ধারাবাহিক উপন্যাস

হিয়ার মাঝে (৬ষ্ট পর্ব)

By mumin

January 01, 2020

হিয়ার মাঝে (৫ম পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর) বেলা প্রায় সাড়ে দশটা বাজে! রাজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করছিলো! ডাম্বল হাতে নিয়ে হাতগুলো ওঠানামা করার সময় ওর পাকানো দড়ির মতো পেশীগুলো চামড়া ভেদ করে আরো ফুটে উঠছিলো! তখনি সে দেখলো বারান্দায় একটি গাড়ি এসে থেমেছে! রাজ ডাম্বলগুলো ফেলে টাওয়েল টেনে নিয়ে ঘাম মুছল তারপর টাওয়েলটা ঘাড়ে ফেলে দুহাত কোমড়ে রেখে সেদিকে চেয়ে রইল! কে এলো হঠাৎ এ সময়ে! গাড়ি থেকে ইসতিয়াককে নামতে দেখে রাজের মুখোভাব আরো গম্ভীর হয়ে গেলো! ইসতিয়াকের সাথে আরেকজন মহিলাও নামলেন। সম্ভবত ওর মা হবেন। রাজ এগিয়ে গেলো। ওকে দেখতে পেয়ে ইসতিয়াকও হাসিমুখে এগিয়ে এলো! হ্যান্ডশেকের জন্য হাতটা বাড়িয়ে ধরলো! -“হাই…কেমন আছেন রাজ সাহেব? চলে এলাম দেখা করতে…! “ রাজের ইচ্ছে ছিলোনা তবু ভদ্রতার খাতিরে ইসতিয়াকের বাড়ানো হাতটা ধরে ঝাকিয়ে মৃদু হেসে বলল- -“ভালো করেছেন আসুন! “ ড্রইং রুমে তাদের বসিয়ে রাজ রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলো মা’কে ডাকবে ভেবে কিন্তু উঁকি দিতেই ওর বুকের রক্ত ছলকে উঠল! মনের তাণপুরায় সমস্ত রাগিনী একসাথে বেজে বলে উঠলো- আহা…আমার মানসপ্রিয়া! আমার যৌবন সরসীনীরে মিলনের শতদল! ওকে যে এখানে দেখবে এটা তো রাজ আশাই করেনি! পৌষী চায়ের কাপে চা ঢালছে! ওর গায়ে হালকা একটা ওড়নামতো শাল ঝুলে আছে! আর মাথায় বরাবরের মতো ওড়না! তবে আজ ওড়নার ফাঁক গলে ওর কপালের একগোছা চুল বেয়াদবের মতো কানের উপর দিয়ে মুখের একপাশে এসে পড়েছে! রাজের মনে হলো…আহ্..ঐ চুলগুলো সরানোর অধিকারটা যদি আমি পেতাম তবে ওগুলোকে মৃদু বকে দিতাম ওকে বিরক্ত করার জন্য তারপর সযতেœ সেগুলোকে ওর কানের শাসনে বন্দী করে দিতাম। পৌষী চায়ে দুধ চিনি মিশিয়ে জিনিসপত্র যথাস্থানে রেখে দিলো। চায়ের কাপটা নিয়ে বেরোবার আগ মুহূর্তে শালটাকে ঠিক করে পড়ার জন্য সেটাকে খুলে দুহাত প্রসারিত করে ঘুরে দাঁড়াতেই দরজায় রাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝপ করে হাত নামিয়ে দ্রুত পিছন ঘুরে দাঁড়ালো! ওড়নাটা টেনে মুখ ঢাকলো। কাঁপা স্বরে বললো-“আ..আপনি…মামী তো তার ঘরে! “ রাজ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল-“চা টা কার জন্য? “ পৌষী নিজের জন্যেই বানিয়েছিলো! তাই মৃদু স্বরে বলল-“আমার জন্যে! “ -“ওহ্…আচ্ছা…আমাকেও এককাপ দিননা প্লিজ…! পৌষী মহাফাঁপরে পড়লো! সে যতক্ষণ নতুন করে চা বানাবে ততক্ষণ রাজ দাড়িয়ে অপেক্ষা করবে এটাতো চরম অস্বস্তিকর! তারচে সে এটা নিয়েই চলে যাক্! পৌষী মুখ না ফিরিয়েই নিজের চায়ের কাপটা বাড়িয়ে ধরে বলল-“এটা নিন্! আমি আবার বানিয়ে নিচ্ছি! রাজের চা খাবার কোনো ইচ্ছেই ছিলোনা। এটা ছিলো কথা বলার একটা বাহানা মাত্র! তবু রাজ হাত বাড়িয়ে চা টা নিলো! চুমুক দিয়ে বলল- -“উমমম…চা টা বেশ ভালো হয়েছে! থ্যাংক্স। “ রাজ দরজা আগলে দাঁড়িয়েই চা খেতে লাগলো! কারণ সে জানে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেই তার পরানপাখি দরোজার ফাঁক গলে ফুড়ুৎ করে উড়াল দেবে! রাজ আরো কিছুক্ষণ ওকে ধরে রাখতে চায়! ওদিকে পৌষীর ইচ্ছে সে আর চা বানাবেনা,এখান থেকে বেরিয়ে যাবে কিন্তু রাজ যেভাবে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে তার বেরোবার কোনো উপায় নেই! সে রাজের দিকে পেছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে একটু চিন্তা করলো! কি করা যায়!

