ধারাবাহিক উপন্যাস

হিয়ার মাঝে (৩য় পর্ব)

By mumin

October 25, 2019

হিয়ার মাঝে (১ম পর্ব)

হিয়ার মাঝে (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর) সাহেদা ঘুমিয়েছিলেন বলে রক্ষে নতুবা তিনি পৌষীর হাত দেখলে সব বুঝে ফেলতেন! পৌষী বাম হাতটা ডান হাতের উপর বুলালো! কব্জির উপর পাঁচ আঙ্গুলের দাগ পড়ে গেছে! ড্রয়ার থেকে বাম বের করে হাতের উপর মেখে নিলো সে! তারপর টেবিলে গিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসলো! সেদিনের সেই দুর্ঘটনার পর থেকে পেছন বারান্দায় যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে পৌষী! সে এখন রান্নাঘরের পাশেই একটা দড়ি টাঙিয়ে নিয়েছে সেখানেই কাপড় দেয়! যদিও এই পাশটাতে রোদ তেমন আসেনা বললেই চলে! তবে এপাশটাতে মামী বা তার মেয়েরাও তেমন একটা আসেনা! ছেলে তো একদমই আসে না! বড় মামাদের বাড়িটা বিশাল বড় হওয়ায় এই সুবিদেটা হয়েছে! যে কোনো কাজের জন্য সুবিধে মতো জায়গার অভাব নেই! চারপাশে প্রচুর জায়গা পড়ে আছে! বিকেলে বা সন্ধ্যের দিকে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে পৌষী নিজের মত হাঁটাহাঁটি করে! রাতে যখন পড়তে বসেছে। তখনি নীরা উঁকি দিয়ে বললো-পৌষীপু…মা তোমাকে ডাকছে! পৌষী ঘাড় ফিরিয়ে বলল, তুমি যাও আমি আসছি! সাহেদা চোখে চশমা দিয়ে কাপড় সেলাই করছিলেন! পৌষী ওর চওড়া ওড়নাটা দিয়ে নিজেকে ভালো করে ঢেকে নিয়ে মামীর রুমের দিকে রওনা দিলো! মামীর রুমের সামনে এসে গেটে নক করে বলল-“আসবো মামী?” রাণী শুয়েছিলেন। তিনি পৌষীকে ভেতরে ডাকলেন! পৌষী ঘরে ঢুকে বলল-“আমাকে ডেকেছেন মামী? “ -“হ্যাঁ…ডেকেছি! শোন্…তুই তো কমার্সের ছাত্রী….তাই না? আমাদের মীরাকে একটু একাউন্টিংটা দেখিয়ে দিস তো মা! ও একাউন্টিংয়ে দুর্বল..! কি পারবি না? “ -“জ্বী….ইনশাআল্লাহ! ও যখন ফ্রি থাকে তখন….! “ পৌষীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল-“না না তুই ই একটা সময় বের করে ওকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে নিয়ে বসলি…কি বলিস? “ -“প্রতিদিন? “পৌষী একটু অবাকই হলো মামীর এহেন আব্দারে! -“হ্যাঁ….শুক্রবারে তো মেহমান টেহমান আসে, সেদিনটা নাহয় বাদ দে…আরে যে কোচিংটাতে ওকে ভর্তি করিয়েছি সেখানে ও তেমন একটা ইমপ্রুভমেন্ট দেখাতে পারছে না! “ পৌষী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল -“ঠিক আছে, কাল থেকে নাহয় সন্ধ্যের পর পর ওকে নিয়ে বসবো! “ বলে পৌষী উঠে দাঁড়ালো-“আমি তাহলে যাই…মামী? “ -“ওহ্…আরেকটা কথা…বলে মামী উঠে ড্রয়ার থেকে একটা নতুন জর্জেট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন-“একটু কষ্ট করনা মা…এই শাড়ীটাতে একটু ফলস লাগিয়ে দে….! কাল সকালেই এটা আমার