ধারাবাহিক উপন্যাস

প্রিথি

By lazy-coder

May 07, 2016

ফারুকের কথা শুনে চমকে উঠলেন লিথম্বন। এতো ভালবাসেন পৃথিবীকে! এতো প্রেম থাকতে পারে মাটির জন্য। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তিনি প্রার্থনা করতে পারেন পৃথিবীর কল্যাণের জন্য! ‘মি. ফারুক। আপনার মতো প্রিথি প্রেমিক আরো একটা পাবো না-এটা আমার বিশ্বাস। তবে প্রার্থনা সফল হয় কি না তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। আমাদের হাতে এখনও কয়েক মিনিট সময় আছে। আসুন আপনার কাছে আরও কিছু গোপন রহস্য উন্মোচন করি। অন্তত বিদায় বেলা জেনে জান আরও কিছু সত্য। নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় এই প্রিথির ভাগ্যে কি হতে পারে তা জেনে যাওয়ার অধিকার আছে আপনার। তবে বেশি বলতে হবে না। অনেক কিছু জানেন। তবুও বলছি। আমরা এভাবে লোভ দেখিয়ে ট্রনিকটন গ্রহের সব প্রাণীকে ধ্বংস করেছিলাম। এখন সে গ্রহের বাসিন্দা আমাদের সম্প্রদায়। রাজত্ব আমাদের। মি. ওমর ফারুক। ওই একই ভাগ্য বরণ করতে হবে আপনার প্রিয় প্রিথিকে। আমাদের হবে প্রিথি একদিন আর আমরা এখানে রাজত্ত্ব করবো। আরেক ট্রনিকটন হবে সবুজ-শ্যামল এই গ্রহ। ধ্বংসের বীজ এর মধ্যে বোনা হয়ে গেছে মি. ফারুক। যে ভয়ঙ্কর জীবাণুর সন্ধান আপনি পেয়েছেন। এটাতে প্রিথির ধ্বংসের শুরু হবে। একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে পানি থেকে বাতাসে এটা মিশে একাকার হবে। ধীরে ধীরে রসকষহীন করে তুলবে প্রকৃতিকে। হিরোশিমা একটা নয়, প্রিথির প্রতিটি কোণে কোণে তৈরি হবে হিরোশিমা-নাগাসাকি। তারপর কি পরিণতি হবে সেটি আশা করছি বোঝতে পারছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সেই দৃশ্য দেখে যেতে পারছেন না আপনি। তবে আকাশে থেকে আপনার আত্মা সব কিছু দেখবে, এটুকু বিশ্বাস রাখছি।’ একটু বিরতি দিলেন লিথম্বন। ফারুকের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন। কিন্তু ফারুক এসব কথা শুনে কষ্ট পাচ্ছেন। লিথম্বনের একেকটি কথা যেন তার বুকে তীরের মতো গিয়ে বিঁধছে। লিথম্বন বিষয়টি টের পাচ্ছেন। তাই তিনি ওমর ফারুককে কষ্ট দেয়ার জন্য এসব কথা বলছেনও। ‘একদিন এই গ্রহে আমরা রাজত্ব করবো। ট্রনিকটনের মানুষ এসে এখানে বসতি স্থাপন করবে। এটা হবে আমাদের নিজস্ব গ্রহ। আমাদের সম্প্রদায়ের মালিকানা হবে আপনি যে গ্রহ নিয়ে গর্ব করছেন। আর যার প্রেমে নিজেকে বলি দিচ্ছেন মি. ওমর ফারুক। সেটা শুধু এখন সময়ের ব্যাপার। আমরা যেখানে একবার পৌঁছে যাই, উদ্দেশ্য সফল না করে সেখান থেকে ফিরি না। এখান থেকেও খালি হাতে ফিরবো না। আপনাকে দিয়ে হাত ভরানো শুরু হবে। হেঁ, আরেকটা কথা। অর্থাৎ আপনাকে আমাদের পরিচয় জানিয়ে দিই। এটা কিন্তু অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।’ একথা শুনে মুখ তুললেন ওমর ফারুক। সরাসরি তাকালেন লিথম্বনের দিকে। চোখে তীক্ষè দৃষ্টি। কোন কথা বললেন না। অপেক্ষায় থাকলেন তার কথা শুনতে। কি পরিচয় দেবেন লিথম্বন? যা জানেন তার বাইরে কি নতুন কোন পরিচয় আছে তার? যা জানেন তা কি ভুল? ‘আমি তো লিথম্বনই। সেটা জানেন। কিন্তু সাথের যে দু’জন সঙ্গীকে আপনারা আমার সাথী বলে জানেন,’ পালা করে তাকালেন তাদের দিকে। ওমর ফারুকও তাদের দেখে নিলেন এক পলক। আবার যখন লিথম্বনের দিকে চোখ ফেরালেন, তখন তিনি বলতে শুরু করেছেনÑ ‘আসলে তারা কেউই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ নয়। আমার একান্ত অনুগত দুটি সত্ত্বা। দেখতে হয়তো অবিকল মানুষ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে না?’ কথার এই ফাঁকে ওমর ফারুক তাদের আবার দেখে নিলেন। ওরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। একদম স্থির দাঁড়িয়ে। হেঁ, বোঝার উপায় নেই যে, এরা রক্তে মাংসের মানুষ নয়। ‘এরা যন্ত্র। রোবট।’ ওমর ফারুক ওদের দিকে তাকিয়ে শুনলেন লিথম্বনের শেষ কথা। নিখুঁত মানুষের মতো দেখতে। না জানলে কোনভাবে ধরার উপায় নেই, এরা রোবট। তিনি ভাবলেন, আমাদেরও রোবট আছে। কিন্তু তারা এতো নিখুঁত নয়। এখনও হাস্যকর ভঙ্গিমায় থেমে থেমে চলে। দেখলে বোঝা যায় তারা যে যন্ত্র। তাকালেন লিথম্বনের দিকে। ‘বিশ্বাস করতে নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে, এরা প্রাণী নয়। এটা শুধু আপনি নয়। যে কেউ শুনলে তাই ভাববে। তবে আপনার নিশ্চয় মনে আছে, মনে থাকার কথা মি. ফারুক। ওরা আজ পর্যন্ত আপনার বা আপনাদের কারও সাথে কথা বলেনি। আপনি দেখেননি কোন কিছুতে ওরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে বা কথা বলতে। এমন কি আমার সাথেও তারা একটি কথা বলেনি আপনাদের সামনে। এদের কাজ এটা নয়। এদের কাজ আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা। ওরা প্রত্যেকে একেকটা স্যাটেলাইট সার্কিটও। তারা যা দেখে তা ট্রনিকটনে পর্যালোচনা হয়। সেন্ট্রাল সিকিউরিটি সার্ভিসের উপগ্রহ ক্যাম্প প্রতিটি মুহুর্ত ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণ করে। এরা সামরিক রাডারের মতো নিরাপত্তাজনিত হুমকিগুলোর সিগনাল সংগ্রহ করে। দেখেও আগে পিছে। আপনি একবার এভাবে ধরা পড়েছিলেন। মনে আছে শিয়াল দেখা কিংবা আপনার লুকিয়ে যাওয়া। সেই পূবাল পর্বতের কথা।’ থামলেন তিনি। এবার বুঝলেন কেন ধরা পড়েছিলেন তিনি। কেন তারা টের পেয়েছিল তার উপস্থিতি! ‘মি. ওমর ফারুক। আমার প্রতিটি কথা এখন শতভাগ সত্য। জানেন, আমরা একটা মিথে বিশ্বাস করি। আর সেটা হলো, মৃত্যু পথযাত্রীর কাছে কিছু গোপন করতে নেই। লোকাতে নেই। মিথ্যা বলতে নেই। তা হলে আমাদের মৃত্যুর সময় মিথ্যে শুনে মরতে হবে। এটা আমরা পছন্দ করি না, চাইও না। জীবনের একটি সময়ে মিথ্যে থেকে দূরে থাকি। সেটি হলোÑ মৃত্যু।’ কয়েক সেকেণ্ডের বিরতি দিলেন তিনি। এরপর আবার বললেন, ‘ধন্যবাদ মি. ফারুক। আমার মনে হয় এসব কথা শুনে এই মুহূর্তে আপনার মনে নেই যে আপনি একজন মৃত্যুপথযাত্রী। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন।’ তার কথা শুনে ভাবলেন ফারুক। হ্যাঁ, তাই তো! ভুলেই গেছেন দিব্যি। সঙ্গে সঙ্গে আবার ভয় চেপে ধরলো তাকে। শিরায় একটা বিদ্যুৎ চমকে গেলো মুহূর্তে। একটু আগে যে লোকটা ছিলেন ভাবলেশহীন, তিনি এখন ঘামছেন! ‘আর দুই মিনিট। তারপর আপনার অহংকারের দম্ভ চুর্ণ হবে।’ বায়ে তাকালেন সঙ্গীর দিকে। ‘মুখোশ পরাও।’ নির্দেশ পেয়ে সে এগিয়ে এলো। ওমর ফারুক তাকালেন তার দিকে। এক পলক। সামনের দিকে চোখ নিলেন তিনি। যেখানে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত সবুজ মাঠ। গাছের পাতায় তৈরি হয়েছে এই সবুজ অরণ্য। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ। আর উপরে নীল আকাশ। আকাশে মেঘের সীমারেখা পড়েছে এখানে-ওখানে। কোণে কোণে মেঘ জমেছে। সুর্যের আলো পড়ে কি অপরুপই না দেখাচ্ছে। তার মাঝে পাখির পালের মতো উড়ছে ছোট-বড় আকাশযান। একটা সীমানায় একই গতিতে উড়ে যাচ্ছে তীব্র বেগে ক্ষুদ্র যানগুলো। কেউ নিজের রুট ছেড়ে এলোমেলো চলছে না। এর মাঝে পাখিও উড়ছে। সর্বত্র বড় ব্যস্থতা। শুধু তার মাঝে কোন ব্যস্ততা নেই। তাকালেন সবুজ অরণ্যের দিকে। আজ বড় বেশি মায়া লাগছে তাকে। খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে এই সবুজ অরণ্যকে। নিজের ক্ষুদ্র যান নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে মন চাইছে। কিন্তু এখন চাইলেও আর হবে না। কোন দিন আর এই স্বপ্ন পূর্ণ হবে না তার। তিনি যে বন্দি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন অপেক্ষা শুধু শেষ নিঃশ্বাসটুকু ফেলার। রোবট দেরি করলো না। সামনে এসে পাশে রাখা ইটের উপর উঠে নোয়ে এলো ওমর ফারুকের দিকে। তিনি অপলক তাকিয়ে আছেন সামনের সবুজ পৃথিবীর দিকে। চোখের শেষ তৃষ্ণা মেটালেন এভাবে অপলক তাকিয়ে থেকে। নিজের অজান্তে তখন চোখ থেকে বেয়ে পড়লো একফোঁটা পানি। বড় মায়া হলো পৃথিবীর জন্য। দেখলেন একটি নীল রঙের পাখি উড়াল দিয়েছে। তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। পাখিটি ডানা ঝাপটে আকাশের দিকে উঠছে। তারপর… না, আর দেখা হলো না। বামপাশ থেকে একটি কালো মুখোশ তার চোখ ঢেকে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে গেলো ওমর ফারুকের পৃথিবী। মুখোশ পরিয়ে চলে গেলো সে। ডানে থাকা লোকটির হাতে রশি। ওমর ফারুকের পায়ের নিচে থাকা ইটের একটি সারি বেঁধে সেই রশির সামনের অংশটা তার হাতে রাখা। টান দিলে ইট পড়ে যাবে। ঝুলে যাবেন ওমর ফারক। কার্যকর হবে ফাঁসি। ‘মি. ফরুক।’ লিথম্বনের কণ্ঠ শুনলেন তিনি। কান খাড়া তার দিকে। ‘জনমের মতো বিদায় আপনাকে।’ আর কোন কথা বললেন না। কয়েকপা সরে সাথী রোবটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। আর মাত্র এক মিনিট। ঠিক ষাট সেকেন্ড পর নিভে যাবে তার জীবনের আলো। শেষ হবে এক বিখ্যাত, আপোষহীণ জগত বন্ধুর অধ্যায়। কিন্তু কেউ টের পাবে না। কেউ জানবে না। সবার অজান্তে তিনি চিরবিদায় নেবেন জগৎ-সংসার থেকে। শুধু পৃথিবী আর তার নাগরিকদের ভালোবাসার মূল্য দিতে গিয়ে তাকে এই পরিণতি ভোগ করতে হবে। শেষ সময়েও ভাবলেন তিনি তাদের কথা। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন, ‘পৃথিবী। আমার প্রিয় পৃথিবী। আমি পারলাম না তোমার সন্তানদের জন্য কিছু করতে। আমাকে ক্ষমা করো পৃথিবী। আমাকে ক্ষমা করো হেঁ।’ থেমে এলো তার কণ্ঠ। আর কিছু শোনা গেলো না। নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। শেষ সেকেন্ডের অপেক্ষায়। কাঁপছে ওমর ফারুকের পুরো শরীর। রশির দিকে তাকালেন লিথম্বন। তারপর ওমর ফারুকের দিকে। কি ভাবছেন তিনি? তার এই ভালোবাসা কি পৃথিবী দেখছে? তার এই ত্যাগ কি সৃষ্টিকর্তা দেখছেন? তার ভালোবাসার প্রতিদান কি পৃথিবী দেবে? কিভাবে দেবে? তার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার সময় কি পুরো পৃথিবী সমস্ব^রে বিচ্ছেদের কোন কোরাস গাইবে? ওমর ফারুকের চোখে তখন পৃথিবীর ছবি ভাসছে। এই ছবিটা তার চোখ থেকে সরছে না। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আর কখনও তারে দেখবেন না। আর কোন দিন হাঁটবেন না তার বুকে। মাটিতে পড়বে না পা। এবার হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি। অনেক জোরে বললেন, ‘পৃথিবী, আমি তোমাকে ভালবাসি। অনেক বেশি ভালবাসি।’ এই উচ্চারণটা যেন প্রতিধ্বনিত হলো সামনের সবুজ অরণ্যে। ছড়িয়ে পড়লো সামনের বিশাল প্রান্তরে, উপরের সুবিশাল আকাশে। সেই আওয়াজটা আবার যেন ফিরে এলো তার কাছে। তার কানে এসে যেন পুরো পৃথিবী একটি স্বত্ত্বা হয়ে ফিসফিস করে বললো, কানে কানে যেন বললো আমিও তোমাকে ভালবাসি। আর মাত্র দশ সেকেণ্ড। আবার চরম নীরবতা। কালো মুখোশের সামনের রঙ হঠাৎ পাল্টে যেতে লাগলো। দূর থেকে দেখে মনে হলো ওই জায়গাটা ভেজা। হ্যাঁ, ওমর ফারুকের চোখের পানিতে সামনের দিকটা ভিজে গেছে। পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে। ভীনগ্রহের বিজ্ঞানী এ্যালিয়েন লিথম্বনের চোখে ধরা পড়লো এই পরিবর্তন। সেদিকে তাকিয়ে তিনি মুচকি হাসলেন। কিন্তু এ মুহূর্তে মুখোশের ভেতরের চেহারাটা কেমন? নির্ভিক? অবিকল আগের মতোই? নাকি বিমর্ষ? তা অবশ্য বোঝা গেলো না। এসময় শোনা গেলো আবার ফিসফিস আওয়াজ। ওমর ফারুকই বললেন, ‘খোদা, পৃথিবীকে তুমি রক্ষা করো।’ ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলছে। কোন ঐশ্বরিক কিছু না ঘটলে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানীর জীবন অবসানের জন্য সময় বাকি আছে আর মাত্র দুই সেকেণ্ড! সমাপ্ত।

Comments

comments