আন্তর্জাতিক

অবরুদ্ধ কাশ্মীর : আজাদি কতদূর!

By mumin

September 08, 2019

রাত এগারটা ছাড়িয়ে। কম্পিউটারে ইন্টারনেটের সাহায্যে কাশ্মীরের তথ্য উপাত্ত তালাশ করছি। বাসার সবাই আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার পাঁচ বছর বয়সী শিশু পুত্র ‘তাহসিন’ ঘুমাতে যাবে না। সাফ কথা তুমি যতক্ষণ থাকবা ততক্ষণ আমি আলিফ বা লিখবো। অনেক বুঝিয়েও ঘুমাতে পাঠাতে পারলাম না। লিখে দিলাম কয়েকটা অক্ষর। বললাম যাও লিখ। খাটের উপর বসে লিখছে আর জোরে জোরে সুর করে পড়ছে ‘ফা, ফা’র উপর এক নুকতা ফা। গভীর রাতে এভাবে জোর আওয়াজে পড়ছে আর লিখছে। আমার যথেষ্ঠ ব্যঘাত হচ্ছিল। এর উপর হঠাৎ প্রশ্ন করে বলে বাবা ওটা কি? ওদেরকে মারে কেন? উত্তরে বললাম- মুসলমানদেরকে মারে। গভীর নিঃশব্দ রাতে একটা অবুঝ শিশুকে কথাটা বলতে লজ্জিত হলাম। লজ্জায় কণ্ঠ ধরে আসলো। এর উপর তার আবার পাল্টা প্রশ্ন- কেন, মুসলমানরা তো কারো ক্ষতি করে না, তাদেরকে মারে কেন? এবার আরো ভড়কে গেলাম। একটি অবুঝ শিশুর পবিত্র ও সরল অন্তরের এরূপ ধারালো প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেখেছেন? তাকে সন্তুষ্ট করা বড় কঠিন। তাৎক্ষণিক বলে উঠলাম, ওরা মুসলমানদের শত্রু, তাই মুসলমানদেরকে মারে। সাথে সাথে সে বলে উঠলো আমাদেরকেও মারবে? বললাম- না, আমাদেরকে মারতে পারবে না। সে আবার বলে উঠে- আমাদের এদিকে আসতে পারবে না। বললাম না। কথাগুলো বলছি আর ঘেমে যাচ্ছি। কিন্তু শিশু আবার আওয়াজ দিয়ে লেখা ও পড়া শুরু করলো- ফা, ফা’র উপর এক নুকতা ফা। কিন্তু থেকে গেল আমার লেখা। কঠিন অপমান ও লজ্জা চেপে বসলো সারা শরীরে। ঠিক যেমন চাদর শরীরকে আবৃত করে নেয়, তেমনি যেন অপমানে সারা শরীর ছম ছম করে উঠে। একটি অবুঝ বাচ্চা এই জ্ঞান নিয়ে বড় হচ্চে যে, আমরা মুসলমান আর মুসলমানদেরকে সবাই মারে। এই শিশু যদি আরেকটু বড় হতো! যদি সৌদী রাজ পরিবার ও নরেন্দ্র মোদীকে চিনতো, তাহলে তো আবার পাল্টা প্রশ্ন করতো যে, বাবা ওরা মুসলমানদের শত্রু হলে মুসলমানরা ওদেরকে মালা পরিয়ে দেয় কেন? এর উত্তর কি কিছু ছিল, যা দিয়ে শিশুর পবিত্র মনে সান্ত¦না দেয়া যায়? হয়তো নিশ্চয়ই আগামী প্রজন্ম শিখবে যে, মুসলমানদেরকে যারা নির্বিচারে নির্যাতন করবে, তাদেরকে আমন্ত্রণ করে এনে মালা পরিয়ে দেয়া মুসলিম রাজা বাদশাদের কর্তব্য। মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের মুসলিমদের উপর নির্যাতনের বহু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কোন মুসলিম দেশ তাদের রক্ষা করেনি। বৌদ্ধদের জুলুমের হাত থাবা দিয়ে ভেঙে দেয়া তো দূরের কথা বাধা দিতেও পারেনি। ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু কত সংখ্যক রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয়েছে নির্যাতন- ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। সেটা দেখতে গিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তখন কিছু মাথা মোটা ছাত্র আমার আমাকে ক্লাশে বলেছিল ‘হুজুর ভারতের প্রধান মন্ত্রী মায়ানমার গেছেন। হয়তো একটা সুরাহা হবে। মানে নির্যাতন বন্ধ হয়ে যাবে।’ আমি তৎক্ষণাৎ বলেছিলাম যে, ‘বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গেছে। অংসান সুচি থেকে জিজ্ঞেস করবে যে, তুমি কিভাবে মুসলমানদের নিধনে সফলতা অর্জন করেছে? আমি কিভাবে শুরু করতে পারি? জাস্ট এইটুকু। আজ প্রমাণ হলো যে, মায়ানমারের নির্যাতনের অসংখ্য ভিডিও নেটে আছে। এটা যেন না থাকে সেজন্য মোদি আগেই মোবাইল ইন্টারনেট সহ সকল কিছু বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। তার পরে সেখানে সৈন্য পাঠিয়েছে প্রথমে দশ হাজার। ধাপে ধাপে সৈন্য মোতায়েন হল দশ লাখ। কী অবাক কা-! যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভারতের রাস্তায় প্রকাশ্যে পুলিশ মুসলমান দেখলেই কুকুরের মত পেটাচ্ছে। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আসামে এমন দৃশ্য ছিল অহরহ। সেখানে এতগুলো সৈন্য কী করছে সেখানে? ২০১১ সালের জরিপে কাশ্মীরের জনসংখ্যা ১২৫৪৮৯২৬ জন। এর ষাটভাগ মুসলিম। তাতে মুসলমান ধরুন ৭৫ লাখের কিছু বেশি। সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে এই কয়টা মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালানো হলো ৩/৪ সপ্তাহ পর্যন্ত। তাহলে সেখানে কী ঘটেছে তা শুধু অনুমান করা যায়। আর কিছুই নয়। অথচ কাশ্মীরের গভর্নর সত্যপাল মালিক বিবৃতি দিয়েছেন যে, “আমাদের একটা বড় সাফল্য যে, বেসামরিক কেউ মারা যায়নি। অনেকেউ অভিযোগ করেছেন আমরা হতাহতের সংখ্যা গোপন করেছি। কিন্তু এটা সত্য নয়। আমরা সব তথ্য গণমাধ্যমকে জানাচ্ছি।” বাহ! কী নিখুঁত সত্য কথা। ১৪৪ ধারা জারি করে যা খুশি তা করে বলছে বেসামরিক কেউ মারা যায়নি। তাহলে ওখানে কি যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধ কাকে বলে? কাশ্মীরের জনগণ কি যুদ্ধ করতে আসছিল? না হয় বেসামরিক লোক মারা যায়নি বলার মানে কী? কী ঘটছে তা দুনিয়ার কাউকে তো দেখার সুযোগই ছিন্ন করে দেয়া হলো! এমনকি তাদের বিরোধী দলীয় নেতাদেরকেও সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। কোন মুসলিম বা সাংবাদিক তো দূরে থাক, গত ৯ আগস্ট রাহুল গান্ধী সহ বিরোধী দলীয় নেতাদেরকে কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। প্রিয় পাঠক, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে যারা রাষ্ট্রীয় পোষাক পরিধান করে মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্য, নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ করে হত্যা করে- তাদেরকে বলা হয় নিরাপত্তাবাহিনী। সেটা হোক মায়ানমারের বৌদ্ধ সেনা, ভারতের হিন্দু পুলিশ সৈন্য, ইসরাইলী বাহিনী এমনকি মুসলিম অধ্যুষিত সিরিয়া সহ অন্য কোন রাষ্ট্রে। তারা নিরাপত্তা বাহিনী বলে খ্যাত। আর যারা নিজ ভূখ-ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, বাঁচার লড়াই করে তাদেরকে বলা হয় সন্ত্রাসী, জঙ্গী। যারা তাদের সাহায্য করতে ব তারা সন্ত্রাসীদের মদদ দাতা। কী চমৎকার এ যুগের পরিভাষা!

