নারীর অধিকার

নারী-পুরুষের মর্যাদা ও অধিকার : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

By lazy-coder

July 05, 2013

ভূমিকা : নারী-পুরুষ মিলেই পরিবার। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র থেকেই এ বিশাল পৃথিবী। একটি পরিবার আবাদ করতে উভয়েরই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রয়েছে। আর তাই উভয়েরই নির্দিষ্ট অধিকার ও মর্যাদা থাকা উচিত। কিন্তু যুগে যুগে দেশে দেশে বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন আইনে দেখা গেছে নারী-পুরুষের অধিকার ও মর্যাদায় চরম ভারসাম্যহীনতা। জাহেলী যুগে নারীরা পশুপাখির সমান মূল্যটুকুও পেত না। কোন কোন নারীকে বলা হয়েছে, ‘দোযখের দরজা’, ‘অপরিহার্য শয়তান’ ইত্যাদি। নারী ছিল ভোগ্যপণ্যের মত। পিতার মৃত্যুতে উত্তরাধিকার সম্পত্তির মতো মাতাদেরকেও সন্তানেরা ভাগ করে নিত এবং বিমাতাদের বিয়ে করত। মাত্র কয়েক শতাব্দি আগেও আমরা দেখেছি স্বামীর সাথে স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারত। এখনও ইসলাম ব্যতিত অন্য কোন ধর্মে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর কোন হিসসা নেই। হিন্দু ধর্মে নেই একতিলও। এরূপ চরম অন্যায় ও অমানবিক অবস্থা থেকে ইসলাম নারীকে উদ্ধার করে নারী-পুরুষের অধিকার ও মর্যাদার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করছে। মানুষ কখনও শিশু, কখনও যুবক, স্বামী-স্ত্রী; আবার কখনও বৃদ্ধ পিতামাতা। বিভিন্ন অবস্থার চাহিদা অনুসারে অধিকার ও মর্যাদায় ভিন্নতা রয়েছে। যেমন-

শিশুর অধিকার : আজও দেখা যায়, কোন কোন পরিবারে কন্যাশিশুর জন্ম একটি দুঃসংবাদ। কন্যাশিশুও যেন পরিবারে বোঝা। জন্মই তার আজন্ম পাপ। আর জাহেলি যুগে শুধু দুঃসংবাদ নয়, কন্যাশিশুকে রীতিমত জীবন্ত সমাহিত করা হতো। সে যুগের বীভৎস চিত্র সুস্পষ্ট হয় হাদিসের অনেক বর্ণনায়। যেমন- মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এক ব্যক্তি বললেন, ‘আমার একটি মেয়ে ছিল। সে আমার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। আমি যখনই তাকে আহ্বান করতাম, সে আনন্দচিত্তে দৌড়ে আসত। এভাবে আমি তাকে ডাকলে সে আমার পেছনে দৌড়ে এল। আমি তাকে সাথে করে নিকটবর্তী একটি কূপের পাশে গেলাম এবং ধাক্কা দিয়ে কূপের মধ্যে ফেলে দিলাম। তখনও সে আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করছিল।’-সুনানে দারেমি এরকম অবস্থা থেকে কন্যাশিশুকে মুক্তিদানের জন্য পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষণা এল, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের শিশুদের হত্যা করো না।’ (৬:১৫১ ও ১৭:৩১) ইসলামে শিশুর সুন্দর অর্থবহ নাম রাখা, আকিকা করা, সুশিক্ষাদান ও ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করা এবং উপযুক্তভাবে বিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তানকে লালন-পালন করল, তাদেরকে শিষ্টাচার ও সদাচরণ শিক্ষা দিল, বিয়ে দিল এবং তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করল, সে বেহেশত লাভ করবে। – আবু দাউদ অন্য হাদিসে দু’কন্যার কথাও আছে। অবশ্য সংখ্যাটা মূখ্য নয়। এরপরও এ সভ্য পৃথিবীতে যখন দেখা যায়, নর্দমায় ভেসে যায় সদ্য প্রসূত অবৈধ অনাকাক্সিক্ষত শিশু, তখন কী মনে হয়! শিক্ষার অধিকার : কুরআনের প্রথম অবতারিত শব্দটি হলো ‘পড়ো’। শিক্ষার ব্যাপারে ইসলাম নারী পুরুষ সবাইকে উৎসাহিত করেছে। মালেক ইবনে হুয়াইরিস বলেন, আমরা কয়েকজন যুবক দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করলাম। যে সময় তিনি উপলব্ধি করলেন, আমরা বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি, তখন বললেন, তোমরা নিজ নিজ পরিবারে গিয়ে অবস্থান করো। তাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান দাও এবং তা মেনে চলতে নির্দেশ দাও। – বুখারী ‘আল মাদখাল’ গ্রন্থে আল্লামা ইবনুল হাজ্জ অষ্টম শতাব্দীতে লিখেছেন, নারী যদি স্বামীর কাছে তার দ্বীনী অধিকার তথা দ্বীন শিক্ষার দাবি করে, তাহলে স্বামী নিজে সরাসরি সে দাবি পূরণ করবে অথবা এ উদ্দেশ্যে তাকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করবে। অন্যথায়, বিচারক স্বামীকে বাধ্য করবে। বিয়ের অধিকার : ইসলাম বাল্য বিবাহকে উৎসাহিত করেনি, বরং উপযুক্ত না হলে চরিত্র পবিত্র রাখার উপায় হিসেবে রোজা রাখার মাধ্যমে সংযম সাধনার নির্দেশ দিয়েছে। পরিণত ছেলে মেয়েকে পাত্রপাত্রী গ্রহণের ব্যাপারে ব্যক্তিগত বিবেচনার গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। এমনকি নাবালেগকে বিয়ে দিলে কিংবা বালেগ তার সম্মতি ব্যতিরেকে জোরপূর্বক বিয়ে দিলে সে বিয়ে প্রত্যাখানের অনুমতিও রয়েছে ইসলামে। বিয়ের মোহর নির্ধারণ ও আদায়, পাত্রপাত্রী পছন্দকরণ, বিবাহ বিচ্ছেদ নীতিমালা ইসলামে সুনির্দিষ্ট। এসব সুযোগ অন্যান্য ধর্মে নেই বললেই চলে।

