আন্তর্জাতিক

কারবালা থেকে কাশ্মীর

By mumin

September 08, 2019

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কালজয়ী কবিতা ‘মহররম’-এর এক অংশে বলেন: ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা/ ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা,/ উষ্ণীষ কোরআনের হাতে তেগ আরবীর/ দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শীর। তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা/ শমশের হাতে নাও বাধ শিরে আমামা/ বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নাকিবের তুর্য/ হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য। জাগো ওঠো মুসলিম/ হাঁকো হায়দারী হাঁক/ শহীদের দিলে সব/ লালে লাল হয়ে যাক। মহরম মাস বিশ্বের বুকে প্রতি বছরই আসে। কোরআন ও হাদিস শরীফের আলোকে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এ মাসে মু’মিনদের অন্তরাত্তাকে যে ঘটনাটি সবচেয়ে আপ্লুত করে সেটা হলো কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা। এ দিনটি অনেক আবেগ ও আহলে বাইতের প্রতি অকৃত্রিম মহব্বত প্রকাশের মাধ্যমে পালিত হয়। ১০ই মহরম একটি নির্মম ইতিহাস। সাইয়্যিদুল মুরসালিন, নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নয়নমনি -নবী নন্দিনী ফাতেমাতুজ যাহরা রা. এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী বিন আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর কলিজার টুকরা হোসাইন রা. এর মর্মান্তিক শাহাদতের ঘটনার কারণে এদিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হক ও বাতিলের চিরন্তন লড়াইয়ে সত্যপন্থীগণ যে কখনই বাতিলের নিকট মাথানত করেন না, কারবালার ঘটনা তারই বাস্তব নমুনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রা. যুবক বয়সে জীবনের সব রঙ্গীন স্বপ্ন, যশ ও খ্যাতি উপেক্ষা করে সত্যের পথে শাহাদাতের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে প্রমাণ করেছেন সত্য ও সাম্যের পথে ইসলাম আপোসহীন। কারবালার ঘটনা ছিল খুবই মর্মান্তিক; জালিম ইয়াজিদের জুলুমের বিরুদ্ধে গুটিকয়েক বনি আদম ও পরিবার পরিজন নিয়ে নবীদৌহিত্র কারবালার মাঠে নির্মমভাবে শাহাদতের পেয়ালা পান করেছিলেন। সেদিন একের পর এক জালিমের আঘাতে কারবালার মাঠ নবী পরিবারের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছিল; বুকে প্রচন্ড পানির পিপাসায় শিশুপুত্র আজগর যখন ইমাম হোসাইন রা.-এর বুক তপড়াচ্ছিলেন, স্নেহময় পিতার পক্ষে এ দৃশ্য বরদাশত করার মত যোগ্যতা আর মনোবল অর্জন করা একমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্রের পক্ষেই সম্ভব ছিল। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবের এই অকুতোভয় বীর সন্তান সহ তাঁর পরিবার পরিজনের কুরবানীকে এতোটাই কবুল করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ভালোবাসা মু’মীনদেরকে অন্তরে ইজ্জতের সাথে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। যুগে যুগে বিশ্বের বুকে বহু শোকাবহ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কারবালার শোকাবহ ঘটনার মতো এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা অন্য কোথাও ঘটেছে কিনা ইতিহাসের কোথাও খোঁজে পাওয়া যাবেনা। ইহা এমন একটি ঘটনা যা আজো বিশ্ব মুসলিমকে কাঁদায়। মুমিন মুসলমানরা ভালবেসে যেমন কাঁদে; ঠিক তেমনি সত্যের পথে আপোসহীন সৈনিকেরা উৎসাহ ও প্রেরণা নিয়ে জালিমদের মোকাবিলায় অনবরত লড়ে যায়। আজ বিশ্বের বুকে প্রতিনিয়ত ইয়াজিদি তাণ্ডব চলছে; মানব সভ্যতা ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। বিশ্ব মোড়লরা নিরব নির্বাক! আর নিরব হবেইনা কেন? তারা যে ইয়াজিদের উত্তরসূরি!! একবিংশ শতাব্দীর ইয়াজিদ প্রেতাতœা নরেন্দ্র মোদী আজ জম্মু ও কাশ্মীরে কারবালার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। এই জম্মু ও কাশ্মীরের ইসলামী ইতিহাস ঐতিহ্য হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি!

