ধারাবাহিক উপন্যাস

নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

By mumin

August 03, 2017

চার. মাসুদার প্রতিবেশী এবং দূর সম্পর্কের আত্মীয় হালিম কলেজে পড়ে। ছুটিতে সে বাড়ি ফিরিয়াছে। একদিন বৈকালবেলা গাঁয়ের কতিপয় সমবয়সী তরুণযুবক তাহার পাঠাগারে আসিয়া জুটিল। চাপা স্বরে নানাবিধ আলাপ জুড়িয়া দিল। মুখরোচক আলাপ। মেয়েদের সম্পর্কে আলাপই বেশি। আজকালকার ছেলে-ছোকরারা উহাতেই আরাম বোধ করে। বন্ধু-বান্ধব জুটিয়া গেলে অইসব আলোচনায়, যদিও লভ্য কিছু নাই, একদম মশ্গুল হইয়া যায়। ইহা এমনই বিষয় যে, ইহাতে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণ হয়। রোগ-শোক-ব্যথা সবকিছুই ভুলাইয়া অন্তর্মধ্যে খুশির ফোয়ারা বহাইয়া দ্যায়। আসলে ইহারা বখাটে, অলস, কাণ্ডজ্ঞানহীন। অনর্থক অশালীন গাল-গল্প করিয়া মনে মনে উত্তেজিত হইয়া মানসিক পীড়ার উৎপত্তি ঘটায়। ফলে, মূল্যবান সময়ের অপচয় হয়। তাহা ব্যতীত ইহারা আর কিছুই পায় না। পণ্ডিতেরা ইহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেন-(অলস মস্তিষ্ক, শয়তানের কারখানা।) ‘Idle brian is Devile’s workshop.’ ফলত: কথাটা তা-ই। এইসব কু-কথা, কু-চিন্তায় তাহারা উত্তেজিত হইয়া পথভ্রষ্ট হয়, কু-কর্ম সম্পাদনের উপায় আবিষ্কারে লাগিয়া থাকে। শেষটায়, দিনে-রাতে শুধু ফন্দি-ফিকিরে সময় কাটায়। দিনের কর্মপণ্ড হয়, রাতের ঘুম নষ্ট করে। এইসব বাজে আলোচনাই তাহাদিগকে কালে ধ্বংসের মুখে ঠেলিয়া দ্যায়।… … … প্রসংগত উল্লেখ্য যে, আমাদের হালিম সে-জাতের ছেলে নয়। তবু পাড়া-প্রতিবেশী ছেলেরা আসিয়া জুটিয়াছে তাহার পাঠাগারে, তাড়াইবে কী বলিয়া? তাই অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ওদের আলাপ তাহাকে শুনিতে হইতেছে। কিন্তু সে উহাতে যোগ দিলো না। এক্ষণে তাহাদের আলাপ-আলোচনা শোনা যাক। রহিম নামক ছোকরা এক ফাঁকে বলিল-কী কবো ভাই, – ‘একলির পাকা আম দাঁড়কাকে খায়, মনোজ্ঞ গোলাপকুঞ্জে ইঁদুর ঘুমায়! মজিদ কহিল-খাঁটী কথা বলেছিস্ ভায়া! আর- মধুতে সাঁতার কাটে গুবরে পোকায়, এতো বড়ো অনাচার সওয়া কিগো যায়? এবার নুরু সকৌতুকে আবৃত্তি করিল- বে-রসিক লাগিয়া যে রস ভাণ্ড তোলা, রসগোল্লা খায় চাটি’ অই র্অসোলা! এবার রহিম পুন: বলিল-আচ্ছা-আচ্ছা, বলেছিস্ সাচ্চা। তারপর- বেহেস্তের হুরী-পরী কালোভূতে পেয়ে লক্ষ্মীছাড়ালো তার দ্যাখো চেয়ে চেয়ে! হাসির লহর বহিল। সবাই কৌতুকের হাসিতে লুটোপুটি খাইতে লাগিল। হালিম শংকিত মনে কহিল-থামতোরা। বাড়ির ভিতরে কেউ শুনতে পেলে রাগ করবে। কী হাসাহাসি শুরু করে দিলি নির্বোধের মতো? রহিম স্মিত কণ্ঠে কহিল-হাসি কি আর সাধে? বরাত-বরাত! অমন সুন্দরী আপটু-ডেট মেয়েটা যে কালোভূতের জন্য বরাদ্ধ করা ছিলো, তা’ কি স্বপ্নেও কখনো ভেবেছি? ফস্ করিয়া মজিদ বলিয়া উঠিল-শুধু কি