গল্প

প্রত্যাবর্তন

By mumin

February 02, 2017

‘আস্সলাতু খইরুম মিনান নাওম, আস্সলাতু খইরুম মিনান্ নাওম’ নিদ্রা হতে জাগো, হে মুমিন। ঘুম হতে সালাত উত্তম। ফজরের আযানের এই বাণী তুহানের কানে সবসময়ই মধু বর্ষায়। এতো মিষ্টি আযানের শব্দে সত্যিই মনটা আর বিছানায় থাকার জন্য সায় দেয় না। আজও এর ব্যাত্যয় ঘটল না। বেশ শীত পড়েছে বটে! বিছানা থেকে নেমে ঠাণ্ডা মেঝেতে পা পড়তেই কেঁপে ওঠে শরীর, যেন শীতে মরেই যাবে! কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে পড়ে যায় মহানবির (সা.) পবিত্র বাণী, ‘কিয়ামতের দিন বান্দার কাছ থেকে সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব নেওয়া হবে। ’ [তিরমিযী] সাথে সাথেই মেঝে থেকে জুতো ঠিক করে পায়ে পরে ওযু করতে বাথরুমে যায় তুহান। এইটুকু কষ্টের জন্য সে কিয়ামতে শাস্তি পেতে চায় না কিছুতেই। ঠাণ্ডা পানি যেন ওর হাত-পা কেটে ফালাফালা করে দিচ্ছে। কিন্তু তুহান পিছপা হয় না। মনে মনে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ পড়ে নিয়ে বিসমিল্লাহ পড়ে ওযু শুরু করে। ওযু শেষে রুমের ভেতরে থাকা স্টোভে নোহানের জন্য পানি গরম করে। ও, নোহানের পরিচয় তো দেওয়াই হয়নি! নোহান-তুহান দুই বন্ধু। ওরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হলে থাকে। একই রুমে। স্কুল-গণ্ডি থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। কাকতালীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়েও দু’জন একসাথে! উভয়ে একই রুমে থাকে। প্রতিদিনই তুহান ভোর হলে নোহানকে জাগাতে যায়। কিন্তু আজ অবধি নোহান একদিনও ফজরের নামায পড়তে ঘুম থেকে ওঠেনি। উল্টো ভোরে ডাকার জন্য বেশ রাগারাগি করেছে তুহানের সাথে। কিন্তু তুহান হাল ছাড়েনি। সে প্রতিদিনই নোহানকে ডাকে। বন্ধুর শীতে কষ্ট হবে বলে গরম পানিও করে দেয়। কিন্তু সবই বিফল। প্রতিটি দিনই তাকে একা একা মসজিদে যেতে হয়। তার বেশ খারাপ লাগে। সবসময় আল্লাহর কাছে বন্ধুর হেদায়েত কামনা করে। ‘নোহান, ওঠ, ক’টা বাজে দেখেছিস? নামাযের ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে বলে! চল, চল, মসজিদে চল! তোর গরম পানি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে!’, এক বুক আশা নিয়ে আজও তুহান ডাকল নোহানকে। নোহান উত্তর না দিয়ে কম্বলটা মাথায় তুলে নিল। হাল ছাড়ল না তুহান। আজ যে করেই হোক, নোহানকে মসজিদে নিবেই! ‘নোহান, দ্যাখ, এভাবে নিজের ক্ষতি করিস না, প্লিজ!’ ‘অ্যাই, তুই যাবি? ডিজগাস্টিং একটা! যা, যা, নেকি হাসিল কর গিয়ে! আমি ঘুমাবই!’ ‘এভাবে বলিস না, আল্লাহ তাআলা নারাজ হবেন!’ ‘তাইলে তুই গিয়ে ওনারে রাজি করা! আজিব!’ ‘দোস্ত, দ্যাখ, তুই তো পরেও ঘুমাতে পারবি! দশ মিনিট নামাযের পিছনে ব্যয় করতে পারবি না?’ ‘অ্যাই, শোন, আজাইরা বকবক করবি না। তুই কিন্তু সীমা অতিক্রম করতেছিস!’ ‘আমি…’ ‘ব্যাস, যথেষ্ট! বেরো! নাম! যা, তোর আল্লাহর কাছে যা! আমি জাহান্নামে থাকবোনে! তুই জান্নাতে গিয়া আমারে উদ্ধার কর!’ উঠে বসে নোহান। ‘আল্লাহ তোকে হেদায়েত করুন!’ আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় তুহান। বেশ কষ্ট লাগে। পা চালিয়ে হাঁটে। আর দশ মিনিট আছে জামাতের। চারদিকে এখনো অনেক অন্ধকার। আবারো একটা হাদিস মনে পড়ে, ‘যে ব্যক্তি মনোযোগসহ সালাত আদায় করে, কিয়ামতের দিন ঐ সালাত তার জন্য নূর হবে। ’ [তাবারানী] তুহানের মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, ‘সুবহানাল্লাহ!’ মসজিদ থেকে নামায পড়ে হলের এলাকার ভেতর হেঁটে বেশ কয়েকটা চক্কর দেয় তুহান। তারপর রুমে ফিরে আসে। প্রায় ছ’টা বাজে। নোহান এখনো ঘুমাচ্ছে। কুরআন শরীফটা একটু পড়ে সে। তারপর ফোনটা হাতে নেয়। প্রথম আলোর অনলাইন নিউজগুলো পড়ে নেয়। প্রায় সাতটা বাজে ঘড়িতে। নোহান আড়মোড়া ভাঙছে। চোখ ডলে তাকাল তুহানের দিকে। ভোরের আচরণের কথা মনে পড়ে যায়। খারাপ লাগে কিছুটা। পরক্ষণেই মনে হয়, ও নির্দোষ। সব দোষ আসলেই তুহানের! কিন্তু মুখে স্বাভাবিকতা বজায় রাখে। ‘নোহান, তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে নে। সকালে দেরি করে খাওয়াটা ঠিক না। ’ ‘যাচ্ছি…’ ‘হুম, যা। আজকে হলে খাব না। বেশি দূরে তো না, চল, শমসের আলীর ভুনা খিচুড়ি দিয়েই আজকের সকালের নাস্তাটা সারি। ’ ‘ওয়াও! বেশ হয় তাহলে! আমি এক্ষুণি আসছি!’ তুহান ভাবে, বন্ধু, তুমি যদি পরকালের খিচুড়ির ব্যাপারেও এমন আগ্রহ দেখাতে, আমার অনেক বেশি ভালো লাগত! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তুহানের বুক চিরে। আজকে ছুটির দিন বলেই এমন প্ল্যান করেছে তুহান। খিচুড়ি খেয়ে আবার দু’জনে দু’জনের সাইকেলে চড়ে বসে। পুরো দিনের প্ল্যান নোহানকে বলেছে তুহান। ও রাজিও হয়েছে। আজকে রমনা পার্ক, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল আর ছোট কাটারায় যাবে দু’জনে। দিনটা ভালোই কাটবে, আশা করছে তুহান। প্রথমে আহসান মঞ্জিলে যায় ওরা। নোহান আগে এখানে আসেনি। তাই বেশ আগ্রহভরে সব দেখে সে। একজন তুর্কি পর্যটকের সাথে ওদের কথা হয়। ওনার নাম মোহাম্মদ। তুরস্কে নাকি সবার নাম এমন এক শব্দের হয়। নোহান-তুহান বিষয়টা জানত না। তাই একটু অবাক হয়। এরপর যায় ছোট কাটারায়। খুব বেশি কিছু না থাকলেও মধ্যযুগীয় নির্মাণশৈলী দেখে মুগ্ধই হয়। ওদের কেউই আগে কখনো এখানে আসেনি। এরপর লালবাগ কেল্লা। প্রচুর মানুষ। শায়েস্তা খাঁর আমলে নির্মিত ভবনগুলো যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। যদিও আগে বহুবার দু’জনে এখানে এসেছে, তারপরেও সব কেমন নতুন নতুন লাগে! জোহরের নামাযের সময় হয়ে যায়। লালবাগের কেল্লা মসজিদে নামায পড়তে যায় তুহান। নোহানকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করে মসজিদে আসার জন্য। কিন্তু সমস্যা আছে বলে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। তুহান নাছোড়বান্দা। কিন্তু একসময় ছেড়ে দেয়। হয়তো আসলেই সমস্যা আছে! বন্ধুকে বিশ্বাস করে মসজিদে ঢোকে তুহান। নামায পড়ে বের হয়ে দেখে নোহান কী যেন দেখছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল তুহান। ছিঃ! না তাকালেই বোধহয় ভালো করত! স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলে মেয়ে একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে হাঁটছে। মাঝে মাঝে মেয়েটা মাথা ঝাঁকিয়ে চুলগুলো দিয়ে ছেলেটার মুখে বাড়ি দিচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, ছেলেটা মজাই পাচ্ছে! দ্রুত নোহানের কাছে চলে আসে তুহান। ঐ দৃশ্য আর দেখতে চায় না। নোহান কিন্তু তখনো তাকিয়ে আছে! তুহানকে দেখে বলল, ‘কী করলাম জীবনে বলতো! হাঁটুর সমান ছেলেপিলে প্রেম করতেসে, আর আমরা…!’ ভীষণ রকম বিব্রত হয় তুহান, ‘ছি, ছি, তুই এসব কী বলছিস? পাপ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করছিস!’ ‘ও, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আমি একজন ‘মুমিন’ বন্ধুর সাথে আছি! সরি! সত্যিই ভুলে গেছিলাম! তুই তো ফালতুর মতো কথা বলবিই!’ তুহান আমলে নেয় না। দ্রুত নোহানকে নিয়ে রিকশা করে হলে ফিরে আসে। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে রমনার উদ্দেশ্যে বের হবে ঠিক করে। বেলা তিনটা। তুহান ট্র্যাক স্যুট পরে নেয়। জগিং করবে রমনা পার্কে গিয়ে। নোহান পরেছে একটা হাফ প্যান্ট, টি-শার্ট আর তার ওপর একটা হাফহাতা হুডি। ঘাড়ে হেডফোন ঝুলিয়ে তুহানের সামনে এসে দাঁড়াল। তুহান বলল, ‘বাইরে অনেক শীত, দোস্ত, ফুল প্যান্ট পর! আর হাফ প্যান্ট পরা একজন মুসলমানের জন্য নিষিদ্ধ কিন্তু!’ ‘ধুর, আয় তো!’, বলে বেরিয়ে যায় নোহান।