১৩৩৯ সালে প্রথম মুসলিম শাসক শাহ মীরের হাত ধরে কাশ্মীরে ইসলামের আলো বিস্তার হতে থাকে। এ সময় অন্যান্য ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেলেও তাদের অর্জনসমূহ হারিয়ে না গিয়ে বরং মুসলিম অনুশাসনের সঙ্গে মিশে কাশ্মীরি সুফীবাদের জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ৫০০ বছর মুসলিমরা কাশ্মীর শাসন করে। কাশ্মীরে মুসলমানদের শাসনামল ছিল শান্তি সম্প্রীতি ও সৌহার্দপুর্ণ। কিন্তু ১৮১৯ সালের শেষাংশে ফেরাউনের উত্তরসূরি রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে মুসলমানদের উপর জুলুম ও নির্যাতন চালায়। সেই জুলুমের রেশ শেষ হতে না হতেই ১৮৪৬ সালে কাশ্মীরে শাসনভার চলে যায় তৎকালীন জালিম ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা আবারো কাশ্মীরকে একটি চুক্তির মাধ্যমে শিখ সন্ত্রাসী গোলাব সিংহের কাছে ৭৫ লাখ রুপি এবং সামান্য বার্ষিক চাঁদার বিনিময়ে হস্তান্তর করে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গোলাপ সিংহের বংশধরেরাই কাশ্মীর শাসন করেছে। ১৯৪৭ এর পর থেকে বিভিন্ন সময় কাশ্মীর নিয়ে জালিম শাসকরা পলিটিক্যাল গেইম খেলে চলছিল। হাজারো কাশ্মীরী মুসলমানদের রক্তের বিনিময়ে শেষমেশ ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজিত হয়। ওই ধারা অনুসারে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। একই সঙ্গে কাশ্মীরে নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের কোনো ভূমিকা থাকবে না। স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরী মুসলমানরা তাও মেনে নেয়নি; তাই তারা বিভিন্ন সময় লড়াই চালিয়ে যায়; জালিম সরকারের হাত থেকে মুক্তি পেতে এই পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ কাশ্মীরি মুসলমান শাহাদাত লাভ করেছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার পরিসংখ্যানে দেখা যায় শুধু ১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত লক্ষাধিক স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরকে স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি বাতিল করে দেশটির সন্ত্রাসী, হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার যে তাণ্ডব চালাচ্ছে; দেখে মনে হচ্ছে সেটা কারবালার ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসেছে জম্মু-কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয়দের মারধর ও নির্যাতনের স্টিমরোল চালাচ্ছে। স্থানীয়রা বলছে তাদের রড ও লাঠি দিয়ে পেটানো এবং ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হচ্ছে। মুসলমান যুবকদের তুলে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। হাজারের ও অধিক মুসলিম যুবতি নারীকে অপহরণ করে হত্যা ও ধর্ষন করা হচ্ছে। অপহৃত নারীদের হিন্দু ধর্মগ্রহণ করতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বৃদ্ধ ও শিশুদেরকে অবাধে হত্যা করা হচ্ছে। মানবতা চরম ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আজ সময় এসেছে হোসাইনি চেতনা নিয়ে মজলুম কাশ্মীরিদের পাশে দাড়াবার। প্রতিবছর আশুরা আমাদের জন্য বেদনার বার্তা নিয়ে এলেও সেই বেদনায় সুপ্ত থাকে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি। কবির ভাষায়- ‘কতলে হোসাইন আসলে সে মরগে ইয়াজীদ হায়, ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালা কে বাদ’। ইমাম হোসাইন রা. শহীদ হওয়ার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে ইয়াজীদের মৃত্যুই নিহিত রয়েছে। কেননা প্রতিটি কারবালার পরই ইসলাম জিন্দা হয়েছে। ঠিক তেমনি হোসাইনি চেতনার সৈনিকদের শাহাদতের মাধ্যমে ইয়াজিদী প্রেতাতœাদের পরাজয় অনিবার্য ইনশাআল্লাহ।

Comments

comments