গল্প

বাবার বিজয়ের উপহার

By mumin

February 04, 2017

প্রতিবছর বিজয় দিবসের আগের দিন হেদায়েত গ্রামে যায়, তার একমাত্র কারণ হলো ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে স্কুলের মাঠে বিরাট আনন্দ উৎসব হয়, সে উৎসবে হেদায়েত বক্তৃতা দেয়, যুদ্ধের স্মৃতিগুলো তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরে। তরুণ প্রজন্ম কান পেতে শুনে। আবার অনুষ্ঠান শেষ হবার পর অনেক ছেলে মেয়ে হেদায়েতের পিছু নেয়। কেউ দাদু ডাকে কেউ জেঠু ডাকে, কেউ আবার বড় আব্বা ডাকে। ১৯৭১ সালে হেদায়েতের বয়স ২৭/২৮ হবে। পুরো যুবক সে। ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার’। হ্যাঁ তখন হেদায়েতের বয়স ছিলো যৌবনে পরিপূর্ণ। মা রাশিদা পছন্দ করে হেদায়েতকে বিয়ে করায় ১৯৭০ সালের ৩ ডিসেম্বর। মেহেদী হাতে থাকা নতুন বউকে ঘরে রেখেই হেদায়েত যুদ্ধে যায়। সেই অনেক অনেক কথা, হেদায়েতের ঘরে ৬ কন্যা আর দুই পুত্র সন্তান এখন। হেদায়েত যে মুক্তিযোদ্ধা তা গ্রামের সবাই জানে। যুদ্ধের কয়েক মাস আগেই হেদায়েত সেনাবাহিনিতে যোগ দেয়। হেদায়েত এখন শহরে থাকে, মাসে দুই মাসে একবার গ্রামে যায় পেনশন উঠাতে, অবশ্য আরেকটা কাজ ও ছিলো,তা হলো মুক্তিযোদ্ধার ভাতা উঠাতে। ছিলো বলাতে কি হোচট খাচ্ছেন,হ্যাঁ হোচট আমিও খেয়েছি প্রথমে। গত একবছর যাবৎ এই ভাতা তার বন্ধ, কারণ জিজ্ঞাস করায় অনেক কিছুই বলে,তবে সরাসরি কিছু বলেন না। অনেক বার কারণ জিজ্ঞেস করায় পরে বলে- আসলে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট বা ভাতা পাওয়ার আশায় তখন (‘৭১ সালে) আমরা কেউ যুদ্ধে নামেনি, সবাই দেশ প্রেম থেকেই যুদ্ধে নেমেছে,রক্ত ঝরিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, আহত হয়েছে, এই যে দেখো আমার পায়ে এখনো গুলির দাগ। আমরা কেউই ব্যক্তিগত কিছু পাওয়ার আশায় সে দিন অস্ত্র হাতে বা খালি হাতে যুদ্ধে নামিনি, আমরা পাকহানাদারদের তাড়াতেই নেমেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, আমরা বিজয় অর্জন করেছি। এই ৪৫ বছরে কত কি দেখছি, দেশকে ভালোবেসে দেশেই রয়েছি, দেশের বাহিরে যাবার সুযোগ ছিলো যাইনি। এই ৪৫ বছরে কতবার যে মুক্তিযুদ্ধাদের তালিকা চেঞ্জ হয়েছে, তা দেখি আর অবাক হই। ভাতা দেয়ার জন্যে গ্রামে যখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হচ্ছে, তখন আমি জানতাম না। অন্যরা আমার নাম দিয়েছে। পরে শুনলাম আমাদের ভাতা দেয়া হবে, তাই নতুন তালিকা করা হচ্ছে। আমাদের এলাকার যদি ২০/২৫ জনের নাম হয়,তাহলে আমার নাম থাকার কথা ২/৩ নাম্বারে,অথচ অনেক পরেই আমার নাম উঠে। এসব নিয়ে আমি কারো কাছে অভিযোগ করিনি, কার কাছে করবো। এই দেশ আমার, এই মানুষ আমার, আমরা সবাই জাত ভাই। কার বিরুদ্ধে বলবো। অত:পর নাম উঠলো, ভাতাও পাচ্ছিলাম। হঠাৎ শুনি ভাতা বন্ধ, কিন্তু কেনো?

