আউলিয়ায়ে কেরাম

নালায়ে কলন্দর : পূত হৃদয়ের নান্দনিক ছন্দবদ্ধ অভিব্যক্তি

By mumin

January 11, 2022

মাহবুবুর রহীম

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) রচিত উর্দুভাষার কাব্যগ্রন্থ ‘নালায়ে কলন্দর’। ‘কলন্দর’ হচ্ছে কাব্য রচয়িতার কলমি বা ছদ্মনাম। বাংলাভাষার গীতিকবিতার ভেতর কবির নাম বা ছদ্মনাম ব্যবহৃত হওয়া সাধারণত প্রচলিত আছে। ‘নালায়ে কলন্দর’ এর অর্থ হচ্ছে-কলন্দরের রোদন। অর্থাৎ গ্রন্থের নামেই স্বচ্ছ কাঁচের মতো দৃশ্যমান হয়েছে কবিসত্তার হৃদয়ের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ অশ্র“সিক্ত কলমের কালি ও শব্দাবলীর বুননে উর্দু ভাষায় পাঠকের হাতে এসেছে ‘নালায়ে কলন্দর’ হয়ে। গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠে যে ভাবোদয় হবে তা একজন উর্দুভাষী পাঠক সঠিকভাবে বর্ণনা করতে হয়তো বেশিই সক্ষম। কিন্তু কবিতাগুলো গীতল ছন্দময় শিল্পসমৃদ্ধ হওয়ায় স্বতন্ত্র গুণসত্তার অধিকারী হয়েছে। কেবল সুললিত আবৃত্তি করলেই কবিতার সুর, লয়, তাল ও ছন্দের মোহনীয়তা নির্বিঘেœ চিত্ত ছুঁয়ে যায়। তখন উর্দু ভাষায় সামান্য হলেও দখল থাকা শ্রোতার কাছে কবির ভাব-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি, কামনা-বাসনা, আশা-হতাশা ও ভিন্ন ধাঁচের দুঃখ-বেদনার চিত্রটি ফুটে উঠে। এছাড়া কবিতাগুলো মধুময় কারুকার্যে সুরারোপ করে কণ্ঠশিল্পীর কন্ঠে তুলে দিয়ে যখন পরিবেশন করানো হয় তখন শ্র“তামণ্ডলিকে আধ্যাত্মিক এক জগতে নিয়ে যায়।কবিতা কি? অনেক তর্কবিতর্ক আর মতভেদের মধ্যে কবিতার পরিচয় ভাস্বর হয়ে আছে আপন মহিমায়। কারো কারো মতে- ‘কবিতার শৃঙ্খলিত কোনো সংজ্ঞা নেই। একজন কবি তাঁর শব্দগুলোকে আলোকিত করে ছড়িয়ে দেন মাটি ও মানুষে, জলে ও জীবনে, প্রেমে ও প্রজ্ঞায়, সত্য ও সাধনায়, মহা শূন্যে ও মহাকালে।’ কবিতা কী কোনো উপকার বা অপকার করতে সক্ষম তা নিয়েও আছে অনেক কথা, যুক্তি ও তর্ক। তবে এটা নিশ্চিত যে, কবিতাও পাপ-পঙ্কিলতা কিংবা পূন্যের ধারক-বাহক হয়ে থাকে। কোনো কোনো কবিতা কবিকে এবং এর পাঠককে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। অপরদিকে কোনো কোনো কবিতা ধ্বংসের কবল থেকে কবি ও তার পাঠককে টেনে তুলতে ক্ষমতা রাখে। কবিতার আলোচনা পবিত্র কুরআনুল কারিম ও হাদীস শরীফে এসেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশ্লীল কবিতা রচনার নিন্দা এবং শালীন কবিতা রচনার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন। কখনো-বা কিছু কবিতার প্রসংশা করতঃ পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

