ধারাবাহিক উপন্যাস

নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

By mumin

November 28, 2017

(পূর্ব প্রকাশের পর) ময়না বিবি কী জানি ভাবিয়া কহিলেন-কাম নাই বাপু মাইর-ধইর কইর‌্যা। শ্যাষে দোষটা অইবে আমার। মুহেযতো পারো, কইয়া দ্যাখ আগে। আহার সমাপ্ত করিয়া সফি উঠিয়া গেল। মায়ের উপদেশে হউক আর যে কারণেই হউক মাসুদাকে সে মারধোর করিল না। তবে তাহার চইতে বেশি। অকথ্য অশ্রাব্য গালা-গাল দিলো। জাতু তুলিয়া বলিতেও ছাড়িল না। সহ্যেরও সীমা থাকে। সীমা অতিক্রম করিলে নীরব থাকা যায় না। কিন্তু আশ্চর্য্য অপূর্ব ধৈর্য্যগুণে মাসুদা সকল গঞ্জনা নীরবে সহিল। একটি কথাও সে কহিল না। ময়নাবিবি খুব খুশি হইলেন বউকে গালি শুনাইয়া। কিছুদিন পরের কথা। আমাদের পূর্বোল্লেখিত হালিম একদিন কাজীর গাঁয়ে অর্থাৎ সফিদের বাড়িতে আসিল। প্রকাশ থাকে যে, সফিদের বাড়িতে দুইটি দৃহস্থের বাস। একটির খবর আমরা জানি। অপরটি তাহার চাচা। হালিম কার্য্যােপলক্ষ্যে সেই ঘরেই আসিয়া ছিলো। হালিম সফির চাচার সহিত সামনের বারান্দায় বসিয়া কতা-বার্তা কহিতেছিল। পাশাপাশি ঘর বলিয়া মাসুদা তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া চিলিন যে কে কথা কহিতেছে। একেতো তাহার বাপের বাড়ির পাশের লোক, তায় তাহাদের সহিত দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা আছে, তদুপরি সে তাহার কিছুকালের শিক্ষক-মাসুদা ভাবিল, তাহার সহিত আলাপ করা এবং তাহাকে অভ্যর্থনা জানান উচিৎ। সফি বাড়িতে থাকিলে সে তাহাকেই বলিত হালিমকে এঘরে ডাকিতে। অগত্যা সে নিজেই ও-ঘরে যাইয়া সফির চাচাতো ভাইকে দিয়া তাহাকে কহাইল যে, যেন সে তাহাদের ঘরে একবার আসে। তাহার আরও কারণ এই ছিলো যে, উহার নিকট হইতে পিত্রালয়ের শুভাশুভ খবরও পাওয়া যাইবে। হালিম সফিদের ঘরে আসিল। মাসুদা তাহাকে বসিতে বলিয়া পান-তামাক দিলো। তাহাদের এবং ওর পিত্রালয়ের সংবাদাদি জিজ্ঞাসা করিল। এমনি মামুলি ধরনের আলাপ সারিয়া হালিম বাড়িতে ফিরিবার জন্য গাত্রোত্থান করায় সে তাহাকে অদ্যকার মতো থাকিয়া যাইতে বলিল। কিন্তু হালিম নানান ওজর দেখাইয়া এখান হইতে গৃহাভিমুখে যাত্রা করিল। ময়না বিবি ঘরেই ছিলেন। তিনি সকল কিছু লক্ষ্য করিলেন। বউযে অন্য শরীকের ঘরে যাইয়া বেগানা পুরুষকে ঘরে ডাকিয়া আনিয়া তাহার সহিত কথা কহিয়াছে, তাহা তাঁহার বরদাশত হইল না। বউয়ের বাপের দেশের লোকের সামনে কিছু বলিতেও পারিতে ছিলো না। যেমনই হালিম এখান হইতে প্রস্থান করিল, এমনি তাহার মুখছুটিল যেন বল্লার বাসায় কেহ ঢিল ছুড়িয়াছে। মাসুদাকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন-বলি তোমার কী সাহস কও দেহি? রাস্তার পর-পুরুষ ঘরে আইন্যা ফাসুর ফুসুর করবা-এডা তোমার বাপের বাড়ি না। মাগো মা, চউক্কের উপরে এতো পারো, চউক্কের আড়ালে অইলে পার কদ্দুর? মাসুদা কহিল-দোষটা কী করলাম। বাপের বাড়ির পাশের লোক। ডেকে একটু খোঁজ-খবর নিলাম। তাকে কী হয়েছে? ময়না বিবি কর্কশ কণ্ঠে কহিলেন-হউক তোমার বাপের দেশের লোক। হেইজন্যা হের লগে কথা কইতে অইবে নাহি? হে পর-পুরুষ না? ঘরের ঝি-বউর অইরহম ছেনালি-পনা করোনডা কোন শাস্তরে আছে?