কালো ভূত? যাকে বলে গবেট, গোবরগনেশ-ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না, তাই। হালিম বিস্মিতভাবে বলিল-কাদের কথা বলছিস্ তোরা? নুরু কহিল-তুমি বুঝি এখনো শোনোনি? মাসুদার যে এরই মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো কাজীর গাঁয়ের সফির সংগে। অমন সুন্দরী, আধুনিকা মেয়ের সফির মতো আল্কাত্রা-নিন্দিত রূপবান বেরসিক, ব্যাক্ওয়ার্ড ছেলের সাথে কোনো দিক দিয়েই কি মানান-সই হয়? তাই বলছিলাম। হালিম কহিল-সে জন্যে তোমার মাথা ঘামাতে কেনো? যার ব্যাপার, সে-ই সেটা বুঝবে। মজিদ কহিল-কও তো দাদা, মন যে বারণ মানে না। আমরা এতো কন্দর্প-নারায়ণের গাঁয়ে থাকতে, পাত্তর আর খুঁজে পেলে না? শেষটায় মুক্তার মালা উঠল গিয়ে কদলীপ্রিয় জীবটির গলায়? রহিম কহিল-কী কবো ভায়া, শুধু রসনা শিক্তকরাই সার হলো! আমার কপালে সিঁকে ছিঁড়ল না। হালিম বিরক্তির সহিত কহিল-তোরাতো বড্ড এঁচোড়ে পাকা হয়ে উঠেছিস। এখনো স্কুলের চৌকাঠ ডিংগাতে পারলিনে, এরই ভিতরে অইসব বাজে চিন্তায় সময় নষ্ট করছিস। মানুষ হতে চাস্নে? মজিদ কহিল-মানুষতো হয়েই জন্মেছি। লেখাপড়া করছি বলে কি একটু-আধটু প্রেম-চর্চাও করতে নেই। হালিম বলিল-বাপুহে, কবি গুরু বলেছেন- ‘প্রেমের গানে বাঙালির দূর্দশার শেষ!’ নুরু কহিল-ওসব আহাম্মুকের কথায় কান দিতে নেই। এযুগে আমরা বাঁচি ক’বছর? কাজেই, এক সংগে সবদিক রক্ষা করে চলতে হবে। নইলে, আখেরে পস্তিয়ে মরতে হয়! রহিম কহিল-বুদ্ধিমানের মতো কথা-ই বলেছ, ভাই। দুনিয়ায় সব-কিছু সুখ-শান্তি সময় মতো পাওয়া চাই। লিখতে-পড়তে বুড়িয়ে গিয়ে কী ফল ফলবে তাতে? মজিদ কহিল-নূরু ভাই করেছে, যাকে বলে কাজের কাজ। চট্ করে কেতাবগুটিয়ে বিয়ের টোপ গিলেছে। বেশ আনন্দে কাটাচ্ছে। আমরাই শুধু বোকামী করছি। নূরু কহিল-আরে বাপু, বিয়ে যদি শীঘ্র করতে চাও, তবে ‘আট অফ্ বিয়িং ম্যারেড্’ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল হও। রহিম আশ্চর্য্য হইয়া প্রশ্ন করিল-‘আট অফ্ বিয়িং ম্যারেড্’ মানে? হাসিয়া নূরু কহিল-মানে, বিবাহিত হবার কলা-কৌশল বা উপায়। সেগুলি জানা দরকার? বুঝলে? মজিদ উৎসাহিত হইয়া কহিল-বল্না, শুনি? নূরু কহিল-শোন্ তবে। বিয়ে যদি করতে চাও, তবে খড়াব করতে হবে। কেননা, এই ১৮/১৯ বছরের ছেলে-ছোকরাকে কখনো বিয়ে দিতে চাইবে না অভিভাবকেরো। কাজেই, তোমাকে খড়াব করতে হবে। তবেই লাভ। রহিম প্রশ্ন করিল-লাভটা কোথায়, তাতে বললে না। একটু বুঝিয়ে বলো-না শুনি? নূরু কহিল-লাভটা বুঝলে না? ধরো, তুমিতো কোনো মেয়ের সাথে খড়াব করলে, ক্রমে-ক্রমে সেই মেয়ের এবং তোমার অভিভাবকদের কানে উঠল সে কথা। তখন যা করণীয় তারাই করবে। তোমার কিছু বলার আবশ্যক করবে না। তারাই মান বাঁচাতে যে চিকিৎসার আবশ্যক, সে ব্যবস্থা চুপে-চুপে করেই ফেলবে। বুঝলে তো? এই আমার কথাই বলি। বিয়ে করার