অন্যান্য

স্মরণের স্বরলিপি : কর্মবীর এক মহামনীষীর জীবনকথা

By mumin

June 18, 2017

তোমারই প্রাসাদে তোমারে লভিব বিফল হবেনা আশা সার্থক তোমার মানব জীবন সফল এ সংসারে আসা আমাদের দেশে গুণীদের মূল্যায়ন হয় তাদের মৃত্যুর পর, কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় মৃত্যুর পরও…(!) মানুষ মরণশীল, সব মানুষকেই মরতে হবে, পবিত্র কালামে পাকে মহান আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা। একজন গুণী মানুষ মৃত্যু বরণ করতে পারেন কিন্তু তার গুণ মরে না ! আর তিনি যদি হন শিক্ষক, তাহলে তার গুণ এমনিতেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষের আসনে। প্রকৃত একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর, বড্ড আনন্দ লাগে ! যখন দেখি শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা তারাই পদধূলিত করে কান ধরে উঠবস করেন এবং এই মহান পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও ধর্ষণ ও নারী কেলেঙ্কারী মামলার আসামী (!) একজন শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর এজন্যই বলা হয় যে, গ্রাম্য ভাষায় একটি কথা আছে (মা বাবা বানায় ভুত, উস্তাদে বানায় ফুত) যা বাস্তব এবং এক কঠিন অভিজ্ঞতা! জগতে কিছু মানুষ আছেন যারা সাধারণ অন্য দশজন মানুষের চেয়ে ব্যতিক্রম (যদিও বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে অমানুষের সংখ্যাই বেশি হবে) তেমনই একজন মহামানব সুনামগঞ্জ জেলার একক, অনন্য ও ঐতিহ্যবাহী কামিল (এম এ) মাদ্রাসা, দারুল হাদিস বুরাইয়ার সাবেক অধ্যক্ষ প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ নুরুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহি। চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী আমাদের আতœীয়-স্বজন বা পরিচিত যে কোন মানুষ মারা গেলে চোখের জলে কয়েকদিন আমরা বালিশ ভিজাই আর বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে ফেইসবুক-টুইটারে লম্বা লম্বা শোকাবহ স্ট্যাটাস দেই ! প্রথম দিকে মাত্রা থাকে একটু আবেগাপ্লুত, স্মৃতিচারণের মধ্যেই যার ঘটে সমাপ্তি। দিন যতই যেতে থাকে, স্বরণের মাত্রা ততই কমতে থাকে এবং এক সময় তারা স্মৃতির অতল গহ্বরে অদৃশ্যভাবে হারিয়ে যান ! আমরা পলিমাটির সন্তান। বুকের গভীরে আবেগের ফসল জন্মাতে আমাদের যেমন জুড়ি মেলা ভার তেমনি আমাদের নিকট অতীতকে ভুলে যেতেও আমাদের জুড়ি নেই। পশ্চিমা দেশগুলোতে কোথাও ছিটেফোঁটা পলিমাটি নেই। ইটের পর ইট, কঠিন মৃত্তিকার উপর দাঁড়িয়ে আছে তাদের জীবন-জীবিকা। সেই কঠিন শিলার আস্তরণ ভেদ করে তারা যদি শেক্সপিয়র বা নেপোলিয়নের স্মৃতি উজ্জ্বল রাখতে পারে তাহলে পলিমাটি দিয়ে যাঁদের জীবন গড়া সেই বাঙালিরা কেন পারিনা আমাদের অতীতের সোনালী দিনগুলোতে বিচরণ করতে !