লোকটা এতো বেয়াদব যে ইচ্ছে করে দরজা আগলে আছে। পেছন থেকে চায়ের কাপের টুংটাং শব্দ আসছে তারমানে রাজ এখনো সরেনি ওখান থেকে ! রাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ো পুরো চা টা খালি পেটেই চালান করে দিলো! খালি কাপটা রাখার জন্য পৌষীর দিকে এগিয়ে যেতেই পৌষী দরজা খালি পেয়ে দ্রুত রাজকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো! রাজ হতাশ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো! তারপর দরজার সামনে এসে পৌষীর গমনপথের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল-“আজকের সকালটা তো বেশ লাকি ছিলো। সকাল সকাল মানসপ্রিয়ার হাতে চা জুটে যাবে ভাবতেই পারিনি! “ ডান হাতে নিজের চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে শীষ বাজাতে বাজাতে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে ড্রইংরুমে চলে এলো! সেখানে ইসতিয়াক আর ওর মা বসে আছেন! রাজ ওদের দেখে জিভে কামড় দিলো! এই যাহ্, এদের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বলল-“ওহ্… আপনারা… আরে.. স্যরি… বসুন মা’কে ডেকে দিচ্ছি! বলে রাজ দ্রুত মায়ের রুমের দিকে চলে গেলো! ও আসলে মা কে ডাকতেই রান্নাঘরে ঢুকেছিলো কিন্তু পৌষীকে দেখে সব ভুলে গেছে! মায়ের রুমে যেয়ে মা’কে বললে তিনি বেরিয়ে এলেন! রাজ বলল-“ড্রইংরুমে গেষ্ট এসেছে। “ -“এই সকাল বেলা কে এলো? “ -“ইরার দেবর আর একজন ভদ্রমহিলা এসেছে! “ রাণী তটস্থ হয়ে উঠলেন-“সে কি…কখন? রাহেলাকে চা নাস্তা দিতে বলেছিস? দাঁড়া আমিই যাচ্ছি! “ রাণী দ্রুত ড্রইংরুমে এসে তাদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন! রাজ “এক্সকিউজ মি’ বলে ওদের পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে এলো! পৌষী নিজেদের ঘরে ঢুকে শালটা রেখে চুলগুলো খোপা করে পড়ার টেবিলে যেয়ে বসলো! একটু বিরক্ত লাগছে ওর! চা টা নিজে খাবার জন্য বানালো হঠাৎ রাজ এসে পড়ায় চা টা আর খেতে পারলোনা,ওকে দিয়ে দিতে হলো! এদিকে মাথাটা বেশ ধরেছে…চা খেতে হলে ওকে আবার রান্নাঘরে যেতে হবে! কিন্তু রান্নাঘরে যাওয়া এখন নিরাপদ হবেনা। বলা তো যায়না রাজ আশেপাশেই থাকতে পারে! ইদানীং লোকটা প্রায়ই এদিকটায় চলে আসে। ওরা এ বাড়িতে আসার পর থেকে ওকে একদমই এদিকে আসতে দেখেনি! বরং রাহেলা বা সাবুমিয়াকেই ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তার রুমে সরবরাহ করে আসতে দেখেছে। হঠাৎ এদিকে তার এতো আসার কি দরকার পড়লো? যাক্, তার বাড়িঘর সে যেদিকে খুশি যাবে পৌষীর কি বলার আছে। তবে এখন থেকে একটু সতর্ক থাকতে হবে….এই যা! ‘ এমন সময় সাহেদা এসে পৌষীর পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখলেন-তোকে তোর মামী ডাকছে তার রুমে! “ -“হঠাৎ? কেন ডাকছেন জানো? “ সাহেদা ইতস্তত করে বললেন-“সেদিনের সেই সমন্ধটার কথা বললাম না,ওই ছেলে আর তার মা এসেছেন! “ পৌষী রেগে গেলো! -“যখন তখন কেউ এলেই তার সামনে যেতে হবে? আর ওরাই বা হুট করে এসময় কেন আসবেন? আমি যেতে চাই না মা! তোমাকে তো বলেছি…আমি এখানে বিয়ে করতে চাই না! “ সাহেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-“ডাকছে যখন দেখা করে আয়…দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না! তাছাড়া ওরা ইরার কাবিনের কাপড় চোপড় দিতে এসেছেন। এই সুযোগে হয়তো তোর সাথে দেখাটা সেরে নেবেন। আমাদের জন্য তো এটাই ভালো হলো! ঘটা করে তোকে দেখতে এলে আমাদেরই আপ্যায়ন-আয়োজন করতে হতো। বরং এখন তুই স্বাভাবিক ভাবে তাদের সামনে যেতে পারবি! “ -“না..