ধারাবাহিক উপন্যাস

কর্মের ফল

By lazy-coder

May 05, 2014

(পূর্ব প্রকাশের পর)

ষোল ডলির সংগে সেলিমের দেখা হয়। কিন্তু সেলিম ডলির মধ্যে একটা শীতলতা লক্ষ্য করে। কথা-বার্তা আগ বাড়িয়ে বলে না। সে বললেও সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে পাশ কাটাতে চায়। তার মনোভাব বুঝতে সেলিমের বেগ পেতে হয় না। সে সময়-সুযোগ বুঝে একদিন ডলিকে বলে : তুইতো আজকাল ডুমুরের ফুল হয়ে উঠেছিস। : এটা তোর ভুল ধারণা। আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি। : আমারতো মনে হয় না। : তুই এইচ.এস.সি পাশ করলি, সে খবরটাও জানালি না। : আমি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম তাতো তোকে বলেছি। পাশের কথাটা অবশ্য বলার খেয়াল হয়নি। তবে জানতে তো পেরেছিস। : সেতো পরের মুখে শোনা। : এই হলো আর কি। জানা তো হলো। এখন আবার বি.এ.-এর প্রস্তুতি নিচ্ছি, জানিয়ে রাখলাম। : তা’ বিযে়র প্রস্তুতির খবরটা লুকোচ্ছিস কেন? : প্রস্তুতি এখনো নিচ্ছি না। কি করে জানাই? : লুকোচুরি আর কতো দিন চলবে? : লুকোচুরি, মানেটা কি? : লুকোচুরি বুঝিস না, কচি খুকী নাকি? ডুবে ডুবে জলখাস, ভাবছিস, কেউতো বুঝতে পারে না। আসলে গোপন হলেও গোপন থাকে না। কথায় বলে- বাতাসেরও কান আছে। প্রকাশ করবার পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। : অর্থাৎ ডাক্তার মাসুদকে এখনও কব্জা করতে পারিসনি। তাইনা? : তুই যদি তা ভেবে থাকিস, তবে তাই। : কিন্তু শেষ কালে পস্তাতে না হয়। অনেক উঁচুতে উঠতে গেলে আছাড় খাওয়ার ভয় থাকে। যা করবি ভেবে-চিন্তে করিস। আসলে তোর অমঙ্গল হোক, এটা আমি চাই না। আমিই তো তোকে এ-পথে আসার প্রেরণা যুগিযে়ছি। অস্বীকার করতে পারবি? : যা সত্যি তা অস্বীকার কেন করবো? তুই আমার খুব উপকার করেছিস। আমি তা ভুলিনি। ভুলবো না কখনও। : কিন্তু তুই কি শেষ পর্যন্ত ডাক্তার মাসুদকে ধরে রাখতে পারবি? : আমিতো চাইনি। কিন্তু কেমন করে যে জড়িয়ে গেলাম, বুঝতে পারছি না। : একেই বলে দুর্বলতা। তুই তাকে প্রিভিলেজ দিয়েছিস। নইলে সে তোর প্রতি আকৃষ্ট হবে কেন? কোন কিছু একতরফা হয় না। : তা অবশ্য স্বীকার করতে হয়। : তুইতো আমার আবাল্য সহচরী ছিলি। কিন্তু আমার প্রতি তো তোকে কখনও দুর্বল হতে দেখা যায়নি। : আরে বাপু, সে সুযোগটা পেলাম কোথায়? তুই এস.এস.সি. তে ফেল মেরে হাসপাতালে ওয়ার্ড বযে়র চাকুরী নিলি। আর, আমি পাশ করে- যা হলো তাতো তুই জানিস। : তা জানি, দ্বোজবরের সংগে বিয়েটা তোর টিকলো না। তাইতো তোকে আমিই টেনে আনলাম এই পেশায়। হায় আল্লাহ! তুই শেষ মেষ ভিড়ে গেলি এক ডাক্তারের সংগে? : তোর যে আমার প্রতি অন্যরকম অনুরাগ আছে, তা তো কখনও বুঝতে পারিনি। : বুঝলেও কি করতিস? : তা জানি না। তবে হয়তো একটা ভাবনার দোলায় দুলতাম। : আর, এখন? : এখন আর তা হয় না মিয়া। অন্যপথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। সেখান থেকে ফেরা আর সম্ভব নয়। : তাহলে ভুলটা কি আমারই? : হয়তো তাই। : তাহলে তোকে নিযে় আমার আর রঙিন স্বপ্ন না দেখাই উচিত। কি বলিস? : তা অবশ্যই বুঝি, ধান চাইতে চাউল পেলে কে তা ছাড়ে। ডাক্তার আর ওয়ার্ড বয়- দুস্তর ব্যবধান। : তা থাকলেও আমি তোকে ওয়ার্ড বয় ভাবিনা। তুই আমার সহপাঠী, শৈশবের খেলার সাথী। তুই আমার হিতৈষী। অতএব, তুই আমার একজন ভালো বন্ধু, আপনজন। এমনিই ভাববো আজীবন। : কিন্তু আমার একটা অন্যরকম স্বপ্ন ছিল তোকে ঘিরেই। সেটা কি আমার অপরাধ? : অপরাধ নয়। তবে সময় উত্রে গেছে। তাই স্বপ্নও ভাংতে হবে। : কিন্তু মনের মধ্যে একটা দারুণ কষ্ট থেকে যাবে। : কষ্টটাকে ভুলে যা। মানুষ যা চায়, সব সময় তা পায়না। তাই বলে কারো জীবন থম্কে থাকে না। : তাহলে মাসুদকে নিযে়ই তোর স্বপ্ন দেখা? : আপাততঃ তাই। তুইও নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা কর। : সেটা তোকে আর বলে দিতে হবে না। : রাগ করছিস? : তোর উপরে রাগ করে আর কী হবে? তুইতো কিনার পেয়ে গেছিস। : ধৈর্য হারাসনে। তুইও একদিন কিনার পেয়ে যাবি। আমারও সেটাই কামনা। আমার উপর রাগ রাখিস্নে, ভাই! সতেরো শাহেদ আলীর সংস্পর্শে এসে আবেদ আলীর আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এক সময়ের বেপরোয়া ঘুষখোর কাস্টম অফিসার এখন একজন পরহেজগার নামাজী মানুষ। অধিকাংশ সময় মসজিদে পড়ে থাকেন। নামাজের বেলাতেও তিনি ফরজ পাঁচ ওয়াক্ত ছাড়াও কাজা এবং নফল নামাজে দিন-রাতের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দেন। হাদিসে আছে- ‘দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান মসজিদ এবং সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্থান বাজার।’ কেননা মসজিদ আল্লাহর ঘর, ইবাদতের স্থান। এখানে যারা আসেন, বসেন তারা আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে আসেন। এখানে দ্বীনের কথা বলা হয়। এখানে দুনিয়াদারীর কথা নেই। ভালো কাজে ছওয়াব মিলে, ভালো কথাতেও ছওয়াব। তাইতো সৎ লোকের সংস্পর্শে থাকা উত্তম। মাটির উপরে সুগন্ধি ছিটালে মাটিও সুগন্ধি হয়। আর বাজার? বাজারে হাজার রকমের কারবার। হরেক রকমের লোকের সমাগম। এখানে বেচা- কেনা হয়, এখানে ঝগড়া-ফাসাদ হয়। এখানে হালাল মাল যেমন বিক্রি হয়, হারাম মালও বিক্রি হয়। এখানে গান-বাজনাও চলে। অশালীন কথা-বার্তাও চলে। কেননা বাজার অবারিতদ্বার। এখানে ভালো-মন্দ সব ধরণের মানুষ আসে। তাই দ্বীনদার পরহেজগার মানুষ একান্ত প্রয়োজনের সময়টুকু ছাড়া এক মুহূর্তও বাজারে অবস্থান করে না। এখানে দাগাবাজ শয়তানের পক্ষে সুবিধাজনক জায়গা। তাই শয়তানের আছর এখানে অধিক হবার সম্ভাবনা। আর, শয়তানতো সর্বদা মানুষের পিছনে লেগেই আছে। মানুষও অপকর্মে লিপ্ত হয়। হালাল-হারামের বাছ-বিচার ভুলে যায়। তাই দ্বীনদার মানুষকে সাধ্যমতে বাজারকে এড়িয়ে চলা উচিত। আবেদ আলী তার পড়াশুনার জীবনে শাহেদ আলীর সংগে কাটালেও, তার জীবনপ্রবাহ ভিন্নখানে প্রবাহিত হতো। চাকুরীকালীন সময়টা কেটেছে তার উপার্জনের ধান্দায়। বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন উপার্জন বৃদ্ধির সংগে তাল মিলিয়ে। কোনো ব্যাপারেই সংযমী হননি। আহারে-বিহারে ঘুষে মত্ত থেকেছেন। বার্ধক্যে ভোগান্তির শুরু। এমন সমযে় আবার তিনি শাহেদ আলীর সংস্পর্শে এসেছেন। এখন তিনি শাহেদ আলীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আল্লাহ তার মতি-গতির পরিবর্তন সাধনের অছিলা মিলিয়ে দিয়েছেন। এখন উভয়ের মত ও পথ একই। উভয়েই গ্রামের মাদ্রাসা নিয়ে ব্যস্ত। দ্বীনী এলেম শিক্ষা প্রসারে তারা সদা তৎপর। বার্ধক্যের জীবন তাদের অনাবিল আনন্দময়। আবেদ আলী একদিন বললেন শাহেদ আলীকে : দোস্ত, মেয়েটাকে তো কিঞ্চিত দ্বীনী এলেম শিখালাম। দাখেলও পাশ করলো ভালোভাবে। আলেম-ফাজেল পড়াবার উপায়তো দেখি না। শাহেদ আলী বললেন : গ্রামে থেকে পর্দা-পুসিদায় থেকে কিছু দ্বীনী এলেম শিখিছে, তাই-ই যথেষ্ট। আমাদের গ্রামেতো ফাজেল মাদ্রাসা নেই। কী