“জীবন যদি নতুন ভাবে হয়গো আমার শুরু তোমার মতো পাবোনা আর এমন শিক্ষাগুরু” প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা নির্ণয় যেমন কঠিন তেমনি এ দেশমাতৃকার আলোকিত সন্তানদের সফল সৃষ্টি ও কর্মের পরিমাপ করা আরো কঠিন! ভাবতে খারাপ লাগে যে, আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ নুরুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহি”র মতো ব্যক্তিরা খেয়ে না খেয়ে, কতযে কাদামাটি গায়ে মেখে শুধু চিন্তা করেছেন, আমার প্রতিষ্ঠান, আমার ছাত্র/ছাত্রী! প্রতিষ্ঠান যেন তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। একদা কোন এক বন্ধের দিনে বেড়াতে গিয়েছিলাম বুরাইয়া, হঠাৎ এমন ঝড়-বৃষ্টি এলো, পুকুরপাড় থেকে মাদ্রাসার বারান্দায় যেতে যেতেই অর্ধ ভেজা ! মাদ্রাসা বন্ধ ঠিকই, অধ্যক্ষের কার্যালয় খোলা ! ভাবলাম সুযোগ যখন পেয়েছি দেখা করে যাই। সালাম-পরিচয় দিতেই বললেন বসেন, সাথে সাথেই চা নাস্তার আয়োজন, যেন আমি বিশাল কেউ ! এক পর্যায়ে বললাম যে মাদ্রাসা যেহেতু বন্ধ এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আপনিতো না আসলেও পারতেন ? প্রতিউত্তরে বললেন আমি না আসলে পারতাম কিন্তু আমার কাজগুলোতো আর কেউ করতে পারবেনা। “আধো ঘুম আধো জাগা কান পাতি যবে তোমার শেখানো বুলি সব সাথে রবে।” দেড় বছর সাধনার পর অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে, অনেক কঠিন সীমানার প্রাচীর ডিঙিয়ে বুরাইয়া কামিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ আল্লামা আবুল হাসান মোহাম্মদ নুরুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে নিবেদিত ৭৫ জন নবীন ও প্রবীণ কবি-সাহিত্যকদের হৃদয় নিংড়ানো কবিতা ও ছড়া দিয়ে তারই সুযোগ্য ছাত্র (আনলিগ্যাল সিলেটী) জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি জহীর মুহাম্মদ সম্পাদনা করেছেন ‘স্বরণের স্বরলিপি’ স্মরণ গ্রন্থটি। বইটির প্রথমেই সম্পাদক লিখেছেন- ‘এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, হাল আমলে ভাটি বাংলার দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে হাতে গোনা যে ক’জন মণীষার নাম নাম স্বরণযোগ্য, তাদের মধ্যে আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ নুরুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি একাধারে একজন মুহাক্কিক আলিমে দ্বীন, সুযোগ্য ফকিহ এবং কুরআন-সুন্নাহর নিবেদিত একজন খাদিম ছিলেন। ক্ষণজীবী এই মানব গড়ার প্রদীপ্ত কারিগরের বহুমুখী গুণাবলী সুনামগঞ্জ জেলা তথা পশ্চিম সিলেটের প্রত্যন্ত জনপদের দ্বীনদার বনী আদমের কাছে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে’। ভূমিকার আকারে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা দিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট এডভোকেট জিয়াউর রহীম শাহীন, তিনি লিখেছেন- ‘জীবন চলার পথে প্রথমেই নিজেকে জানতে হয় পরিপূর্ণ ভাবে বুঝতে হয় মার্জিত ভাবে। আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন ‘নো দ্যাই সেলফ’। সত্যিকার মানুষ হিসাবে নিজেকে জানতে হলে উপযুক্ত শিক্ষক এবং শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে স্বর্ণপদক ভূষিত এ শিক্ষাগুরু এক জীবন্ত ইতিহাস, গৌরবের কিংবদন্তি’। বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি অধ্যক্ষ কালাম আজাদ তার কাব্যে আল্লামা আবুল হাসান নুরুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে আবিষ্কার করেছেন- “মরহুম নুরুল হক (রহমতুল্লাহি আলাইহি) ভাটির ফুল বলে উচ্চারিত শুনি এই নাম ইলমি জগতে ছিল পুষ্পিত সুনাম মৃত্যুতে মহিয়ান বলিয়ান হয়ে তা থাকুক মাওলা মাবুদ তারে উচ্চাসনে রাখুক, রাখুক ” কবি গোলাম মোহাম্মদ পাখি বাসা ছাড়লে যে বুক কতটুকু বেদনা বিধুর হয় তারই এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে – পাখি যে ছেড়েছে বাসা বুক ভরে বেদনা আতর স্বরণের স্বরলিপি সুর তার করুণ কাতর। এরকম হাজারও হৃদয় উজাড় করা ছন্দ ও কথার বাহার দিয়ে সাজানো “স্বরণের স্বরলিপি” মস্তিষ্ক বিকৃত বুদ্ধিজীবিরা যখন শান্তির ধর্ম ইসলাম ও উলামায়ে কিরামদেরকে দেশ ও সমাজের কাছে হেয়প্রতিপন্ন করতে মরিয়া ! ঠিক সেই মুহুর্তে বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক বাছিত ইবনে হাবীব লিখেন, নিজের কথা ভাবতে গিয়ে দেখি ভাণ্ডারে নেই কিছু নরম সুরে নত হয়ে বলি দাড়াতেই হবে আমায় উলামাদের পিছু। সবকিছু ঠিক থাকার পরও আল্লামা আবুল হাসান নুরুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে কিভাবে অবজ্ঞা করছি তার এক উদাহরণ টেনেছেন সম্পাদক নিজেই- “আসে কতজন, স্বজন-সুজন সবই ঠিকঠাক চলে কেন জানি হায় ! ভুলেছি তোমায় আমরা কৌশলে। আল্লামা আবুল হাসান মুহাম্মদ নুরুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহি ছাতক উপজেলার চিছরাওলী গ্রামে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৫ সালে ইন্তেকাল করেন। সুদীর্ঘ ২৬ বছর বুরাইয়া কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন এবং শেষের ১০ অধ্যক্ষ ছিলেন। অধ্যক্ষের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। বহু গুণে গুণান্বিত এই মহামনীষা সম্পর্কে লিখতে গেলে ২/৪ টা বই কোন ব্যাপারই না ! পরিশেষে রাহমান রাহিমের দরবারে গুজারিশ আল্লাহ যেন তার মায়ার বান্দাকে পরপারে শান্তিতে রাখেন এবং ‘স্বরণের স্বরলিপি’ দীর্ঘজীবী হোক এই কামনা। পাদটীকাঃ এই লেখাটি বইয়ের উপর কোন আলোচনা-সমালোচনা নয়, বই সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে, যে বই সম্পাদনা করছেন তার চেয়ে জ্ঞানী মানুষের দরকার। আমি শুধুমাত্র কথিত ‘পাঠ প্রতিক্রিয়া’ দিলাম। স্মরণের স্বরলিপি ॥ সম্পাদক: জহীর মুহাম্মদ; প্রকাশক: শব্দতারা প্রকাশন, সিলেট; প্রচ্ছদ: আতিক সামী; প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা-২০১৭; পৃষ্ঠা: ৮০; দাম: ১৬০ টাকা

Comments

comments