জ্বিয়ারত

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

By mumin

July 18, 2023

মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ধর্ম নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছেন সেই ধর্ম হলো ইসলাম। আর ইসলাম শব্দটিকে যদি শাব্দিক দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করা যায় তবে তার অর্থ দাঁড়ায় শান্তি। যেমন অভিধানে ইসলাম শব্দটি আরবি (সিলমুন) মাদ্দাহ থেকে নির্গত। (সিলমুন) শব্দের অর্থ হলো শান্তি ও নিরাপত্তা। অথবা ইংরেজিতে বলা যায় ইসলাম অর্থ হচ্ছে ঞড় নব ংবপঁৎবফ তথা নিরাপত্তা লাভ করা। অতএব, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু শান্তির ধর্ম ইসলাম নিয়ে এ ধরনীতে আগমন করেছেন, সেহেতু এ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠাই ছিলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিশন। যদি আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মলগ্নের ইতিহাস তালাশ করি, তাহলে প্রতিয়মান হবে যে, তিনি ৫৭০ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন সারা বিশ্বে অরাজকতা বিরাজ করছিল, আর সেই যুগটি ছিলো আইয়ামে জাহেলিয়াত অর্থাৎ অন্ধকার যুগ, আর সেই মুর্খতা, বর্বরতা, বেহায়াপনা, নির্যাতন নিপিড়ন ও অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনীতে আগমন করেছেন। যেমন, কুরআনে পাকে ইরশাদ হচ্ছে-‘আমি মুর্খদের মাঝে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছি। যিনি তাদের সম্মুখে তার (আল্লাহর) আয়াতসমূহ পাঠ করবেন এবং তাদেরকে (জাহেলি যুগের মানুষদেরকে) পুত পবিত্র করবেন এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দান করবেন।’ (৬২-সুরা জুমুয়া : ২)আমরা জানি যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত, আর সে জাতি উন্নতীর শিখরে পৌছায় যে জাতি বা সমাজে শান্তি বিরাজ করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষক ও শান্তির দূত হিসেবে আমাদের মাঝে আগমন করেছেন।যেমন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি’।তাছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষদের আলোর পথে বের করে আনার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। যেথায় রয়েছে মানবতার শান্তি ও মুক্তির পথ।আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-‘আলিফ, লাম, রা, এমন একটি কিতাব, যা আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে (জাহেলি যুগের) মানুষদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য।’ (১৪-সুরা-ইবরাহীম: ১.)অতএব, মানুষদেরকে অশান্তি থেকে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে অবদান একমাত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের।তাছাড়া পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-‘হে নবী আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরুপ প্রেরণ করছি।’ (২১-সুরা আম্বিয়া : ১০৭)আর আরবি রাহমাতুন শব্দের এক অর্থ হলো শান্তি। সুতরাং শান্তি দিয়েই আল্লাহ তায়ালা প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সংস্থা দেখতে পাই। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে, অসহায়, গরিব ও মজলুম মানুষদের জালিমদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ‘হিলফুল ফুজুল’ বা শান্তি সংঘ নামক একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন নবীজি সাল্লøাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম। যার উদ্দেশ্য ছিল-(ক) অসহায় ও দুর্বলদের সেবা প্রদান করা।(খ) শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।(গ) বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে স¤প্রীতি গড়ে তোলা এবং বিদেশি বণিকদের ধন সম্পদের নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। আর অদ্যাবধি তারই সেই দেখানো পথ আমরা যদি অনুসরণ করি তাহলে সমাজে কখনো অশান্তির ছায়া নেমে আসতে সক্ষম হবে না।রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশব কাল থেকেই ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, শৈশব কাল থেকেই মক্কার কাফির মুশরিকরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আল আমিন’ উপাধি দিয়েছিল ছিল তার বিশ্বস্ততার জন্য। সেই আদর্শ যদি যে কেউ যেকোনো সমাজে বাস্তবায়ন করে সেই সমাজের মধ্যে স্বর্গীয় শান্তি নেমে আসবে। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে এমন কতিপয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিলো যার ফলে যুদ্ধের পরিবর্তে সন্ধি ও কলহের পরিবর্তে শান্তি নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিল। যেমন পৃথিবীর সর্ব প্রথম ঘর পবিত্র কাবা শরীফে যখন হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর নামক পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করা হয় তখন তা নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে এক মহা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কেননা পাথরটির সাথে সামাজিক মর্যাদা ও বংশগত প্রাধান্যের বিষয়টি সম্পৃক্ত ছিলো। প্রত্যেক গোত্রের লোকই চায় পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করতে। এমনকি যুদ্ধের প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। যুদ্ধ যখন একেবারে অনিবার্য হয়ে পড়লো তখন আবু উমাইয়া একটি প্রস্তাব করলেন-যে ব্যক্তি আগামিকাল সর্বপ্রথম কাবাগৃহে প্রবেশ করবেন তিনিই এ বিবাদের ফায়সালা দেবেন, আর তিনি যে সিদ্ধান্ত দিবেন সকলেই তা মেনে নেবে। এ প্রস্থাবে সকলেই রাজি হলেন। সকলেই প্রথম আগমনকারীর অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন, এমন সময় হঠাৎ সমস্বরে আনন্দ ধ্বনি উঠলো, এইতো আমাদের আল আমিন উপস্থিত। আমরা সকলেই তার সিদ্ধান্ত মেনে নেব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তাদের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শুনলেন এবং তার অসীম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এর সমাধান দিলেন। তিনি একখানা চাদর বিছিয়ে নিজে এর মধ্যস্থলে পাথরটি স্থাপন করলেন এবং উপস্থিত সকল গোত্রের প্রতিনিধিগণকে বললেন, এবার আপনারা প্রত্যেকেই এই চাদরের এক এক প্রান্ত ধরে পাথরটি যথাস্থানে নিয়ে আসুন। সকলেই তার কথা মতো কাজ করলেন। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই পুনরায় পাথরটি যথাস্থানে স্থাপন করলেন এবং থেমে গেল তাদের বিগ্রহ। এভাবেই আল্লাহ প্রদত্ত মহান বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কিছু ফায়সালা প্রদান করে মক্কা নগরীতে শান্তির বার্তা এনেছিলেন। যদি সেই পন্থা বা নিয়ম যে কেউ অনুসরণ করে তবে যেকোনো সমাজে অবশ্যই শান্তি আসবে। আমরা যদি বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের দিকে লক্ষ করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো সুষ্ঠু-শান্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সকল রাষ্ট্রেরই একটি সংবিধান রয়েছে, আর সেই সংবিধান রচনার শিক্ষা দিয়েছিলেন বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার সনদ রচনার মাধ্যমে।