আর করবে? এতেই খুশি থাকো। Something is better then nothing. : তা অবশ্য। গ্রামে না এলেতো এটুকু-ও হতো না। আল্লাহর দরবারে হাজার শোকর। আমার নসিবে ছিল। তাই এ সুযোগটুকু পেলাম। এখন একটা ফরজ কাজ বাকী। তাওফিক থাকা স্বত্ত্বেও হজ্ব না করে মারা গেলে আল্লাহকে কি কৈফিয়ৎ দেবো? : তোমারতো শরীর সুস্থ থাকা অবস্থায় হজ্বে যাওয়া উচিত ছিল। সমযে়র কাজ সমযে় করতে হয়। কাজ ফেলে রাখায় বিপদ ঘটে। তখন আফসোস করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। কবি বলেছেন- ‘ যে চাষা আলস্য ভাবে বীজ না বপন করে, পক্ক শস্য পাবে সে কোথায়?’ : না ভাই, আর বিলম্ব নয়। আল্লাহর রহমতে ডায়বেটিসটা একটু কন্ট্রোলে এলেই হজ্বে যাবো। : আল্লাহ নিশ্চয় নেক মকসুদ পুরা করবেন। নিয়ত রাখো খালেছ দীলে, হযে় যাবে ইনশা আল্লাহ। : কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে। : কি সমস্যা? : সমস্যা হলো- রোকসানার বিয়ে দেওয়া। এ হক আদায় না করে হজ্বে যাওয়া কি ঠিক হবে? : বালেগ মেয়ে। হজ্বে যাবার আগে তার একটা হিল্লে হয়ে গেলে অবশ্য ভালো হয়। : তাহলে কি করি বলো তো? জোর করে তো মেযে়র বিয়ে-দেওয়া যায়না। কেউ আগ্রহ করে এগিযে় এলে বিয়েটা হতে পারে। : এ-ব্যাপারে অবশ্য আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। : তুমি সাহায্য করবে কি রকম? : কেন, আমারও তো বিবাহযোগ্য ছেলে আছে। তোমার মেয়েকে যদি আমার ছেলের বউ করে নিই? : একদার নামকরা ঘুষখোর কাস্টমার অফিসারের মেযে়কে তোমার ছেলের বউ করে নেবে? : তাতে কি? তোমার মেয়ে তো আর ঘুষখোর ছিল না। তাছাড়া যার কৃতকর্মের জন্য সে-ই দায়ী থাকে। পরিবার সে জন্য দায়ী হয় না। কেননা, পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য যে রোজগার করবে- হালাল-হারামের দায়-দায়িত্ব তারই উপর বর্তাবে। : অর্থাৎ পাপের ভাগীদার কেউ হয় না, এইতো? : অবশ্য পূণ্যের বেলাতেও সে রকম। তোমার সন্তান যদি নেককাজ করে, তুমি তার থেকে কিছু ছওয়াব পেতে পারো যদি সে তোমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে। আবার যদি তুমি তাকে সুশিক্ষা না দিযে়, এলেম-কালাম না শিখিযে় তার পাপের পথ প্রশস্ত করে দাও, তাহলে সেই সন্তানের পাপকার্যের জন্য তোমাকেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ কুরআন পাকে কাউকে উদ্দেশ্য করে ‘ইক্রাস্ সালাত’ বলেননি, বলেছেন- ‘ওয়াকিমুস্ সালাত’-সালাত প্রতিষ্ঠা করো। : এসব বিষযে় আগেতো কখনো ভাবিনি। : ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু অনেকেই ভাবে না। যখন গাযে়র জোর কমে, তখন ভাবে। এটা ঠিক নয়। সময় থাকতে ভাবতে হয়। : না ভেবে ভুল করেছি। তা তোমার অছিলায় বুঝতে পারলাম ভাই। তুমি বুঝালে, তাই মনের পরিবর্তন হলো। এখন আল্লাহর কাছে কৃতকর্মের জন্য মাফ চাওয়া আর কান্নাকাটি করা ছাড়া আর উপায় নেই। : খালেছ দীলে তওবা করলে আল্লাহ বান্দাকে মাফও করতে পারেন। তিনি গাফুরুর রহিম। যাক, এবার তোমার মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে কথা হোক। : তোমার ছেলে এমবিবিএস ডাক্তার। সরকারী চাকুরী। তার জন্য ভালো পাত্রী পেয়ে যাবে। তাছাড়া আজকালকার ছেলেরাতো বাপ-মায়ের পছন্দে বিয়ে করে না। আবার যৌতুকের দাবীও থাকে। : সেজন্য ভয় কী তোমার? টাকার অভাবতো নেই, দিযে় দেবে। : তা হয় দিলাম। কিন্তু গ্রামের কম শিক্ষিত মেয়ে তোমার ছেলে যদি পছন্দ না করে? চলবে

Comments

comments