লাগবে! কি যে ভুলো মন আমার…দেখ না। গতকাল মার্কেটে গেলাম অথচ ফলস লাগাতে ভুলে গেছি! “ -“কালই লাগবে এটা? “পৌষী অসহায় গলায় বলল! কারণ ওর পড়া এখনও বাকি আছে! মামী বললো-“তুই তোর পড়া শেষ করে রাতে এক ফাঁকে লাগিয়ে দিস রে মা..! “ পৌষী দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মুচকি হাসি দিয়ে বললো-“জ্বী, মামী! “ ….. পরদিন সকালে দশটার দিকে পৌষী শাড়ীটা মামীকে দিতে তার রুমে গেলো! সাধারণত এ সময়ে রাজ তো বটেই… ইরা মীরাও ঘুমিয়ে থাকে! তাই পৌষী স্বচ্ছন্দে মামীর রুমে নক করে ভেতরে ঢুকে গেলো! ঢুকেই নার্ভাস হয়ে গেলো! রাজ একটা টাওয়েল ঘাড়ে দিয়ে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছে। দরজা খোলার শব্দে রাজ তাকালো! পৌষী ভীষণ চমকে উঠে ঘোমটা টেনে একপাশে সরে দাঁড়ালো! রাজ বললো-“কি চাই? “ পৌষী শাড়ীটা বিছানার উপর রেখে মৃদু স্বরে বললো-“এটা রেখে গেলাম! “বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে লাগলে মামী পেছনের বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে ডাকলেন-“কে রে…পৌষী নাকি? “ -“জ্বী…মামী! শাড়ীটা রেখে গেলাম! “কাঁপা কাঁপা স্বরে কোন মতে কথাগুলো বললো পৌষী, তার কারণ রাজ মোবাইল ফেলে হা করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে! পৌষী চলে যেতে গিয়েও পারলো না। রাণী পেছন থেকে ওকে ডাকলেন-“একটু দাঁড়া, দেখে নেই। “বলে রাণী সুলতানা সন্তষ্ট চিত্তে বারান্দা থেকে ঘরে এসে শাড়ীটা নেড়েচেড়ে দেখে বললেন-“হুম, ঠিক আছে। কষ্ট দিলাম তোকে কিছু মনে করিস না আবার! “ পৌষী কোনো মতে মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেলো। রাণী নিজের মনেই বললেন- “মেয়েটা কাজ জানে..! কি সুন্দর করে ফলসটা লাগিয়েছে! “ রাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-“এটা কে মা? একেবারে সোজা তোমার বেডরুমে ঢুকে গেলো? প্রথমে ভেবেছিলাম কাজের মেয়ে টেয়ে হবে। এখন তো মনে হচ্ছে…! “ রাজের মা হেসে দিলেন -“দুর..বোকা..কাজের মেয়ে হতে যাবে কেন? তুই পৌষীকে চিনিস না? তোর সাহিদা ফুপ্পির মেয়ে সিদরাহ ! ডাক নাম পৌষী! তোর অবশ্য না চেনার কারণ আছে। কারণ তোর খুব ছোটবেলায় ওরা কয়েক বার এসেছিলো আমাদের আগের বাড়িতে! তখনো পৌষীর জন্ম হয়নি। তারপর ওরা ওর দাদার বাড়ি করাচীতে কয়েক বছর ছিলো! এর পরে দেশে আসলেও তোর বাবার সাথে আর তেমন যোগাযোগ ছিলো না। আমরাও বাসা বদলালাম। তোর বাবার সাথে মাঝে মধ্যে তোর ফুপির ফোনে যোগাযোগ হতো কিন্তু আমাদের মধ্যে আসা-যাওয়াটা একদমই ছিলো না….তাই…এসব তোদের মনে নেই!” রাজ চরম বিস্ময় নিয়ে বলল-“এটা সাহেদা ফুপ্পির মেয়ে? সাহেদা ফুপ্পিকে তো চিনি, উনিও এসেছেন? তা ওরা আমাদের বাড়িতে কেন? মানে কোনো সমস্যা?”