অত্যন্ত বিব্রত দেখায় তুহানকে। একরকম বাধ্য হয়েই রিকশায় ওঠে নোহানের সাথে। রাস্তায় এতো মানুষ, তার মাঝে বিশ-একুশ বছরের এক তরুণ এহেন পোশাক পরে আছে! শরীরে শিহরণ খেলে যায় তুহানের। অথচ নোহানের চেহারা স্বাভাবিক! আধঘণ্টার মতো রমনায় হাঁটার পর দুজনে একটা বেঞ্চিতে বসে রেস্ট নিচ্ছিল। ঠিক তখন সামনে দিয়ে থ্রি কোয়ার্টার টাইট জিন্স আর টাইট টপ পরে জগিং করতে করতে এক মেয়ে গেল। তুহান মাথা নিচু করে রইল। ওকে অবাক করে দিয়ে নোহান সজোরে শিস বাজিয়ে উঠল। মেয়েটাও বা কী! লাজ-লজ্জা বলে কিচ্ছু নেই। পাল্টা হাসি উপহার দিল নোহানকে। তুহান নিচু স্বরে বলল, ‘নোহান, এসব কী করছিস? ছিঃ!’ নোহান এমনভাবে তুহানের দিকে তাকাল, যেন তুহান ওকে গাল দিয়েছে! ‘আধুনিকতা! তুই বুঝবি না!’, তাচ্ছিল্যভরে বলে নোহান। ‘হ্যাঁ, আমি হয়তো তোর এই অদ্ভুত মডার্নিটি বুঝব না বা ঐ মেয়ের বেশ্যাগিরিও হয়তো আমি মানতে পারব না। কিন্তু আমি এটা ঠিকই বুঝি, আধুনিকতা এটা না!’ ‘বেকুব!’ ‘হয়তো তোর দৃষ্টিতে! যদি নগ্নতাই আধুনিকতা হত, তাহলে প্রাচীন গুহাবাসীরাই ছিল তোর চেয়ে আধুনিক!’ ‘জ্ঞান দেওয়া বন্ধ কর! তোর ধ্যানধারণা তোর কাছেই রাখ! আমাকে বলতে আসিস না!’ ‘তোকে শুনতেই হবে! তুই যেটা করছিস সেটা অশ্ল­ীলতা বৈ কিছু নয়! তুই মেয়েটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিস। অথচ পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘হে নবি, আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত করে। ’ আর তুই? চোখ দিয়েই ব্যভিচার করছিলি! ছিঃ! শুনতে খারাপ লাগলেও আজ তোকে শুনতেই হবে। ঠাণ্ডার ভয়ে তুই ফযরের নামায পড়িস না। কিন্তু এই শেষ বিকেলের ঠাণ্ডাতে কি তোর হাড়ে কাঁপুনি লাগছে না? যে পোশাকে আছিস, তা তো কোনো মুসলমানের পোশাক হতে পারে না!’ নোহান মাথা নিচু করে শুনছে। ‘দ্যাখ, নোহান, মৃত্যু আমাদের সাবধান করে দিচ্ছে। সুপথে আসার উদাত্ত্ব আহবান জানাচ্ছে। আর মরণের সময় তোকে বা আমাকে কিন্তু এক মুহূর্ত সময়ও অতিরিক্ত দেয়া হবে না। পরকালে তো বিশ্বাস করিস, তা, কী নিয়ে যাচ্ছিস ঐ জীবনের জন্য, যে জীবন অনন্ত অসীম?’ নোহান এবারেও চুপ করে শুনছে। কিচ্ছু বলার নেই। তুহান তো ঠিক কথাগুলোই বলছে! ‘মহান আল্লাহ তোকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। মানে তিনি এখনো চান, তুই সুপথে ফিরে আয়…চলেই আয় না! নতুন জীবন শুরু কর! অর্থপূর্ণ এক জীবন, প্লি­জ!’ নোহান মাথা নামিয়েই রেখেছে। ওকে ধরে ওঠাল তুহান, ‘চল, হলে চল…. অ্যাই, রিকশা…’ রাত দশটা। তুহানের ক্লান্ত লাগছে। শুয়ে পড়ল সে। নোহান তখনো পড়ছে। নোহানের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে তুহান, টেরই পায়নি! ঘুম ভাঙল নোহানেরই ডাকে, ‘অ্যাই, তুহান, ওঠ, আরে! জামাতের জন্য দেরী হয়ে যাবে যে! তোর গরম পানি তৈরি! আমিও রেডি! চল, চল, ওঠ!’ তুহান বিছানায় উঠে বসে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নোহান। ওকে দেখে তুহানের মুখের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। বড়ই তৃপ্তির এক হাসি…

Comments

comments