আউলিয়ায়ে কেরাম

স্মরণীয় দিন : ১৬ই জানুয়ারি

By lazy-coder

January 05, 2014

২০০৮ ইংরেজি সনের ১৬ই জানুয়ারি বুধবার আমার জীবনের সর্বাধিক স্মরণীয় দিন। স্মরণীয় হওয়াটা আনন্দের নয়, বিষাদের। সুখের নয়, দুঃখের। প্রাপ্তির নয়, হারানোর জন্য। সেদিন কি বা কাকে হারিযে়ছি? এ প্রশ্নের উত্তর হৃদয় দিযে় যতটুকু উপলব্ধি করছি, কলম দিযে় তার শত ভাগের এক ভাগও প্রকাশ করতে পারছি না। এটা আমার অযোগ্যতা-ব্যর্থতা। ১৬ই জানুয়ারি হারিযে়ছি তাঁকে, যাঁকে বরণ করে নিযে়ছিলাম সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে। যাঁর দর্শন ছিলো জীবনের প্রধান ব্রত। হৃদযে়র সবটুকু ভালোবাসা ছিলো যার জন্য। যাঁর মোবারক কদমের নিকট বসতে পারলে অনুভব করতাম পরমতৃপ্তি, নূরানী চেহারার দিকে তাকিযে় থাকতে পছন্দ করতাম সর্বাপেক্ষা বেশী। যাঁর চেহারা দর্শনে দূর হযে় যেতো দুঃখ-বেদনা, কষ্ট-যাতনা। যাঁকে দেখে ভুলে যেতাম দুনিয়ার কথা, দূরীভূত হতো ইবলিসী ওয়াসওয়াসা, হৃদয় হযে় যেতো স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন। যাঁর নিকট থেকে পেযে়ছি জীবনভর কিন্তু দিতে পারিনাই কিছু। রক্তে-মাংসে, দেহে-রুহে যাঁর কাছে ঋণী, যাঁকে হারিযে় আজ নিজেকে মনে করছি অসহায়-সর্বহারা। তিনি হলেন হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) কে, তাঁর পরিচয় বা কি? এর জবাব প্রদান করা অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার। কারণ তাঁর ব্যক্তিত্ব আকাশের মতো বিশাল। আকাশের দেখা অংশে যেমন অদেখা অংশের তুলনায় অতি নগন্য। তেমনি ছাহেব কিবলার ব্যক্তিত্বের জানা অংশ অজানা অংশের তুলনায়ও তুচ্ছ। তিনি ছিলেন ইলিম-আমলের উজ্জ্বল আলোক-বর্তিকা শরীয়ত ও তরীকতের এ যুগের ইমাম, ইনসাফ ও বিশ্বাস্ততার মূর্ত প্রতীক, ধৈর্য্য ও সহনশীলতার অনুকরণীয় আদর্শ, সাহসিকতার ও দানশীলতার কিংবদন্তী। তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হকের দাওয়াত, মাখলুকের সেবা এবং দ্বীনের খেদমতে ব্যয় করেন। দ্বীনি খেদমতের এমন কোন বিভাগ নেই, যেখানে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিলোনা। তিনি সর্বদা ওযু অবস্থায় থাকতেন, কথা কম বলতেন, সময়কে খুব মূলবান মনে করতেন, রুটিন মতো কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে প্রাণের চেযে়ও বেশি ভালোবাসতেন। তাইতো উঠা-বসা, চলাফেরা, আহার-নিদ্রা তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুকরণ করতেন। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা তিনি, যিনি সমগ্র জীবন লড়াই করেছেন বাতিলের বিরুদ্ধে, এক প্রকাণ্ড আতঙ্ক ছিলো ইসলাম বিদ্বেষীদের চোখে। দ্বীন-ধর্ম, দেশ-জাতি বিরোধী তৎপরতার মোকাবিলায় বার বার অপূর্ব সাহসিকতা প্রদর্শন করে সৃষ্টি করেছেন বিরল ইতিহাসের। যাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দিক নির্দেশনা এবং সাহায্য-সহযোগিতায় গডে় উঠেছে সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান স্বদেশে এবং বিদেশে, যাঁর ভক্ত-অনুরক্ত ছডি়যে়-ছিটিযে় আছেন বিশ্বের আনাচে-কানাচে। যাঁর হাত ধরে সঠিক পথের দিশা পেযে়ছেন লক্ষ-কোটি জনতা। তিনি যেমন ছিলেন সাধারণ মানুষের আদর্শ, তেমনি ছিলেন আলিম সমাজেরও অনুকরণীয়। তিনি জাগতিক ও পারত্রিক বিদ্যায় অর্জন করেন অগাধ পাণ্ডিত্য। তাঁর বক্তব্য হতো সাগরকে কলসের ভেতর ঢুকিযে় দেয়ার মতো। অগ্নি দেখে যেমন পঙ্গপাল জমা হয়, তেমনি ছাহেব কিবলাকে দেখে লোকজন জডে়া হতো। তাঁর মোবারক চেহারায় ছিলো যাদুকরী আকর্ষণ, কথায় ছিলো দারুণ মাধুর্যতা, বক্ষে ছিলো সীমাহীন মায়া-মমতা। জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা-স্মরণশক্তি, আমল-আখলাক, বোধ-বিশ্বাস, তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল ইত্যাদি বিষযে় তিনি এমন উচ্চাসনে আসীন ছিলেন, তা শব্দ ও বাক্যের আয়ত্বের বাইরে। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলার ব্যক্তিত্ব যেমন ছিলো অতুলনীয় তেমনি তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিলো অবর্ণনীয়। এর জ্বলন্ত প্রমাণ ও প্রকৃষ্ট উদাহরণ তাঁর নামাযে জানাযা। জানাযায় যোগদানের উদ্দেশ্যে বার্ধক্য-অসুস্থতা, দাযি়ত্বের দায়বদ্ধতা, কর্মময় শত ব্যস্ততা এবং আর্থিক অসঙ্গতি এসব উপেক্ষা করে শত শত কিলোমিটার পাডি় দিযে় লোকজন উপস্থিত হোন ফুলতলীতে। সেদিনের জন সমুদ্র চোখে না দেখলে অনুভব করা কষ্টকর। বিশাল বড় বালাই হাওর সহ আশপাশের কযে়ক কিলোমিটার পর্যন্ত ছিলো তীব্র জনজট। যার দরুণ ফুলতলীর নিকটবর্তী হযে় প্রায় লাখ মানুষ অংশ গ্রহণ করতে পারেননি তাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বের নামাযে জানাযায়। জানাযার নামাযে অংশগ্রহণকারী লোকজনের পরিমাণ সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টের মধ্যে ছিলো কযে়ক লক্ষ ব্যবধান। এতে সহজেই অনুমান হয় যে, সে জানাযা ছিলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জানাযা। ছাহেব কিবলার ইন্তেকাল আমাদেরকে শোকাহত ও অস্থির করেছে বটে। তবে তাঁর নীতি, আদর্শ আমাদেরকে সব সময় অনুপ্রাণিত করবে-উৎসাহ যোগাবে। তাঁর আদর্শ প্রতিফলিত হোক আমাদের জীবনে, এই মুনাজাতই দয়ামযে়র সকাশে।

Comments

comments