বিশ্বের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান হলো ‘মদিনার সনদ’। এ সনদ রচনার একমাত্র উদ্দেশ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। স¤প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এ সনদের মাধ্যমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল অসমতা দূর করে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন। সকল মুসলমান ও অমুসলমানের ধর্মে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া উক্ত মদিনা সনদে ৫৩টি ধারা রয়েছে। সেই ধারাসমূহে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ইত্যাদি নিষেধ করা হয়েছে। যেমন একটি ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে কোন মুমিন একজন মুশরিকের জন্য একজন মুমিনকে হত্যা করবে না বা কোন মুশরিক মুমিনের বিরুদ্ধে সাহায্য করবে না। অন্য একটি ধারায় উল্লেখ আছে যে, সকল ইহুদী আমাদের অনুসারী হবে তারা আমাদের সাহায্য ও সহানুভূতি পাবে। এ সম্পর্ক ততদিন বর্তমান থাকবে যতদিন তারা মুসলমানদের কোন ক্ষতি করবে না।মদিনা সনদের এ ধারাসমুহে সকল ধর্মের বা জাতির লোকদের সমান অধিকার বা স্বাধীনতা প্রদান করা হয়েছে। যেমন অপর একটি ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে মুসলমান ও অমুসলমান সকলে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। অন্য ধারায় বলা হয়েছে ইহুদী স¤প্রদায়ের মিত্রগণও সমান স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা লাভ করবে। সুতরাং পৃথিবীর সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান মদিনা সনদের পূর্ণ অনুসরণ করে তা যদি সমাজে বাস্থবায়ন করা হয় তাহলে যেকোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে অশান্তি আসতে পারে না। সে রাষ্ট্রে বা সমাজে শান্তির ঝড় বয়ে যাবে। এমনকি বিদায় হজ্বের ভাষণে সেই ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অমর বাণী প্রদান করেছেন, সে বাণীসমূহেও ছিল সাম্যের জয়গান।এটা ছিল গরিব, ধনী, রাজা, প্রজা, মালিক, দাস ইত্যাদির মধ্য থেকে অসমতা দূর করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার সবক বাণী। এটা সমাজ থেকে সকল ভেদাভেদ দুরীভূত করে সবাইকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার মহান বাণী।ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে তিনি অর্ধ পৃথিবী একাই শাসন করেছিলেন। সে সময় সমাজে ছিল না কোন অন্যায় ছিল না কোন দুর্নীতি। সমাজে বিরাজ করছিল শুধু শান্তি। এর একমাত্র কারণ হলো তারা দেশ শাষণ করেছিলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিখানো পন্থা অবলম্বন করে। তাদের মাঝে ছিলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপমাবিহীন আদর্শ। তাই সমাজ ছিল সুখ-শান্তিতে ভরপুর।এখনো যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ সমাজে বা রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন করা যায় এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লানের শাসনকার্য অনুসরণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় তবে গোটা বিশ্ব শান্তির নীড়ে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তাই বলা যায় বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই অনুপম দৃষ্টান্ত।

লেখকঃ কে. এম শুহেদ আহমদ

Comments

comments