ইচ্ছে হলো, কিন্তু অভিভাবকের কাছে বলতে লজ্জা। আর তারাতো বিয়ে দেবার নামটিই মুখে আনে না। খুব যে শেয়ানা হয়ে পড়েছি, সেটা বুঝাই কী করে? অগত্যা প্রেম করতে হলো। খুঁজে পেতে ঝুটিয়ে নিলাম তোদের ভাবীকে। লিখতে শুরু করলাম হরদম চিঠির পরে চিঠি। মেয়ে পক্ষ টের পেয়ে আমার বাবাকে জানাল খবরটা। বলল-‘হয় তোমার ছেলে সামলাও, নয় মেয়েকে ঘরের বউ করে নাও। ইজ্জত, মারবে, সেটা সইবো না।’ শেষটায় রফা হয়ে গেল। বউ ঘরে এলো। একেই বলে ‘আট অফ্ বিয়িং ম্যারেড্’ আর কি! কথা শেষ করিয়া নূরু মিটিমিটি হাসিতে লাগিল। রহিম সহাস্যে কহিল-এবার ভালো করেই বুঝেছি, ভায়া! তোমার ঘাট বুদ্ধি আছে বলতে হবে। হালিম রাগিয়া কহিল-বুদ্ধি নাই ছাই। এতো অল্প বয়সে বিয়ে করে জীবনটাই মাটি করল। নূরু কহিল-মাটি করলাম কই? বরং খাঁটি করেছি। জানো না অ সধহ রং হড়ঃ ঢ়বৎভবপঃ রিঃযড়ঁঃ রিভব’? আর, কবি বলেছেন- ‘পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ, কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ। দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস নিশীথে হয়েছে বধু, পুরুষ এসেছে মরু-তৃষা লয়ে- নারী যোগায়েছে মধু। নারীর বিরহে নারীর মিলনে নর পেলো কবি-প্রাণ, যত কথা তারই হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’ হালিম বিরক্ত হইয়া বলিল-রেখে দে তোর নারী-তত্ত্ব। অই হয়েছে তোদের কাল। অকাল বোধনের মজাটা আজ না বুঝিস্, একদিন বুঝবি। মজিদ বলল-একদিনের কথা ছেড়ে দাও দাদা। ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে বর্তমানকে ছাড়া যায় না। এখন যা পাও, লও। ভবিষ্যতের আশায় পাতে ভাত রেখো না। ভবিষ্যৎ তোমার না-ও তো আসতে পারে। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আর, বর্তমান-সমুপস্থিত। চাক্ষুস, বাস্তব সত্য। রহিম বলিল-যা বলেছিস্ যথার্থই বলেছিস। মহাপণ্ডিত বাক্য। সক্রেটিসকেও হার মানিয়ে দিয়েছিস। … … … কৌতুক হাস্যে মুখমণ্ডল উজ্জ্বল করিল। হালিম কহিল-খুব হয়েছে। আর নয়। তোদের ফিল্সফি বুঝতে পেরেছি অনেক পূর্বেই। আর তত্ত্বকথা শোনাতে হবে না। একদিনে অতো নীতিবাক্য হজম করতে পারব না। পেট ফুলে মরে যাবো, বুঝলি? নূরু কহিল-হ্যাঁ, বুঝেছি। শুনতে ভালো লাগছে না তোমার, তাও বুঝেছি। আমরা দাদা, ‘ডুব দিয়ে পানি খায় একাদশীর বাপেও জানে না’ গোছের ছেলে নই। তাই সত্যি কথা সরল মনেই বলে ফেলি। চাপাচাপি পছন্দকরি না। যাক গে। বিরক্ত হচ্ছে যখন, তখন আসি আপাতত।… … …। ওরা সবাই এক সাথে প্রস্থান করিল। হালিম এতোক্ষণ অতিশয় অস্বস্থিবোধ করিতেছিল। ওরা চলিয়া যাওয়ায় হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। অতঃপর সে পাঠে মনোযোগ দিলো। সত্যই সে শান্ত-শিষ্ট, সচ্চরিত্র। ওরা খারাপ, তাই সকলকেই খারাপ ভাবে। তাহাতে কিছুই আসে যায় না।

Comments

comments