয়ার সময় কাশ্মীরের কানে বলে গেলাম, ‘প্রিয় কাশ্মীর! সময় পেলে আবারো ছুটে আসব তোমার কোলে!’
Comments
comments