অন্যান্য

সৈয়দ আলী আহসান : চেতনার অনুষঙ্গ

By mumin

August 24, 2016

‘বিপুল তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং উদ্দীপনাময় তাঁর চিন্তাধারা, শিল্প-সাহিত্যের তমসা রজনী তাঁর বোধের আলোকে প্রভা সম্পন্ন হল।’-১ সৈয়দ আলী আহসান আমাদের মধ্যে একমাত্র যিনি প্রাচীন ও আধুনিক, দেশজ ও বৈদেশী কবিতায় সমান উৎসাহ, অনায়াস তৎপরতা ও তীক্ষ্ম কুশলতার সঙ্গে সঞ্চারণ করেছেন। … এবং (তাঁর দ্বারা) সমস্ত আস্বাদ ও বিচার সম্পন্ন হয়েছে একজন আধুনিক কবির দৃষ্টিকোণ ও মনোলোক থেকে।২ বাংলাদেশের কাব্য, সাহিত্য ও সমালোচনায় সৈয়দ আলী আহসান আধুনিক প্রকরণ-প্রবণতা ও আন্তর্জাতিক মান যুক্ত করেছেন। সাথে সাথে বাঙালি মুসলমানদের বহমান শিল্প সাহিত্যের ঐতিহ্যকে লালন করেছেন, কর্ষণ করেছেন ও আধুনিকায়ন ঘটিয়েছেন।৩ প্রকৃতপক্ষে শুধু বাংলাদেশের নয়, পাশ্চাত্যে এশিয়ার কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে যে কজন সেলিব্রীটি হিসেবে গণ্য হয়েছেন, সৈয়দ আলী আহসান তাঁর মধ্যে নানা কারণেই ছিলেন বিশিষ্ট। অসংখ্য ভক্ত রয়েছেন তাঁর বহির্বিশ্বে।৪ তাঁর এই মর্যাদা ব্যক্তির জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি এবং জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অসামান্য গৌরবের বিষয়। মেধাহীন, জ্ঞানহীন, আদর্শহীন এই নিরেট সমাজে সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন প্রজ্ঞা, মেধা আর দিগন্ত বি¯তৃত পাণ্ডিত্যের সাথে সন্নিবিষ্ট। অলোক সামান্য সৃজনশীলতা তাঁকে আন্তর্জাতিক মানুষে পরিণত করেছিল।… তাঁর দিগন্তস্পর্শী প্রজ্ঞার কোন তুলনা ছিল না। কি সাহিত্যে, শিল্পে, ইতিহাসে, কি দর্শনে, কলাবিদ্যায়, ধর্মবেত্তায়, সংস্কৃতি চিন্তায়, সাহিত্য সমালোচনায়, সংস্কৃত বা হিন্দি ভাষায়, আরবি ভাষায় কিংবা ইংরেজি সাহিত্যে কোনটি যে তার আপন ক্ষেত্র, অনুমান করাটা ছিল দুষ্কর।৫ সঙ্গত কারণেই তাঁর মত বিশাল ব্যক্তির ও প্রতিভার চেতনার অনুষঙ্গ আমাদের জানতে হবে। জানতে হবে তাঁর চৈতন্যের উৎসমূল। কোথা থেকে কীভাবে রস গ্রহণ করে পরিপুষ্ট হয়েছে তাঁর বোধও বোধের বিশাল মহীরুহ। আসুন জেনে নিই তাঁর নিজস্ব উচ্চারণে :

জীবনের উষালগ্নে … আমাদের পরিবারটি ছিল পরিচ্ছন্ন এবং ধর্মীয় আবেগে আপ্লুত। সকল প্রকার পার্থিব কর্মকাণ্ডের মধ্যে কুরআন শরীফ পাঠ ছিল বড়দের জন্য অবশ্যকরণীয়। কুরআন শরীফ পাঠের কলগুঞ্জন বাতাসকে মোহমদির করে রাখাতো। ….. শৈশবে দেখেছি আমাদের সংসারটা সকলকে নিয়ে পরিপূর্ণ। এই সকলের মধ্যে বাড়ির কাজের লোকেরাও ছিল। আমাদের বাড়িতে কাজের লোক ছিল অনেক। কিন্তু তাদের জন্য কখনই ভিন্ন রান্না হত না। আমরা যা খেতাম, তারাও তাই খেত। আমার নানাজানের নির্দেশে বাড়ির সকলের জন্য একই ব্যবস্থা ছিল। আমরা যেমন ঈদের দিনে বড়দের সালাম করতাম, বাড়িতে কাজ করার মানুষগুলোকে তেমনি সালাম করতাম। ঈদে তারা নতুন কাপড় পরত। আমাদের আনন্দে তারাও অংশগ্রহণ করতো। আমার জীবন সূত্রপাতে সকলকে নিয়ে সম্মিলিত আনন্দের উপটৌকন লক্ষ্য করেছি।