মাসুদা কহিল-তিনি আমাদের পাড়া-পড়শী, আত্মীয় এবং তার কাছে পড়াশুনাও করেছি। ছোটবেলা থেকে তার সংগে কথা কয়ে এসেছি। এখন যে তাতে দোষ হবে, তা বুঝিনি। আপনি সবকিছুতেই দোষ দেখেন। ময়নাবিবি অতিশয় রাগান্বিতা হইয়া কহিলেন-হ, আমিতো হগোল কিছুতেই দোষ দেহি। আমার তো শুদ্দোকতা কইতে পারি না, লেহাপড়া জানি না। ভাবো নাহি যে কিচ্ছুই বুঝি না? তোমাগো ইসারা, চউক-টিব্রী না বোঝলেও সিদাসিদি ব্যাপারডা বুঝি। তুমি আর চোহে আংগুল দিতে আইওনা। আমাগো চাইরকালের তিনকাল চইল্যা গ্যাছে। এই বয়সে কতো দ্যাখলাম। মাছিল প্যাটকামড়ী বোঝতে মোগো বাহী থাহেনা, বোঝলা? মাসুদা রাগ সামলাইতে পারিল না। অহেতুক এইসব ইজ্জত হানিকর কথা শুনিয়া কাহার না রাগ হয়? সে প্রতিবাদ করিয়া বলিল-অইসব কথা আর বলবেন না। গাল-মন্দ দিতে হয়, যতোখুশী দিতে পারেন। কিন্তু মিছামিছি মান-মারা কথা কইতে বারণ করি। ময়নাবিবি চটিয়া গেলেন। কহিলেন-চউক্কে দ্যাহা কতা কমু হেডা ট্যাহাইবে কেডা? কার ভয়ে মুখ বুইজ্যা থাকমু? আমার সোম্সারের ভাত খাইয়া, আমার ঘরে বইস্যা পর-পুরুষ লইয়া ঢলাঢলী! বেপসী গোনাহান চলবা, হেডা এ-বাড়িতে খাটবেনা। মাসুদা রাগিয়া কহিল-আপনাকে আবার বারণ করি। তিনি আমার শিক্ষক। তার সাথে আমাকে জড়িয়ে অইসব অকথা-কুকথা কইবেন না। ময়নাবিবি মুখ খিচাইয়া কহিলেন-ওহ্! আবার দ্যাহো চো পারজোর কতো! হাস্তরে কয়-দাউরের চোপায় বল। তোমার চোপারে ডরায় কেডা হুনি। কাইল আইয়া আইজই এদ্দুর মাতুব্বরী খাডাইতে চাও? হেডা গোছাইয়া থোও মোনে! রায়বাজাইর‌্যা কড়উ, ঝালকাইড্যা কপসী-এসোমসারে লাগবে না। মাসুদা অতিশয় রাগান্বিতা হইয়া কড়া কথা কহিতে যাইবে এমন সময় সফি আসিয়া গৃহে প্রবেশ করিল। কিছু-কিছু সোর-গোল তার কানে গিয়াছিল। তাই মাকে জিজ্ঞাস করিল-ব্যাপারটা কী? ময়নাবিবি হাউমাউ করিয়া কহিল-আর কমু কী বাছা, তোর বউ জাত-মান কিছু থুইবে না। সফি কহিল-ক্যানো, কী অইলো আবার? ময়নাবিবি কহিলেন-অইছে না? কী বাহী আছে অওমের? পরের ঘরে যাইয়া পর-পুরুষ ঘরে ডাইক্যা আইন্যা হের লগে পাটুর-পুটুর কথা কয় তোমার বউ। আর, কী করবে, কও? সফি কহিল-কার লগে কথা কইছে? লোকটা কে, নাম কও, শুনি? ময়নাবিবি কহিলেন-আর, বউর বাপের বাড়ির পাশের লোক, নামডা বুঝি হালিম। চিনলিতো? হে