‘নালায়ে কলন্দর’ গ্রন্থে ২৮টি কবিতা রয়েছে। হামদ, নাত ও শানে আউলিয়ামূলক কবিতাগুলোর গঠনশৈলী গীতল ছন্দ মাধুর্যে পরিপুষ্ট। যাতে প্রস্ফুটিত হয়েছে কবির পূত হৃদয়ের বিশাল নান্দনিক অভিব্যক্তির ক্ষুদ্র অংশবিশেষ। ব্যক্তিজীবনে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) অগণিত গুণের অধিকারী। প্রতিটি গুণ পরস্পরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ‘নালায়ে কলন্দর’ গ্রন্থে তাঁর কাব্যপ্রতিভার গুণটি সর্বাগ্রে ধর্তব্য। গ্রন্থটি তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার সামান্য স্ফুরণ মাত্র। আপন প্রতিপালকের কুদরতি পদতলে লুটে পড়ে নিজ সত্ত্বাকে সমর্পিত করার অন্যতম প্রতীক বলা যায়। তিনি খোদা প্রেমে আকণ্ঠমগ্ন এবং রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেম তাঁর নিকট সমস্ত কিছুর উর্ধ্বে, সেই শাশ্বত বিষয়টির ভিন্নরকম প্রামাণিক দলিল ‘নালায়ে কলন্দর’ গ্রন্থ।গ্রন্থের প্রথম কবিতা হচ্ছে উঁচু মার্গীয় একটি হামদে বারী তায়ালা। প্রথম পংক্তিতে লেখা হয়েছে- ‘হামদে কেছে কর ছেকোঁ-য়ে কাম হায় আবরার-কা/হায় নামায়িশ খলকে আলম মখযনে আছরার-কা।’ বাংলা ভাষায় কাব্যানুবাদ হচ্ছে- ‘কী অনুপম রহস্যময় সৃষ্টির ভান্ডার/নই নেককার পাই কোথা পাই ভাষা সে প্রশংসার।’ সর্বশেষ পংক্তি হচ্ছে- ‘আহমদে মুখতার তুজকো হাশরেমে গর দেকলে/লাজ উনকো হায় কে তো হোঁ কাবিলে পিটকার-কা।’ অনুবাদ হলো- ‘কলন্দর দিও না লজ্জা নবীজিকে হয়ে পথিক ভ্রান্ত পথের/হয়ো না হয়ো না রোজ হাশরে পাত্র ধিককারের।’ পংক্তি দু’টিতে স্রষ্টার অপরূপ সৃষ্টি দেখে বিমোহিত কবি খোদার প্রশংসা করার উপযুক্ত ও যথেষ্ট ভাষা খোঁজে না পাওয়ার আর্তি প্রকাশ করেছেন। এছাড়া সিরাতাল মুস্তাকিমের পথ থেকে সটকে পড়ে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর হাবীবকে যেন লজ্জায় না ফেলেন সেজন্য কবি সত্ত্বা আপন নফস-কে সতর্ক করে দিচ্ছে। পংক্তি দুটো তখন আর কবির একক আকুতি থেকে যায়নি, বরং প্রতিজন মুমিন পাঠকের একান্ত আর্তি হয়ে যায় সেটা। আর তা পাঠ করার সাথে সাথে সমস্তকিছুর স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর বিস্ময়কর কুদরতের কথা, ক্ষমতা ও অসীম গুণাবলীর কথা অবচেতন ভাবনার অতল থেকে স্মরণে উতলে উঠে। পাঠকের পাপপুণ্য, আমালিয়াত ভেসে উঠে চোখের পর্দায়। জাহান্নামের ভয়, জান্নাতের আশা সম্পর্কে অবলীলায় সচেতন হয়ে যান পাঠক। আর এখানেই সুন্নতে নববীর পাবন্দ একজন আশিকে রাসুল কবির প্রকৃত সার্থকতা।

(সংক্ষেপিত)

Comments

comments