ধারাবাহিক উপন্যাস

হিয়ার মাঝে (৪র্থ পর্ব)

By mumin

November 19, 2019

(পূর্ব প্রকাশের পর) রাজ শক্ত হয়ে গেলো! অজান্তেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো! বুকের ভেতর হাতুড়ীর বাড়ি পড়লো যেন। ইসতিয়াক হাসল-‘আম্মা ওয়ান্টস টু টক টু হার প্যারেন্টস…ইট মিন…বুঝতেই পারছেন! সি ইজ সো লাভলি! আই ওয়ান্ট টু ম্যারি হার!’ রাজের ইচ্ছে হলো এক ঘুষিতে ইসতিয়াকের নাকটা ফাটিয়ে দিতে! কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রাজ। ওর মনে হলো কেউ যেন ওর কলিজা ধরে টান দিয়েছে।

পৌষী শাড়ী বদলে ঘরোয়া পোষাক পড়ে নিয়েছে। পৌষী জানতো এশার নামাজটা অনুষ্ঠান শুরুর আগে না পড়লে পরে কাযা হয়ে যাবার ভয় আছে,তাই সে নামাজটা আগেই পড়ে নিয়েছে! সাহেদা শোয়ার আয়োজন করছিলো, পৌষী মায়ের কাছে এসে বসল! সাহেদা বললেন-‘কি হলো…ঘুমাবি না?’ -‘হমম, ঘুমাবো! আচ্ছা…মা,আমরা কি অন্য বাসায় ভাড়া চলে যেতে পারিনা?’ -‘হঠাৎ একথা কেন বলছিস রে মা? কিছু হয়েছে?’ -‘না…কি আর হবে? এরা তো পুরোপুরি বিজাতীয় রীতিনীতি পালন করে চলে। এতো জোরে গান বাজাচ্ছিলো যে আমার মাথা ধরে গিয়েছিলো! তাছাড়া আজকের অনুষ্ঠানে যে পরিমান টাকা খরচ করা হয়েছে এই টাকা দিয়ে পাঁচটা বিয়ের অনুষ্ঠান করা যেতো! তুমিই বলো, আংটি পরানো কি কোনো ইসলাম সম্মত অনুষ্ঠান? অথচ বর কনে এখন এই অনুষ্ঠানের সুবাদে দেখা করবে,কথা বলবে…একসাথে বেড়াতে যাবে! গুনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলো! বিয়েটা তো নাও হতে পারে! বরং এসব না করে কাবিন করিয়ে ফেলাটা শরীয়ত সম্মত হতো!’ সাহেদা মেয়ের কথা শুনে মৃদু হাসলেন! -‘তোর কথা ঠিক আছে। কিন্তু এখানে তুই কাকে বোঝাবি এসব কথা? আমরা তো আজকে নামের মুসলিম! আমাদের ভেতর ইসলাম কই? আর তুই বাড়ি ভাড়া করে অন্যত্র থাকার কথা বলছিস? তোর তো সবই জানা আছে, কোন্ পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে আজ অন্যের বাড়িতে এসে উঠেছি। তোকে নিয়ে একা একটা বাড়িতে থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ না এটাতো জানিস। নইলে আমার কি ভালো লাগে দিনের পর দিন পরের বাড়ি পড়ে থাকতে? তার উপর মাসে মাসে বাড়ি ভাড়া গোনার সামর্থ্য কি আমাদের আছে,বল্?’ পৌষী চুপ মেরে গেলো! কথা তো সত্য! ওরা নিজেদের বাড়িতেও কত বড় বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলো। মাথার উপর একজন পুরুষ না থাকাটা একজন মেয়ের জন্য বড় গ্লানির এটা পৌষীর চেয়ে বেশি আর কে বোঝে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রাখলো পৌষী! সাহেদা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-‘তোর একটা ভালো বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমার দুশ্চিন্তা যাবে না! একটা ভালো ছেলে…..!’ এ পর্যায় পৌষী হঠাৎ উঠে বসল-‘ভালো ছেলে মানে কি ধনী?’ -‘না ধনী কেন হবে, সৎ চরিত্র কর্মক্ষম….!’ -‘আসলটাই তো বললে না, একটা কথা বলে রাখি মা….আমি কিন্তু দ্বীনদার ছাড়া বিয়ে করবো না! সে গরীব হোক তবু আমার দ্বীনদার চাই! আমার এই একটাই অনুরোধ তোমার কাছে! “ -‘আমাকে অনুরোধ না করে আল্লাহর কাছে বল্! তোর ইচ্ছে পূরণের ক্ষমতা ঐ আল্লাহ ছাড়া কার আছে! আমি নিজে তো এতো বুঝতাম না ইসলাম সম্পর্কে! তুই বই পড়ে লেকচার শুনে যতটা পালন করিস আমরা তো তোকে সেই তরবীয়ত দিয়ে বড় করতে পারিনি! এটা তো আল্লাহর দান যে তুই হেদায়েত পেয়েছিস!’ পৌষী চিন্তিত সুরে বলল-‘মা, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। সন্ধ্যের অনুষ্ঠানে এক মহিলা আমার নানান খোঁজখবর নিচ্ছিলো। কেন যে এতো কথা জিজ্ঞেস করলো বুঝতে পারলাম না!’ -‘তুই অবিবাহিত মেয়ে, লোকে প্রশ্ন করতেই পারে!’ পৌষী কিছু একটা বলতে যাবে তখনি দরোজায় টোকা পড়লো! সাহেদা উঠে দরোজা খুলল। দেখলো রানী এসেছে,ওর পেছনে রাহেলা দুটো বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে! সাহেদা অবাক হলো-‘এসব কি ভাবি?’ -‘আরে পৌষী আর তোমার জন্য রসমালাই আর রাবড়ী। ঘুমুতে যাচ্ছো?’ -‘হ্যাঁ, তা তুমি আবার এসব আনতে গেলে কেন? কাল সবার সাথেই খাওয়া যেতো!’ -‘না, এখনি পৌষিকেও দাও,নিজেও খাও, তোমার ভাই এখনি না দিলে আবার রাগারাগি করবে! ইয়ে…. সাহেদা তোমার সাথে একটা কথা ছিলো!’ -‘বলো…ভাবী!’ -‘এখানে না…বাইরে এসো!’ সাহেদা একটু বিভ্রান্ত হলেন, এতো রাতে আবার কি হলো! তার আজকাল অল্পতেই ভয় লাগে। একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে নিয়ে অভিভাবকহীন মায়ের যে কি চিন্তা তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না! সাহেদা পৌষীকে শুয়ে পড়তে বলে রানির পিছু পিছু ড্রইংরুমে এলেন! রানী বলল-‘বসো সাহেদা!’ রানীর এতো অমায়িক আচরণে সাহেদা মনে মনে চিন্তিত হলো! হঠাৎ কি এমন হলো যে রানী তাকে সমীহ করে কথা বলছে? -‘কি হয়েছে ভাবী? কোনো সমস্যা?’