নাহি ওর ছোডকাইল্যা নাগর। হেই লইগ্যা তোর চাচার ঘরে যাইয়া হ্যারে বোলাইয়া আইন্যা, তারপরতো রং-রসের কতো কতা কইল। সফি শুনিয়াই ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইল। কহিল-তাই নাকি? এদ্দুর সাহস? আমার ঘরে পর-পুরুষ লইয়া ফস্টি-নস্টি। এখন তো বোঝলাম-বাপের বাড়িতে গেলে অতো এসনো-সাবান হারামজাদীরে কেডা কিন্যা দ্যায়-ক্যান দ্যায়? আচ্ছা, তারপর কী অইলো? ময়না বিবি কহিলেন-হ্যারপর হে বেডা চইল্যা গ্যালে বউরে কইলাম ভালো মুখে যে, এ-সব কাম ভালো না। ঝি-বউর এরহম পর-মানুষ ডাইক্যা আইন্যা কতা কওন হাজেনা। হেই কতায় বউ আমারে যে-সব কতা হুনাইলে হ্যা তোরডে কী কমু? আমার কপাল, হেই লইগ্যাই খোদায় এমন ব্যাবাইজ্জা বউ জোডাইয়া দেছে! সফি স্বগতোক্তিতে কহিল-হ, বোঝলাম। দেখি হারামজাদী কোথায়।… … … এই বলিয়া সে বারান্দা হইতে অন্ধরে ঢুকিল। মাসুদা এখন এককোণে গুশা হইয়া বসিয়া ছিলো। সফি তাহাকে দেখিবামাত্র পেছন হইতে সজোরে দিলো এক লাথী। ঠাল সামলাইতে না পারিয়া উবু হইয়া পড়িয়া গেল। তারপর সে তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া জাগাইয়া তুলিয়া দমাদম কিল শুরু করিল। মারের সহিত সমানবেগে গালি বর্ষণ ও চলিতে লাগিল। ময়নাবিবি বারান্দা হইতে নড়িলেন না। সফির চাচী ওই ঘর হইতে ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে থামাইলেন। সফির যেন কিলাইয়া সাধ মেটে নাই। আক্রোশে গর্জা হইতে লজাই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সোরগোল টের পাইয়া নিকট প্রতিবেশী কতিপয় বর্ষিয়সী মেয়েলোক আসিয়া জুটিলেন। ময়নাবিবি তাঁহাদিগকে বসিতে বলিয়া পানের জোগাড় করিয়া দিলেন। এক প্রতিবেশিনী হামিদের মা কহিলেন ময়না বিবিকে লক্ষ্য করিয়া-চোটপাট টের পাইলাম কিসের কওতো, বুজান? ময়নাবিবি লুকাইবার চেষ্টা করিলেন। বলিলেন-কই, কিসের চোট-পাট হোবলা? কিচ্ছুনা। মরিয়মের মা কহিলেন-কিচ্ছুনা কইলে মানমু ক্যা? বাড়ি বইস্যা আমরা খুব যে চোট-পাট, দুমদাম শব্দ হোনলাম। হেডা কি ভুল হোনলাম? মাসুদা ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছিল। তাহা তাঁহাদের কানে গেল। এবার হামিদের মা কহিলেন-তয় বউ কানছে ক্যা? ব্যাপারডা কী? (চলবে)

Comments

comments