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও মর্যাদা : দাম্পত্য জীবন আবেগঘন, মধুময়। হৃদয়-উৎসারিত ভালবাসা ছাড়া শুধু আইনগত ব্যবস্থা দিয়ে এ জীবন সুখী হয় না, হতে পারে না। স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টি নিচের আয়াতটি লক্ষ্য করলে সহজেই বোধগম্য হয়ে ওঠে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা তোমাদের পোষাক; আর তোমরা তাদের পোষাক।’ আয়াতটি প্রতিকী। এর তাৎপর্য ব্যাপক। পোষাক শরীরে মিশে থাকে। পোষাক শোভা। পোষাক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে। পোষাকে রয়েছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। সবগুলো ব্যাপারেই উভয়ের মধ্যে তুলনীয়। সৃষ্টিগত ভাবে নারীরা সাধারণত শিশুর মতো বেশি আবেগপ্রবণ। তাই স্বামীদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে বলেছেন, নারী বাঁকা হাড়ের মতো। তাকে পুরো সোজা করতে চাইলে ভেঙে ফেলবে। তবে বাঁকা অবস্থায় রেখেই তুমি চাইলে তার থেকে উপকৃত হতে পার। অন্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কাপুরুষ স্ত্রীর ওপর বিজয়ী হয়। আর সুপুরুষ হয় পরাজিত। অপরদিকে স্বামীর অনুগত থাকার জন্য স্ত্রীকে অত্যন্ত তাগিদ দিয়েছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এক কথায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে বুঝিয়েছেন, ‘যদি আমি কোন মানুষকে সেজদা দেয়ার নির্দেশ দিতাম, তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম স্বামীকে সেজদা করতে।’ আল্লাহ কর্মক্লান্ত স্বামীর জন্য শান্তির আশ্রয় হিসেবে স্ত্রীকে মায়াময় ও আকর্ষণীয় করে সৃষ্টি করেছেন। হাদীসে এসেছে, ঐ স্ত্রী উত্তম যাকে দেখলে স্বামীর চক্ষু শীতল হয়। আবার বলা হয়েছে, ঐ স্বামী ভালো, যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো।

উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর প্রাপ্য অংশ ও আর্থ সামাজিক মর্যাদা : একমাত্র ইসলামই নারীকে পূর্ণ আর্থ সামাজিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। বিভিন্ন সূত্রে নারীর জন্য বিনা পরিশ্রমে আর্থিক মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। কন্যা অবস্থায় তার ভরণ পোষণ করবে পিতা, স্ত্রী অবস্থায় করবে স্বামী। অথচ ইসলামের পক্ষ থেকে পরিবারের কোন ধরণের খরচের জন্য স্ত্রী বাধ্য নয়। তদুপরি, বিয়ের সময় ইসলাম স্ত্রীকে দিয়েছে মোহরের নিশ্চয়তা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, ‘পিতার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে দুই কন্যার সমান পাবে এক পুত্র।’ যেহেতু খরচের দায়িত্ব পিতা এবং স্বামীর এবং কন্যা ও স্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেই, হয়তো সেজন্যই হিসেবটি ২:১ এবং এটিই সঙ্গত। এছাড়াও স্বামী, ভাই সহ আরও কয়েকটি উৎস থেকে নারী উত্তরাধিকার সম্পত্তি পায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইসলাম ন্যায্য হিসসা হিসেবে নারীকে যা দিয়েছে, তা ঠিকমত কার্যকর করা হচ্ছে না; উপরন্তু কিছু মানুষ আল্লাহর দেয়া বণ্টনের সঠিক মূল্যায়ন না করে নারীকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে বিতর্ক করছে। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে পর্দা রক্ষা করে সহনীয় ও মাননসই যে কোন বৈধ পেশা গ্রহণে ইসলাম নারীকে বাঁধা দেয়নি। অবশ্য উৎসাহিতও করেনি। ইমাম আবু হানিফা (র.) এর মতে, প্রয়োজনে নারীর জন্য বিচারকের পদে কাজ করারও অনুমতি রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রিয়তম স্ত্রী হযরত আয়েশা (রা.) যুদ্ধও পরিচালনা করেছেন, দ্বীন শিক্ষা দিয়েছেন। তাতে তার পর্দা, চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের স্খলন ঘটেনি।