আর ৫৫ টি মুসলিম দেশের ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ঙওঈ) এর নাম আমরা জানি। কিন্তু অমুসলিমদের থাবা থেকে মুসলিম দেশের একটা কুকুরকেও কখনো রক্ষা করেছে বলে জানা নেই। এ জন্য পাকিস্তানের সাবেক সিনেট চেয়ারম্যান ‘মিয়া রাজা রাব্বানি’ বলেছেন (ঙওঈ) থেকে পাকিস্তানকে বেরিয়ে আসার এখনি উপযুক্ত সময়। এটা জাতি সংঘের চেয়েও খারাপ। পাকিস্তান সহ যে কোন মুসলিম দেশ- অঞ্চলের কঠিন পরিস্থিতিতে সঠিক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ এ সংস্থাটি।’ যেখানেই যখন মুসলিমদের উপর গণহত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়, আমরা মাথা মোটা মুসলিম বিচারের আশা করি জাতিসংঘের কাছে। তাদেরকে আহ্বান করি দেখার জন্য। সময় ও অর্থ খরচ করে তাদের কাছে রিপোর্ট দেই। জাতিসংঘের বৈঠকে যোগদান করি। আশা করি এবার তারা জুলুমকারী দেশকে চাপ দিবে। জুলুম থামিয়ে দিবে। উদাহরণটা এমন যে, দারোগা বাবু রাতে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে কোন বাড়িতে ডাকাতি ও খুন করে মালামাল লুট করে আসলো। দিনের আলোতে ভুক্তভোগীরা ঐ থানায় ঐ দারোগা বাবুর কাছে ডাকাতির বিবরণ দিয়ে মামলা দায়ের করে। এক্ষণে দারোগা বাবু রাষ্ট্রীয় পোষাক পরে পদমর্যাদা অনুযায়ী যা যা বলেন, জাতিসংঘ বৈঠকে ঐরকম কিছুই বলে। বরং তার চেয়েও আরেকধাপ নিচের অর্থাৎ আরেক রাষ্ট্রের ভেটোর কারণে কোন সিদ্ধান্ত না দিয়েও সভা সমাপ্তি ঘোষণা করে দেয়। তবুও আমরা অজ্ঞ মুসলিম বলে উঠি জাতিসংঘ আমাদের এ নির্যাতন দেখে না? তারা এটা কেন করে না? ওটা কেন বলে না? ইত্যাদি ইত্যাদি। হে বোকা মুসলিম, তুমি ইহুদী খৃস্টানদের জাতিসংঘের দিকে সাহায্যের আশা করো, তোমাদের না ওআইসি ছিল? মূল কথা পৃথিবীর ৫৫টি দেশের মুসলিম শাসকদের মধ্যে কয়জন শাসক আছেন যাদের দিয়ে মুসলমানদের কোন উপকার হয়? এক খৃস্টান বাদশা নাজ্জাশীর দ্বারা মুসলমানদের যে আশ্রয় ও উপকার হয়েছে সে রকম তো মুসলিম শাসক দিয়েও হচ্ছে না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আরো স্পষ্ট করে বলে দিলেন যে, মুসলিম শাসকরা স্বার্থপর। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ছাড়া কেউ একটা কথা বলছেন না। ইরমান খান ঘোষণা দিলেন যে শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্তু কাশ্মীরীদের জন্য লড়ে যাবো। ভারতের সীমান্ত পাকিস্তানের সাথে হওয়ায় তার হয়তো বেশি গায়ে লাগে। আমাদেরও তো সীমান্ত আছে! আমাদেরও তো লাগার কথা। কিন্তু আমরা কেন মুসলিম নিধনের পক্ষে কথা বলছি? আমাদের কী ঈমান ইসলাম লাগবে না? আমরা কী লেংটা সাধুর আস্তানায় গিয়ে হিন্দুদের মত মাতা নত করে দিতে পারবো? আমরা কী লেংটা সাধুর আশীর্বাদ নিয়ে বেঁচে থাকবো? মূর্তিপূজায় অংশগ্রহণ করে বেঁচে থাকবো? কী হবে আমাদের পরিণতি? কী হবে কাশ্মীরের পরিণতি! ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় এমন এক পেচ এখানে বৃটিশরা মেরে গেছে, যা আর ছাড়াবার নয়। কাশ্মীরের অর্ধাংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। জম্বু কাশ্মীর ভারতের নিয়ন্ত্রণে। কিছু সীমানা চীনের সাথে। ভৌগলিক জটিল অবস্থানে পড়ে গেছে পৃথিবীর ভূস্বর্গ খ্যাত এই লোভনীয় অঞ্চলটি। এরা যদি আজাদির আন্দোলনে নামে, তো কাদের বিরুদ্ধে লড়বে? একটি দেশের সাথে তো তাদের সমস্যা নয়। কয়েক দেশের সাথে। শেষতক কি মুসলমানদের খতম করে ভারত ঐ অঞ্চল তাদের দখলে নিয়ে যাবে? নাকি মুসলমানগণ তাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবে। মুসলমানরা কী মুসলমানদের সাহায্য করবে না? মুসলমান শাসকরা কী ইহুদী খৃস্টানের আজ্ঞাবহ গোলাম হয়েই দেশের ক্ষমতা ধরে রাখবে? দাসীর সন্তানও দাসত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে নাকি জন্মসূত্রেই গোলাম। তাহলে ইহুদী খৃস্টানদের পাচাটা গোলামদের শাসনে জন্মগ্রহণ করা শিশুটিও কি অমুসলিমদের গোলাম হয়ে জন্ম নেবে? কারণ যেমন রাজা তেমন প্রজা। এটা প্রবাদ। মুসলমানদের স্বাধীন মস্তক কী উন্নীত হবে না? কাশ্মীর কী স্বাধীন হবে না? কাশ্মীর স্বাধীনতা কতদূর?

Comments

comments