না…আমি ঐ ছেলের সামনে যাবো না। তার মায়ের সাথে দেখা করতে বলছো সেটা করতে পারি! আর আমি যেভাবে আছি সেভাবেই যাবো! কাপড়-টাপড় চেঞ্জ করতে পারবো না! “ -“আচ্ছা…ঠিক আছে, তোর মামীর ঘরে চল, তিনি তোকে ডাকছেন! মিনিট দশেকের মধ্যে পৌষী মামীর রুমে এলো! মামী সেই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলছেন! পৌষি তাকে সালাম দিলে মহিলা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে পৌষিকে কাছে টেনে বসালেন- -“কি নাম তোমার মা? “ -“জ্বী…..পৌষী! “ -“সুন্দর নাম! কি পড়ছো এখন ? “ -“অনার্স ফার্ষ্ট ইয়ার….! “ পৌষীর সাথে টুকটাক আলাপ চলছে আর পৌষী উসখুস করে মায়ের দিকে তাকাচ্ছে! সাহেদা মেয়ের মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন-“আপা, কিছু যদি মনে না করেন,ওর কলেজের দেরী হয়ে যাচ্ছে তো….! “ -“ওহ্…আচ্ছা তুমি যাও! ” বলে মহিলা পৌষীর থুতনী ধরে সেই আঙ্গুলে চুমু খেলেন! পৌষী চলে যাবার পর এবার ভদ্রমহিলা নিজের ছেলের গুনগান গাইতে শুরু করলেন। নিজেদের স্ট্যাটাস নিয়েও নানান কথা বলতে লাগলেন! তার কোন্ ভাই কোথাকার এমপি, কোন ননদের জামাই সচিব….তো তার ছেলে আর কদিন বাদেই ডেপুটি হয়ে যাবে….ইত্যাদি গুণকীর্তন করতে লাগলেন! রাণী বিগলিত ভঙ্গিতে আর সাহেদা অস্বস্তি নিয়ে নীরবে সেসব কথা শুনে যেতে লাগলেন! চলে যাবার আগ মুহূর্তে রাজ নিজেই ইসতিয়াকের সাথে দেখা করে ওর ফোন নাম্বারটা নিয়ে নিলো! কাঁধে হাত রেখে বললো-‘আপনার যে কোনো প্রয়োজন আপনি আমাকে আগে জানাবেন, কোনো সমস্যা নেই! আমি তো আছিই…..! “বলে রাজ হাসলো। ইসতিয়াক হাত ধরে ঝাঁকিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে রাজের প্রশংসা করলেন। তবে পৌষীর দেখা না পাওয়ায় কিছুটা হতাশও মনে হলো তাকে! ওরা চলে যাবার পর রাজ মা’কে জিজ্ঞেস করলো-“ওরা কি পৌষীকে দেখতে এসেছিলো মা ? “ -“না, তা না ওরাতো ইরার আকদের কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছে। সেই সুযোগে পৌষীর সাথে ইসতিয়াকের মা দেখাও করে নিলেন। খুবই সেয়ানা মহিলা বুঝলি ! ছেলের পীড়াপীড়িতে এসেছেন ঠিকই তবে অন্য কাজের বাহানা দিয়ে এসেছেন। সে সরাসরি মেয়ে দেখতে আসেনি! ইরার কাপড়ের ছুতো ধরে পৌষীকে আরেকবার দেখে নিলেন ভদ্রমহিলা! ছেলের পছন্দ তার সাথে মিলবে কিনা এটা দেখার জন্য নিজে আবার এসেছেন! সেদিন তো পৌষী সেজে ছিলো আজ সাজ ছাড়া দেখে গেলো…..হুঁহ্..মনে করেছে কিছু বুঝিনা ! -“মানে? এখানে বোঝাবুঝির কি আছে? ” রাজ প্রশ্ন করলো! -“আরে…মেয়েটা তার স্ট্যাটাসের সাথে যাবে কিনা এটা দেখতে হবেনা? খালি দেখতে সুন্দর হলে হবে? “ রানী ভ্রু কুঁচকে বললেন! রাজ চিন্তিত মুখে বলল-“তা ভদ্রমহিলার আচরণে কি মনে হলো? পৌষীকে পছন্দ হলো তার? “ যদিও রাজ জানে পৌষীকে দেখলে পছন্দ না হবার কোনো কারণই নেই তবু নিশ্চিত হবার জন্যই প্রশ্নটা করা! রাণী কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন-“আরে বাবা…পৌষিতো পছন্দ না হবার মতো মেয়ে না! যেমন দেখতে তেমন গুণে! পাঁচপদে পুরোই আছে….নেই খালি টাকাপয়সা! সে তো আর মালদার নয়! আর আজকাল শুধু রুপ গুণ হলে চলে না মালপানিও থাকা লাগে! খালি রূপ দেখে কি বিয়ে করাবে নাকি কেউ?” রাজ একটু ভেবে বলল-“,তুমি নিজেও কি এই ধ্যান ধারনায় বিশ্বাসী মা? “ চলবে

হিয়ার মাঝে (৫ম পর্ব)

Comments

comments