জীবনাচরণ প্রসঙ্গে … আমার পরিচয় আমার বিশ্বাসে, আমার বিবেক বুদ্ধিতে এবং আমার পরিচ্ছন্ন ইচ্ছায়। আমি জীবনে কখনও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ মানিনি এবং ইসলামের প্রতি আমি আনুগত্যবদ্ধ। আমি বিশ্বাস করি, আমি যে জীবনযাপন করেছি, সে জীবনে পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতার একটি ইচ্ছা ছিল। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাপ্রশ্নে আমাদের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতায় যারা বাস করছেন তারা সবাই বাংলাদেশি। আমাদের আনুগত্য আমাদের দেশের প্রতি। এ আনুগত্য মেনেই আমরা সম্ভ্রান্ত, সচকিত এবং দেশ প্রেমিক। যারা বাঙালি জাতীয়তার কথা বলেন তারা বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানাকে বিকশিত করতে চান এবং অন্যদেশের একটি জাতিসত্তার সাথে মিলিত হতে চান।

সাহিত্য সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের বলয় আমার জীবনে কোনো সংশয় নেই। বিশ্বাসের অধিগম্যতা আছে; কিন্তু কোনো গোঁড়ামি নেই। আমি যে আমার সমগ্র জীবনে বস্তুবাদ থেকে মানুষের মুক্তির কথা বলেছি, সে কথা সকলে স্বীকার করেছেন। আমাদের সংস্কৃতিক জীবনে বর্তমানে খুবই বিপর্যয় চলছে। কিছু কিছু মানুষ নাস্তিক্যবাদে অহংকারী হয়েছেন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিজেদের মতাদর্শে দীক্ষিত করে জড়বাদী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। আমাকে সংবর্ধনা সম্মান করার অর্থ হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ ও জড়বাদের বিরুদ্ধে সত্যপ্রতিষ্ঠার সংকল্প গ্রহণ করা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি বিশ্বাসের বলয় আমি নির্মাণ করতে চেয়েছি এবং আমার অনুরাগীরা জানেন যে, আমাকে গ্রহণ করলে সত্যকে গ্রহণ করার পথ উন্মুক্ত হয় এবং বিশ্বাসের প্রতাপ বৃদ্ধি পায়। আমি কবিতাকে বিশ্বাসের বিভূতি বলেছি।

আধ্যাত্মিক মূলসূত্র রাসূলে খোদার অনুসরণ ইহকালের এবং পরকালের মূলধন স্বরূপ। যথার্থ সাধক সেই ব্যক্তি, যিনি রাসূলে করীমের (স.) আত্মিক অবস্থা আস্বাদন করার চেষ্টা করেন এবং রাসূলের বিশিষ্ট অনুভূতিকে নিজের জন্য প্রেরণা স্বরূপ মনে করেন। … আল্লাহ তা’লার পবিত্র অস্তিত্বকে আমরা তখনি অনুভব করতে পারবো, যখন রাসূলের সুন্নতের বিশিষ্টতা আমরা অনুভব করতে পারবো।

কামনায় স্বরূপ বিরাটকে কামনা করতে হবে। বিরাটকে কামনা না করলে চলবে না। সুতরাং বিরাট এবং মহৎকে আমাদের কামনা করতে হবে। আমাদের জীবনে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ভাবনার অনুষঙ্গ আমাদের ভাবতে হবে সময় সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে। সচেতনভাবে আমি যদি ভাবতে পারি তাহলে সময়কে আমরা অতিক্রম করতে পারি। তাহলে আমরা বেঁচে থাকব। ১. (বিখ্যাত ফার্সী-উর্দু কবি) কলীম সাসারামী’র কবিতা ‘সৈয়দ আলী আহসান’। ২. আব্দুল মান্নান সৈয়দ, ‘সৈয়দ আলী আহসান সংবর্ধনা গ্রন্থ’ ১৯৮২। ৩. ইনকিলাব সম্পাদকীয়, ২৭ জুলাই ২০০২। ৪. ইউসুফ শরীফ, তিনি আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। ৫. নাট্যকার আরিফুল হক, একে একে নিভেছে দেউটি

তথ্যসূত্র : ‘পরওয়ানা’ (সেপ্টেম্বর’ ০২)।

Comments

comments