-‘সমস্যা কিছু না, আমাদের ইরার হবু শ্বশুড়ের ছোটভাই নিয়াজউদ্দিনের কথা তো শুনেছো! তার একমাত্র ছেলে ইসতিয়াক হলো সচিবালয়ের বড় অফিসার! ওর মা তোমার পৌষীকে কোন ফাঁকে যেন দেখেছে। দেখে ওর মামীকে দিয়ে তোমাদের খোঁজখবর নিয়েছে! মনে হয় বিয়ের সমন্ধ পাঠাবে! ওর মামী তো তাই বললো! তোমার মেয়ের তো রাজকপাল,এমন অবস্থায় এমন পরিবার থেকে সমন্ধ এসেছে! তোমার আর কি! মেয়ে কোটিপতির ঘরে যাবে..! এখন ওরা যদি পৌষীকে দেখতে আসতে চায় তখন কি করবে আগে থেকেই ভেবে রাখো! “ সাহেদার বুকে আনন্দের তুফান উঠতে গিয়েও তা বিলীন হয়ে গেলো। একটু আগেই পৌষী বলেছে সে দ্বীনদার পাত্র চায়! সাহেদা বিরাট সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলেন! রানী আবার বললেন- -‘কি ভাবছো এতো! ছেলের মায়ের নাকি খুবই আগ্রহ। ছেলেকে আমাদের পৌষীর ছবি দেখিয়েছে, সে তো রাজী। এখন বড় ঘাটে নৌকা বাঁধতে গেলে তোমাকেও তো মোটা দড়ির যোগান দিতে হবে। কি বলছি,বুঝতে পারছো তো?’ সাহেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-‘ভাবী, আমার মেয়ে তো দ্বীনদার ছেলে ছাড়া নাকি বিয়ে করবে না! এই প্রস্তাবে কি ও রাজী হবে?’ রানী চোখ কপালে তুলে বলল-‘তুমি কি পাগল না ছাগল? তোমার মেয়ে একেবারে কোথাকার অলি আউলিয়া যে দ্বীনদার চেয়ে ঠেঁটিয়ে বসে থাকবে? তোমার সাত কপালের ভাগ্য যে তোমার মেয়ের জন্য এমন পরিবার থেকে প্রস্তাব এসেছে। মেয়ে বললো আর তুমিও ওর কথায় নাচা শুরু করে দিলে! কেন আমরা কি ইসলাম জানি না? সব বিধান তোমার মেয়েই জানে নাকি…যত্তসব…! ওর কথা ছাড়ো! ছেলে পক্ষ আগ্রহ করলে নিজের যা আছে বেচে টেচে মেয়ে পার করো! তোমার আর কি,এ বাড়িতে তোমার দিন একরকম কেটেই যাবে! আমরাতো আর তোমাকে ফেলে দিচ্ছি না! আরে মেয়ের হাতে ক্ষমতা যখন আসবে সে তখন তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে পারবে! তোমার তো পাঁচ আঙ্গুল ঘিয়ে। তোমার এসব ছন্নছাড়া কথা আর কাউকে বলো না, মানুষ তোমাকে পাগল ভাববে নতুবা মনে করবে তোমার মেয়ের অন্য কোথাও লাইনজাইন আছে! বুঝেছো?’ সাহেদা পুরোপুরি দমে গেলেন। রাণীর কথাবার্তার ধরন তার ভালো না লাগলেও কিছু বলার নেই। সে খুব একটা মিথ্যে তো বলেনি! সাহেদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল-‘ভাবী আমি পৌষীর সাথে কথা বলি আগে! বাপ মরা মেয়ে আমার। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি ওকে চাপ দিতে চাই না! আমি জানি আপনি ওর ভালো চান। কিন্তু মেয়েটারও তো একটা মতামত আছে!’ -‘না…ঠিক আছে! তুমি ওকে বোঝাও। তোমাদের এখন যে অবস্থা! মাথা কুটলেও এমন রিস্তা পাবেনা। এটা তোমার মেয়ের সৌভাগ্য! সে তার নামাজ রোজা করবে কে মানা করেছে? আমরা করি না? যত্তসব ঢং? এখন মেয়ের কথা শুনতে গেলে পরে পস্তাবে এই বলে দিলাম!’ সাহেদা দ্রুত নিজের ঘরে চলে এলেন! পৌষী বসেই ছিলো! সে জিজ্ঞেস করলো-‘কি হয়েছে মা? কোনো সমস্যা? তোমার চেহারা এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ সাহেদা মেয়ের পাশে বসে ওর হাত ধরে বললেন-‘তোকে একটা কথা বলবো….