পর্দা মূলত ফার্সী শব্দ, তবে উর্দু এবং বাংলা ভাষায় শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক। পর্দার আরবি হলো হিজাব, পবিত্র কোরআনুল ক্বারিমে একাধিক আয়াতে কারিমায় হিজাব সম্পর্কে খুবই গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হিজাব এর আভিধানিক অর্থ হলো প্রতিহত করা, ফিরিয়ে আনা, আড়াল করা, আবৃত্ত করা, আচ্ছাদিত করা ইত্যাদি। ইসলামী শরীআতে পর্দা বা হিজাব সেই বিধিব্যবস্থাকে বলা হয় যার মাধ্যমে নিজ ঘর থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণহীন কথাবার্তা, দর্শন, দৃষ্টি বিনিময়, সৌন্দর্য প্রদর্শন ও লাগামহীন আচরণ থেকে বিরত থাকা যায়। পর্দা ইসলামের একটি মহা গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক অবদান, যা শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে নয়, বরং বিশ্ব মানবের জাতীয় সত্ত্বার রক্ষকও বটে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোরআন শরীফে পর্দা করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন: মুমিনদেরকে (পুরুষ) বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে, আল্লাহ তা অবহিত আছেন। আর মুমিনা নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান-তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষদেশে দিয়ে রাখে (সুরা নুর:৩০:৩১)। হাদিস শরীফে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন “স্ত্রীজাতির পর্দায় গুপ্ত থাকার সত্তা। কিন্তু যখনই তারা পর্দার বাহিরে আসে, তখন শয়তান তাদের দিকে ঝুঁকে।” (তিরমিযী) অবরোধ প্রথা বা নারীকে চার দেয়ালের ভিতরে গৃহবন্দি করে রাখাকে আমরা অনেকেই পর্দা বা হিজাব মনে করি। প্রকৃতপক্ষে পর্দা প্রথা নারীকে শৃঙ্খলিত করার পরিবর্তে তাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে, সমাজে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। ইসলাম শান্তি ও সার্বজনীন ধর্ম, ইসলামে নারীর হিজাব বা পর্দার বিধান এবং পুরুষের দৃষ্টি অবনত রাখার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল- সমাজ জীবনে কোনো ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধের স্থলন যেন না ঘটে। হিজাব বা পর্দার বিধান নিঃসন্দেহে নারীর নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। এটি নারীর ব্যক্তি জীবনে, সমাজ ও রাষ্ট্রে স্বমহিমায় অবস্থান ও অগ্রগতির জন্য উপযুক্ত বিধান। নারী-পুরুষের মাঝে রয়েছে সৃজনিক ও প্রাকৃতিক ভিন্নতা। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে অনন্য। একজন নারী তার কর্মগুণে হতে পারেন পুরুষের চেয়েও অনেক বেশি মর্যাদাবান। ইসলাম নারীকে অশিক্ষিত, অবরোধবাসিনী হতে বলেনি। হিজাব বা পর্দার বিধান পালন করে নারী নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষাঙ্গনে, শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে। তবে প্রাকৃতিকভাবে নারীর মাঝে রূপ-সৌন্দর্যের যে বিশেষত্ব রয়েছে, তা সে প্রদর্শন করবে না। এতে সে বখাটের কুদৃষ্টির রোষে পতিত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকতে পারে। পর্দার আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক উপকারিতা: ইসলামে মুসলমান নর ও নারীকে পর্দার যে বিধান দিয়েছে, সে সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে আমরা এর বেশ কিছু উপকারিতা উপলব্ধি করতে পারি:
- চারিত্রের পবিত্রতা, অনাবিলতা ও নিষ্কলঙ্কতা রক্ষার মাধ্যমে নর-নারীর নৈতিক চরিত্রের রক্ষা হয়।
- নর-নারীর অবাধ ও অবৈধ মেলামেশার পথ রুদ্ধ হয়।
- পারিবারিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত ও সুদৃঢ় হয়।
- মুসলমান নর-নারীরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের প্রতি উৎসাহিত হয় ।
- নারীর নারীত্ব, সতীর সতীত্ব, সম্ভ্রম ও মর্যাদা মানবরূপী শয়তানের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা হয়।
- পর্দা মুসলিম নারীকে কাফের ও ক্রীতদাসী নারী থেকে আলাদা করে সম্ভ্রান্ত- নারীরূপে চিহ্নিত করে।
- পর্দার মাধ্যমে, নর-নারী আল্লাহর গজব ও জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা পায়।