-“তোর ফুপা মারা যাবার পর সাহিদা ফুপি পৌষীকে নিয়ে একা বাড়িতে থাকতে পারছিলো না। সেয়ানা মেয়ে…লোকজন তো বিরক্ত করবেই। তাই তোর ফুপি ফ্ল্যাট বেচে দিয়ে আমাদের এখানে এসে উঠেছে। তোর ফুপা মারা যাবার সময় বেশ কিছু টাকার দেনাও করে ফেলেছিলো তোর ফুপি। ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা থেকে দেনা শোধ করে বাকি টাকাটা একটা ইসলামিক ব্যাংকে মেয়ের নামে রেখেছে। সেই টাকা দিয়েই ওরা চলে। পৌষী আবার একটু খুঁতখুঁতে মোল্লা টাইপ। এযুগের মেয়ে হয়েও ইসলামিক মাইন্ডের। মাথায় ঘোমটা টেনে রাখে বুড়িদের মতো। বাইরের লোকদের সামনে তেমন একটা যায়না বললেই চলে!” রাজ কোমরে হাত রেখে মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ পুরো কথা শুনলো। মনে পড়লো মেয়েটাকে গতকাল তুই বলে কথা বলেছে সে! মেয়েটা না জানি কি ভাবছে। কাজটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু স্যরি বলার তো কোনো উপায়ই দেখা যাচ্ছে না। এই মেয়ে কারো সামনে আসে না। রাজ মৃদুস্বরে বললো-“ভেরী স্যাড….শুনে খারাপ লাগলো। বাপ্পী ভালো করেছে ওনাদের এখানে নিয়ে এসেছে!” বলে রাজ কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো! রাণী ছেলেকে তাগাদা দিয়ে বললেন -“এখন তুই জলদি গোসলে যা তো! তোর না কলেজে প্রোগাম আছে। আমি দারোয়ানকে বলে দিয়েছি, ও..পানির মিস্ত্রী আনিয়ে তোর বাথরুমের কলটা সারিয়ে রাখবে ! “ রাজ বাথরুমে ঢোকার আগে হঠাৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-“মা…একটা কথা! আমি কলেজে যাবার আগে পৌষীকে স্যরি বলতে চাই কারণ আমি ওনাকে মেইড সার্ভেন্ট ভেবে সেদিন তুই তুই করে কথা বলেছিলাম! “ -“এতে স্যরি বলার কি আছে…তুই তো আর জানতি না! “রাণী স্বগোতক্তি করলেন। রাজ নিজের মাথা চুলকে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো- -“তবুও….ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না? সে আমার কাজিন, অথচ আমি তাকে মেইড সার্ভেন্ট ভেবে….নাহ্, খুব বিশ্রী লাগছে। তুমি ওকে একটু ডাকাও না তোমার রুমে! প্লিজ মা!” -“আচ্ছা…ডাকবো রে বাবা, তুই যা তো…আগে গোসল সেরে বের হ!” রাজ মনের খুশি চেপে শূন্যে ফাঁকা ঘুষি চালিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো! তারপর আয়নায় নিজেকে দেখে গুনগুনিয়ে উঠল। দ্বিতীয়বার পৌষীর ডাক পড়লে সে কলেজে যাবার অযুহাতে এড়িয়ে গেলো! পৌষির মনে হচ্ছিলো রাজ এখনো মামীর রুমেই আছে! কিন্তু পৌষী জানতো না, রাজ ব্যপারটাকে এতো গুরুত্বের সাথে দেখবে! রাতে শুতে যাবার আগে দরোজা নক হলো! পৌষী চুল আঁচড়াচ্ছিল। সেখান থেকেই মায়ের দিকে তাকালে সাহেদা উঠে গিয়ে দরোজা খুললেন। প্রথমে রাণী ঢুকলেন-“ঘুমিয়ে পড়েছিলে তোমরা? “ সাহেদা হাসলেন-“এই তো ঘুমোতে যাচ্ছিলাম! “ -“আর বলো না, তোমার ভাতিজা তো পাগল করে ফেললো তোমার সাথে দেখা করবে আর পৌষীকে স্যরি বলবে! “ পৌষী বিষয়টা বুঝতে না পেরে একটু অবাক হয়ে তাকালো! রাণী গেটের দিকে তাকালেন-“কই আয়…..