নারী-পুরুষ, কে শ্রেষ্ঠ, কে অধীন, না কি উভয়ই সমান : স্বাভাবিকভাবেই যার দায়িত্ব বেশি, তার কর্তৃত্বও বেশি। আল্লাহ পুরুষকে দায়িত্ব বেশি দিয়েছেন। সেই সাথে তাকে কর্তৃত্বও দিয়েছেন বেশি। স্ত্রী-পুরুষ দু’জন পরস্পর উত্তম বন্ধু বটে; কিন্তু দায়িত্ব পালনসূত্রেই স্বামী, স্ত্রীর অভিভাবক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, পুরুষগণ স্ত্রীদের ওপর কর্তৃত্বশীল। আল্লাহ পুরুষদের থেকে নবী-রাসূল নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু নারীগণ তো সেই সব মহামানবদের মাতা হয়েছেন। সৃষ্টিগতভাবে নারীর কিছু দুর্বলতা ও কোমলতা আছে; পুরুষের আছে বাড়তি ঝুঁকি বহনের শক্তি ও মেজাজ। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে স্বাভাবিক ও সামগ্রিকভাবে পুরুষ শ্রেষ্ঠ, নারী অধীন এবং উভয়ে সব বিষয়ে সমান হওয়া সম্ভব নয়। তবে কোন কোন নারী কোন কোন বিষয়ে অনেক পুরুষের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হতে পারেন। সেটা অবশ্য স্বতন্ত্র ব্যাপার। হযরত মরিয়ম (আ.) এর ব্যাপারে আল্লাহ নিজেই বলেন, এ নারীর সমান পুরুষ নেই। অবস্থা বিশেষে কিংবা ব্যক্তিবিশেষে নারী, পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার অধিকারীও হতে পারেন।

পিতামাতার অধিকার : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, পিতামাতাই তোমার বেহেশত; পিতামাতাই তোমার দোযখ। তিনি আরও বলেন, পিতামাতার খুশিই আল্লাহর খুশি। পিতামাতার দুঃখই আল্লাহর দুঃখ। যখন পিতামাতা বৃদ্ধ-অসহায় অবস্থায় উপনীত হন, তখন যেন তাদের ‘উহ্’ শব্দটিও বলতে না হয়, এমন আচরণ করার জন্যই আল্লাহ নির্দেশ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তুমি এবং তোমার সম্পদ তোমার পিতার জন্য উৎসর্গিত। পিতামাতা অমুসলিম হলেও তাদের সেবা ও সম্মান করতে বলা হয়েছে। তবে হারাম নির্দেশ পালন করা যাবে না। হাদীসে এসেছে, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। মাতার যতœ বেশি; না কি পিতার? এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতার মর্যাদা তিনগুণ আর পিতার একগুণ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ, সন্তানের জন্য মাতা এমন তিনটি কাজ বেশি করেন, যা পিতার পক্ষে সম্ভব নয়। এ কারণে মর্যাদাও সমান নয়।

সমাপিকা : ইসলাম নারী-পুরুষের সমতা-ভিন্নতার মূল্যায়ন করে যেসব অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করেছে, তার বাস্তবায়ন সম্ভব হলে এ ধূলির ধরণী বেহেশতের মত মনে হতো। মূলত ইসলাম একটি বৈধ সীমার ভেতরে জীবনের রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদ সবই ভোগ-উপভোগের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু ইসলামের এই সীমানা পেরিয়ে যখন মানুষ ইচ্ছেমত চলতে যায়, তখনই শয়তানের গোলক ধাঁধায় আটকে পড়ে জীবন নারকীয়, বিষময় হয়ে ওঠে। আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সঠিকরূপে ইসলাম পালন ও উভয় জীবনের শান্তি অর্জনের তাওফিক দাও। আমীন।

Comments

comments