রাখবি?’ পৌষী মায়ের দিকে কিছুটা অবাক হয়েই তাকালো-‘কি কথা মা?’ -‘তোর একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে ইরার শ্বশুড়বাড়ির দিক থেকে। ওরা হয়তো দু একদিনের মধ্যে তোকে দেখতে আসতে পারে। তুই কিন্তু মানা করিস না মা!’ -‘ছেলে কি ধার্মিক মাইন্ডের? কি করে সে?’ সাহেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-‘অতোটা জানি না। আগে তাকে দেখে যাক। পরে তোর মামীকে জিজ্ঞেস করবো এসব ব্যপারে! ‘সাহেদার খারাপ লাগছিলো মেয়েকে এভাবে ডাহা মিথ্যা কথা বলতে। কিন্তু কি করবে সে? পাত্র পক্ষ আগে দেখে যাক্, পরে পৌষীকে বুঝিয়ে রাজী করানো যাবে। নইলে এখন সে সামনে যেতেই রাজী হবেনা। রাজ রাতে কিছুই খেলো না! নিজের ঘরে ঢুকে অযথাই পায়ের জুতাটা সোফার নিচে ছুঁড়ে মারলো। পাঞ্জাবিটা একটানে খুলে বেডের ওপর ছুড়ে ফেলে শুধু পাজামা পড়ে বিছানার ওপর বসে রইল! ডান হাতটা ডান হাঁটুর উপর রেখে বারবার মুঠি খুলতে আর লাগাতে লাগলো ব্যায়াম করার মতো করে। ওর চেহারায় রাগ স্পষ্ট যেন যাকেই সামনে পাবে তাকেই চিবিয়ে খাবে! এমন সময় ওদের পুরোনো কাজের লোক সাবুমিয়া ঘরে ঢুকলো-‘ভাই, খাইবেন না? আম্মায় আপনেরে ডাকতেছে!’ রাজ কটমটিয়ে তাকালো-‘আমি কিছু খাবোনা,যাও এখান থেকে!’ সাবুমিয়া কথা না বাড়িয়ে মানে মানে কেটে পড়লো! রাজ দুহাতে চুলে আঙ্গুল চালিয়ে হাতগুলোকে হাঁটুর উপর রেখে গভীর ভাবনায় ডুব দিলো! আপনমনেই মাথা নাড়লো! যেভাবেই হোক, এই ইসতিয়াকের ভেজালটা বাড়ার আগেই শেষ করতে হবে! শালা বাড়ি ভর্তি মেয়ে আর ইসতিয়াকের মায়ের চোখ গিয়ে পড়লো পৌষীর উপর? ছেলেও একলাফে রাজী। শালার চোখ গেলে দেয়া উচিত। রাগে গা কিড়মিড় করছে রাজের। তারপর কি মনে হতে হাতের কাছে সিডিটা অন করলো। হাইবিটে ধুমধাড়াক্কা বাজনা শুরু হলো! রাজ দ্রুত সেটা বন্ধ করে দিয়ে সিডি বদলে কিশোর কুমারের সিডি প্লে করলো। কিশোর কুমার তার ভরাট গমগমে সুরে গেয়ে উঠলো- ‘হামে তুমসে প্যায়ার কিতনা ইয়ে হাম নাহি জানতে…..! মাগার জী নাহি সাকতে..তুমহারে বিনা…!’ পৌষী দু হাতে কান চেপে উঠে বসলো! সাহেদা তাকালেন-‘কি রে কি হলো?’ -‘ঐ যে তোমার বেআদব ভাতিজার শুরু হয়েছে…ফালতু একটা ছেলে! গানবাজনা ছাড়া থাকতে পারেনা! এমন কেন সে?’ -‘ছি: মা, এভাবে বলিস না। ওর ভেতর ইসলামের জ্ঞান নেই বলেই তো ও এসবে আনন্দ খুঁজে পায়! ওকে সেই আদব দিয়ে তো বড় করা হয়নি, ছোটবেলা থেকে এই পরিবেশেই বড় হয়েছে, এসবেই সে অভ্যস্ত!’ পৌষী বিষন বিরক্ত হয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলো! কিন্তু কানের মধ্যে গানটা আপনা হতেই চলে যাচ্ছে…কি অদ্ভুত কথাগুলো! পৌষী ভাবতে চেষ্টা করলো, অর্থ কি এই কথার? নাকি মিনিংলেস চেঁচামেচি? ওর মনে পড়লো, আমাদের রাসুল সা. বাঁশীর শব্দ শুনলেও কান চেপেছিলেন! (চলবে)

হিয়ার মাঝে (১ম পর্ব) হিয়ার মাঝে (২য় পর্ব) হিয়ার মাঝে (৩য় পর্ব)

Comments

comments