রাজ? “ পৌষী বুঝতে পেরে অতি দ্রুত ওড়নাটা টেনে নিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেললো। ততক্ষণে রাজের চোরাচাহনী ওকে এক ঝলক দেখে নিয়েছে। পৌষী ঘরের এক কোণে জানালার পর্দার সামনে সরে দাঁড়ালো! রাজ ঢুকে সাহেদার পা ছুঁয়ে সালাম করতে নিলে সাহেদা দ্রুত বাধা দিয়ে বলল-“আরে কি করছো বাবা…পা ধরে সালাম করতে হয়না! কত্ত বড় হয়ে গেছো মাশাআল্লাহ! তাই না ভাবী? “ -“হমমম…তুমিতো ওকে শেষ যেদিন দেখেছিলে তখন ওর বয়েস সাত কি আট হবে! “ রাজ আন্তরিক ভাবেই সাহেদার হাত টেনে নিয়ে বললো- -“ফুপি আপনার জীবনে এতবড় একটা ডিজাষ্টার ঘটে গেলো। এই সময়ে যদি আপনার ছেলে হিসেবে আপনার কাজে না আসি তাহলে সত্যিই লজ্জার কথা! “ -“না বাবা। আমি তোমাদের পেয়ে আল্লাহর শোকর করি। আমার ভাইজান…তোমার আম্মু’ এরা আমার জন্য যথেষ্ট করছেন। রাজ একপলক পৌষীর দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে বললো-“ফুপি, আমি আরেকটা ব্যপারে “স্যরি” বলতে চাচ্ছিলাম! “ -“কেন রে বাবা…স্যরি কিসের? “ -“ইয়ে…মানে পৌষীকে বাইরের লোক মনে করে তুই বলে ফেলেছি! “ সাহেদা হেসে বললেন-“ওহ্, এই কথা। পৌষী তোর কত্ত ছোট। তুই বললেই বা সমস্যা কি! “ রাণী মাঝখান থেকে বলে উঠলেন-“আরে ও পৌষীকে নতুন মেইড সার্ভেন্ট ভেবে তুই বলে ফেলেছে। “রাজ মাকে বাধা দিতে ডান হাতটা তুলেও হতাশ ভঙ্গিতে নামিয়ে আনলো। রাজ মনে মনে কিছুটা বিব্রত হলো! মায়ের এই কথাটা বলার কি দরকার ছিলো! পৌষী কি ভাববে এখন। রাজ পৌষীর দিকে তাকানোর সাহস পেলো না। মুখ নিচু করে রাখলো। সাহেদা কিছুটা দমে গেলেন অবশ্য। রাণী একাই হাসছেন! -“তুই পৌষীকে কাজের মেয়ে ভাবলেও ভুল ভাবিস নি। মেয়ে হিসেবে ও অকাজের না। বড্ড কাজের মেয়ে।” রাজ চরম অস্বস্তি নিয়ে ফুপির দিকে তাকালো-“ফুপি, আম…আমি আসি। তোমার যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে নিজের ছেলে মনে করে ডাকবে।” সাহেদা সামান্য হাসলেন- “আচ্ছা, ঠিক আছে…বাবা।” রাজ দ্রুত বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। রাণী হেসে পৌষীর দিকে তাকালেন। সে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে। তিনি ওকে উদ্দেশ্য করে বললেন-‘দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যা তো মা!” বলে তিনিও বেরিয়ে গেলেন। রাজ বাইরে এসে মাকে আস্তে করে বললো-“মেইড সার্ভেন্ট কথাটা না তুললে কি হতো না?” -“ওমা,খারাপ কি বলেছি?” -“সেটা যদি বুঝতে তাহলে তো হতোই!” রাজ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। রাণী বাঁকা হাসি হেসে বললেন-‘তুই আমার পেটে জন্মেছিস না আমি তোর পেটে। কিছু বুঝি না মনে করেছিস?” রাজ কিছুটা আফসোস নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। পৌষি কি এটা শুনে ওর ওপর রাগ করবে? একটা কথাও তো বললো না! জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ে ওর প্রতি কোনো আগ্রহই দেখালো না! সে কারণেই কিনা কে জানে! রাজ…অন্যরকম এক আকর্ষণ বোধ করলো পৌষীর প্রতি। এ যাবৎ পর্যন্ত ও নিজেই ছিলো মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মেয়েরা ওকে দেখলে কথা বলার জন্য, বন্ধুত্ব করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে…এটাই রাজের এতদিনের অভিজ্ঞতা! কিন্তু এ কেমন মেয়ে একটিবার তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলো না! প্রতিদিনের মতো আজো সাহেদা দুপুরের খাবার পর রান্নাঘরের তদারকী শেষে নিজের ঘরের দিকেই আসছিলো। তখনি রাণী উত্তেজিত অবস্থায় ছুটে এলো-“এই…সাহেদা…দারুণ একটা খবর আছে রে…এইমাত্র পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকে ফোন এলো! ওরা আমার ইরাকে পছন্দ করেছে!” সাহেদা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রাণী গড়গড় করে কথা বলে চলছে! পরবর্তী এক ঘণ্টার মধ্যে রাণী পুরো বাড়ি গরম করে ফেললো! তার ইরার বিয়ে বিশিষ্ট শিল্পপতি ইয়াজউদ্দিনের ছেলে ব্যারিস্টার ইমতিয়াজের সাথে পাকা হতে যাচ্ছে। এই খুশিতে তার পাগল হওয়া বাকি! পাত্রপক্ষ আগামী পরশুই মেয়েকে আংটি পরিয়ে সমন্ধটা পাকা করতে চাচ্ছে। সেদিনই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হবে। রাণীর খুশি যেন ধরে না! তার পরের দিন থেকেই রাণী ভিলাতে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেলো! ইরা’কে প্রতিদিনই কাচা হলুদ মেখে গোসল করতে হচ্ছে! এরই মধ্যে ফেসিয়ালও করে এসেছে ইরা! সন্ধ্যের চা নাস্তা খাবার পরপরই সবাই মিলে মেহেদী লাগাতে বসে গেছে। ইরার বান্ধবীরাও এসেছে! ওদের সাথে বসে পৌষীও চুপচাপ ওদের মেহেদী লাগানো দেখছিলো। নীরা এবার পীড়াপীড়ি শুরু করলো পৌষীকেও মেহেদী লাগানোর জন্য। সে টান দিয়ে পৌষীর বাম হাতে মেহেদী লাগানো শুরু করলো! মেহেদী অর্ধেক লাগানো হয়েছে এমন অবস্থাতেই রাজ এসে ঢুকলো! ওকে দেখে পৌষী একহাতেই ওড়না টেনে নিজেকে ঢাকলো! পৌষীর এই লজ্জাটুকু দারুণ উপভোগ করে রাজ! আজকালকার মেয়েদের মধ্যে সব আছে কেবল লজ্জারই অভাব। তাদের সব থাকলেও নেই কেবল লজ্জা! রাজ এটা ওটা বলে মীরার সাথে দুষ্টুমী করলেও ওর চোখ কিছুক্ষণ পরপর চলে যাচ্ছিলো পৌষীর দিকে! কিভাবে ওর সাথে একটু কথা বলা যায় ভেবে পাচ্ছেনা রাজ। অবশেষে নীরাকে ধরলো! ও যেন পৌষীর সাথে একটু কথা বলিয়ে দেয়! নীরা সাফ জবাব দিলো-“কাজ হবেনা….পৌষীপু সবার সাথে কথা বলেনা! ও অনেক রেস্ট্রিকশন মেনে চলে”! রাজ তবু নীরাকে গিফটের লোভ দেখিয়ে রাজী করালো! অবশেষে নীরা রাজী হলো! কথা মতো মেহেদী লাগানো শেষে পৌষীকে জোর করে নিজের ঘরে ধরে নিয়ে এলো নীরা! ওর নতুন থ্রিপীসটা দেখানোর জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলো-“পৌষীপু…তুমি আমাকে ড্রেস সিলেক্ট করে দেবে! “ তারপর পৌষীকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে এলো ওর ড্রেস দেখাতে যেটা ওর জন্য বাবা গতমাসে ব্যাংকক থেকে কিনে এনেছিলেন ! তারপর আলমারী খুলে চারপাঁচটা ড্রেস বের করে বিছানায় ফেলল নীরা! -“বলো না পৌষিপু…কাল কোনটা পরবো? “ পৌষির বাম হাতে মেহেদী তাই বাম হাত সরিয়ে রেখে সাবধানে ডান হাত দিয়ে ড্রেস গুলো উল্টেপাল্টে দেখছিলো তখনি হঠাৎ রাজের আবির্ভাব ওকে চমকে দিলো! ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকাই ছিলো সেটাকে টেনে লম্বা করে দিলো পৌষী। রাজ নীরাকে বলল-‘তোর কাছেই একটা কাজে এসেছিলাম…যাক ওনাকেও পেয়ে গেলাম। (বলে নীরাকে ইশারা করলো)! নীরা বুঝতে পেরে পৌষীর কাছে গিয়ে বলল-‘পৌষিপু..ভাইয়া বোধহয় তোমাকে কিছু বলতে চায়…একটু শুনবে?’ পৌষির হাতে নীরার একটা ড্রেস তখনো ধরা ছিলো। সে ওটার দিকে তাকিয়েই বলল-‘জ্বী….বলুন!’ -‘মমম….একচুয়েলি আ’ম রিয়েলি স্যরি! আমি আপনাকে চিনতে পারিনি বলে সেদিন ওভাবে তুই করে….মানে….আপনি আমার ঘরটা চমৎকার সাজিয়েছিলেন….. সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ইয়ে….আমাকে ক্ষমা করেছেন তো?’ পৌষি মৃদু শব্দে বলল-‘না…ঠিক আছে। ভুলতো হতেই পারে!’ পৌষীর কন্ঠটা রাজের কাছে অন্যরকম মনে হলো। যেন শব্দটা দাঁতের ফাঁক গলে এক অদ্ভুত শব্দে অনুরণিত হচ্ছে। ওর কন্ঠটা আরেকবার শুনতে মনটা অস্থির হয়ে উঠল। রাজ বলল-“আপনার আসল নামটা যেন কি বলেছিলেন, ভুলে গেছি..! -‘সিদরাতুল মুনতাহা!’ -‘হমমম, সুন্দর নাম!’ নীরা ইশারায় চোখ দেখিয়ে রাজকে এবার যেতে বললে রাজ ডান হাত দিয়ে কপালে চাপড় মেরে চলে গেলো! পরদিন পাত্রপক্ষ আসার আগেই মামী নীরা মীরা সবাই পার্লারে চলে গেলো! নীরা পৌষীকে সাথে নিয়ে যেতে প্রচুর অনুরোধ করেছিলো কিন্তু পৌষী মানা করে দিলো। সে এতো সাজতে ভালোবাসে না। রাতে বিয়ে উপলক্ষে প্রচুর অতিথি আসলো। বাগানে লাইটিং করা হয়েছে ! খাবারের আয়োজনে ক্যাটারার নিয়োগ করা হয়েছিলো বলে বাড়িতে রান্নার কোনো চাপ নেই। মহিলারা যেন রান্নার ঝামেলায় আনন্দ করতে অসুবিধা বোধ না করে সে কারণেই আমজাদ চৌধুরী এই ব্যবস্থা করেছেন। খুব ধুমধামের মধ্য দিয়ে ইরার আংটি পরানো শেষ হলো। সবাই সবার মতো অনুষ্ঠানটা এনজয় করলেও রাজ পৌষীকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলো। নীরার পীড়াপীড়িতে পৌষী আজ শাড়ী পড়েছে। হালকা বেগুনী রঙের বুটিদার স্কার্ফ দিয়ে মাথায় হিজাব পড়েছে। চোখে কাজল আর ঠোঁটে ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক। তাতেই মনে হচ্ছিলো পৌষী অন্য কোনো জগৎ থেকে এখানে এসে পড়েছে। একবার তাকালে দুবার তাকাতে বাধ্য হবে যে কেউ! রাজ জানালা দিয়ে উঁকি মেরে খুঁজছিলো। হঠাৎ পৌষির দিকে চোখ পড়তেই নিজের জায়গাতেই স্থির হয়ে গেলো! ফাটাফাটি রকমের সুন্দর লাগছে পৌষীকে। রাজ ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করলো। হঠাৎ মনে হলো পৌষীকে নিজের করে না পেলে ও মনে হয় নিজেকে বাঁচাতে পারবে না…মরেই যাবে! নিজের এ ধরনের ছেলেমানুষী চিন্তায় নিজেই হাসলো! রাতে অতিথিরা একে একে বিদায় নিতে শুরু করলো! রাজ দাঁড়িয়ে থেকে অতিথিদের বিদায় দিচ্ছিলো! এমন সময় ইরার ফুপাত দেবর রাজকে দেখে দুঠোঁট চেপে নার্ভাসের হাসি হাসলেন। তারপর বললো-‘আপনাদের সাথে সম্পর্ক দুদিক দিয়ে মজবুত হতে যাচ্ছে এবার!’ রাজ বুঝতে না পেরে হেসে বললো -‘ঠিক বুঝলাম না।’ আমার আম্মা অনেক দিন থেকেই আমার জন্য পাত্রী খুঁজছেন। আম্মার যা খুঁতখুঁতে স্বভাব। তবে আপনার ফুপাত বোনকে দেখে পছন্দ করে আমাকে ওনার ছবি দেখালেন। এই…..আরকি! “

হিয়ার মাঝে (১ম পর্ব)

হিয়ার মাঝে (২য় পর্ব)

Comments

comments