এই প্রশ্ন খুঁজতেই চলে গেলো অনেক দিন, যাই প্রশ্ন পেলাম জবাব পাবো কই? আমার চাকরী ছাড়ার স্থান হলো ঢাকার মিরপুর, আমার গ্রামের বাড়ি, পেনশন পাই গ্রামের ঠিকানায়,স্থায়ী ঠিকানা বলে ওখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতাম। ঢাকা মিরপুর আর গ্রাম করতে গিয়েই একটা নাম্বার ভুল হয়, যেমন ১৭ এর জায়গায় ১৮ হয়। প্রথমে শুনলাম এই কারণে বন্ধ, অনেক চেষ্টা করে নাম্বারটা ঠিক করা হয়। কিন্তু ভাতা চালু আর হয়না। কেউ কেউ বলল মন্ত্রণালয় যেতে, গেলাম, খোজ করলাম। একের পর এক সমস্যা বের হয়, সমাধানের পথ আর বের হয়না। অনেক খুজে একজনকে ধরলাম, সে কাগজ পত্র ঘেটে বলল, -আপনার মতো ওই সব এলাকার প্রায় ৩০ জনের ভাতা বন্ধ, এটা ঠিক করতে সময় লাগবে। তদন্ত হচ্ছে, যদিও এটা সত্যি যে আপনার কোন তদন্তের প্রয়োজন নেই, আপনার সবই সঠিক তবুও অন্যদের সাথে থাকায় আপনার জন্যে কিছু করতে পারছিনা। হেদায়েত কথাগুলো বলে চুপ থাকে, এখন কি অবস্থা, জানতে চাইলে বলে,,, -আমায় আর কিছুই জিজ্ঞেস করো না, আমি এর পরের কিছুই বলতে পারব না। হেদায়েত প্রতিবছর বিজয় দিবসে গ্রামে যায় কোন কিছু পাওয়ার জন্য নয়, মনের টানে। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরে, হাতে একটা চীনামাটির ছোট একটা প্লেট বা বাটি থাকে, বাড়ী এসে একে ওকে দিয়ে দেয়। এগুলো কখনো শহরে এসে বলে না। হেদায়েতের মেয়ে আসমা বারবার জানতে চায় গ্রামের বিজয় দিবসের কথা, কিছু বলে কিছু এড়িয়ে যায় হেদায়েত। -বাবা শুনেছি তোমায় কি কি উপহার দেয়, তুমি কিন্তু এবার যা দিবে আমার জন্যে নিয়ে আসবে। -তুই কি করবি। -বাবা তুমি এনে দিয়েই দেখো কি করি। গত বছর হেদায়েত বাড়ি থেকে এসে একটা চীনামাটির প্লেট দেয় আসমার হাতে। অনেক খুশি হয় আসমা। প্লেটের মাঝখানে বাবার একটা ছবি লাগায়,পাশে যুদ্ধের কিছু ছবি এঁকে লাগিয়েছে, নিচে লিখেছে, ‘বাবার বিজয়ের উপহার’। হেদায়েত মেয়ের কাণ্ড দেখে অবাক হয়, কিচ্ছু বলে না। আসমা খোজ নিয়ে জানতে পারে ভাতার সমস্যা সমাধান করার জন্যে হেদায়েত ৫ হাজার টাকা ঘুষ ( কারো ভাষায় বকশিশ) দেয়। তাতেও কাজ হয়নি। ওরা বলেছে ১০ হাজার টাকা দিলে সমস্যা সমাধান হবে। এই বিষয়টা হেদায়েতের কাছে লজ্জার, তাই ভাতা পাওয়া বা ভাতা বিষয়ে শেষ কথাগুলো বলতে চায়নি সে। একদিন আসমা বাবাকে বলে, বাবা তুমি আমায় নিয়ে যাও, আমি দেখি তোমার কোথায় কোথায় সমস্যা। -নারে মা, যত লজ্জা তা আমার থাক, সন্তানের সামনে লজ্জায় আর পড়তে চাইনা। তোকে যেতে হবে না, যদি এমনিই সমস্যা সমাধান হয় হবে নইলে নয়। তুই আমার এই বিজয়ের উপহারটা যতœ করে রাখিস। আর কিচ্ছু চাইনা। (হেদায়েতের আসল নাম এটা নয়, সে কমাণ্ডার ছিলো যুদ্ধের সময়, কমাণ্ডার সাহেব বললেই সবাই চিনে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় দেশে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের ভর্তি হয়, চাকরী হয়, হেদায়েতের সন্তানরা এই কোটা কখনো ব্যবহার করেনি। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদেরও এই কোটা দেয়া হচ্ছে, সেখানেও কোনো সুযোগ নেয়নি হেদায়েতের পরিবার। )

Comments

comments