- পর্দার কারণে স্কিন ক্যান্সার, চামড়া পোড়া, একজীমা, শুষ্কতা , খসখসে চামড়া, মসৃণতা নষ্ট হওয়া থেকে একজন মানুষের দেহ রক্ষা পায়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সূর্যের আলো ৯০ % স্কিন ক্যান্সারের জন্য দায়ী। টঝ ঘঅঞওঙঘঅখ ওঘঝঞওঞটঞঊ ঙঋ ঐঊঅখঞঐ এর মতে সূর্যের টখঞজঅঠওঙখঊঞ জঅণ বা অতি বেগুনী রশ্মি স্কিন ক্যান্সারের মূল কারণ। টখঞজঅঠওঙখঊঞ জঅণ বা অতিবেগুনী রশ্মি চামড়ার ভিতরে ঢুকে সংযোজক কলা (পড়হহবপঃরাব ঃরংংঁব) কে ভেঙ্গে ফেলে এবং চামড়া মাঝ বরাবর বসে যায় (ংধম) ও ভাঁজ তৈরি করে। ফলত আমাদের শরীরে মেলানিন (মানুষের চামড়ার সাদা-কালো রঙের জন্য দায়ী) নামক যে পদার্থটি আছে তা বেশি করে তৈরি হয়ে চামড়ায় একটি স্পট তৈরি করে যাকে ঞঅঘ (তামাটে বর্ণ) বলে । পর্দাহীনতার অপকারিতা:
- পর্দাহীনতা একজন মুসলমানকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবাধ্য করে।
- পর্দাহীনতা একটি মহাপাপ, আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার একটি বড় কারণ এবং নৈতিকতা ধ্বংসকারী চিরশত্রু ইবলীসের আদর্শ।
- পর্দাহীনতা জাহান্নামীদের বৈশিষ্ট্য, অমর্যাদা, কলংক, নগ্নতা, অসভ্যতা, অশ্লীলতা, পশ্চাদপদতা, অবক্ষয় ও অপবিত্রতা।
- পর্দাহীনতার ফলে সমাজে নৈতিক অধঃপতন, পারিবারিক অশান্তি, ধর্ষণ, অপহরণ, ব্যভিচার প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।
- পর্দাহীন নারীকে তথাকথিত আধুনিক সমাজ পণ্যদ্রব্যের কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পায় ।
- পর্দাহীনতার কারণে তালাকের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ স্বামী স্ত্রী একে অপরকে অবিশ্বাস এবং অবহেলা করে থাকে। আধুনিক হিজাব বা পর্দা! বর্তমান সময়ে পর্দা বা হিজাবের নামে ষ্টাইলিস যে সব টাইটফিট বোরকা বা কাপড় পরা হয় তা কি আদৌ পর্দা বা হিজাবের সংজ্ঞায় পড়ে? আল্লাহ বলেন: ‘তারা যেন তাদের সৌন্দর্যকে প্রদর্শন না করে (২৪:৩১)। এ কারণে পর্দা বা হিজাবের জন্য যে বোরকা বা কাপড় পরা হবে, তা হতে হবে ঢিলেঢালা এবং পুরো শরীর (ঞড়ঢ় ঃড় নড়ঃঃড়স) আবৃতকারী। কিন্তু বর্তমান সময়ে হিজাবের নামে চলছে এক প্রহসন। কেউ এমন সংকুচিত ও টাইটফিট বোরকা পরছে, যা দিয়ে তার শরীর প্রদর্শিত হচ্ছে, শরীরের ংবহংরঃরাব স্থানগুলো প্রস্ফুটিত হচ্ছে, সৌন্দর্য আড়ালের পরিবর্তে প্রকাশ পাচ্ছে নগ্নতা। ইউরোপ আমেরিকায় অনেকে টি শার্টের সঙ্গে স্কিন টাইট চিপা জিন্স প্যান্ট পরে, মাথা ও গলায় একখণ্ড কাপড় পেঁচিয়ে রাখছে যা দিয়ে শুধু চুল ও গলা ঢাকা যায়। মুসলমান মেয়েরা এটিকে হিজাব ভাবছে ও নিজেকে হিজাবি বা পর্দানশিল বলছে। শুধু চুল ও মুখাবয়বকে ঢাকা পর্দা বা হিজাবের একটি অংশ মাত্র। পর্দা বা হিজাবের পূর্ণতা আসে তখন, যখন পুরো শরীর, পরিধেয় বস্ত্র দিয়ে ঢেকে সৌন্দর্যকে আড়াল করা হয়। যা হাজার বছর ধরে আমাদের মুসলমান নারীরা বোরকা পরার মাধ্যমে পালন করে আসছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে একশ্রেণীর মুসলিম মেয়েরা হিজাবে প্রকৃত মূল্যবোধ বিকৃত করছে, সৌন্দর্য আড়ালের পরিবর্তে তা প্রদর্শন করছে, প্রকৃত হিজাবের সংখ্যার চেয়ে প্রহসনের হিজাবের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জাহেলি যুগের প্রতি সমাজ ধাবিত হচ্ছে। আল্লাহতায়ালা বলেন: ‘সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না; যেমনি প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হতো। (৩৩:৩৩)। সমাজের সচেতন মুসলমানরা যদি এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন তাহলে হয়তো অচিরেই আল্লাহর গজব আমাদের ধবংস করতে পারে। পরিশেষে বলতে চাই পুরুষের জন্য যেমন পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম ঠিক তেমনি নারীর জন্যও পালন করা অপরিহার্য। পুরুষের যেমন নারীদের সঙ্গে অবাধ দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ নয়; ঠিক তেমনি নারীদের জন্য পুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ নয়। সুতরাং নারী ও পুরুষের জন্য পর্দা পালন করা সমভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ তাআলা মুসলমান জাতিকে পর্দা পালনে কুরআন ও হাদিসের ওপর আমল করে পরকালীন জীবনের সফলতা লাভের তাওফিক দান করুন।
Comments
comments