গল্প

দেখা হলো একদিন

By mumin

April 15, 2018

দেশের অবস্থা তেমন ভালো না। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকিতে ভীত হয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। প্রতিটা সময় কাটছে উৎকণ্ঠায়। কখন কী হয়ে যায়, কেউ বলতে পারে না। আজ ২৫শে মার্চ। সকাল সকাল স্ত্রী অবন্তিকার সঙ্গে ছোটখাটো ঝগড়া হয়ে গেলো শাহেদের। ঘুম থেকে উঠে কড়া করে এক কাপ চা পান না করলে শাহেদের মাথাটা কেমন যেনো ঝিম ঝিম করে। প্রতি সকালেই অবন্তিকা চা বানিয়ে শাহেদকে ঘুম থেকে জাগায়। কিন্তু আজকে সে রুটিনটার পরিবর্তন দেখা গেলো। অবন্তিকা শাহেদকে চা দেয়ার পরিবর্তে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। না জাগানোর কারণে শাহেদ ঘুম থেকে উঠলো অনেক দেরীতে। উঠেই স্ত্রীকে ডাকলো চা দিতে। বাইরে থেকে অবন্তিকা চেঁচিয়ে বললো, ‘আমি কাজ করছি। প্রতিদিন তো আমিই বানিয়ে দেই। আজ না হয় তুমিই বানিয়ে নাও একটু।’ শাহেদের মাথাটা কেমন গরম হয়ে এলো। বাইরে গিয়ে কড়া গলায় শুনিয়ে দিলো কয়েক কথা। অবন্তিকাও কম যায় না। এক কথা দু কথায় বেঁধে গেলো ঝগড়া। মেয়ে নীতু চেয়ে চেয়ে কেবল দেখলো মা-বাবার ঝগড়া। শাহেদ না খেয়েই বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। রাস্তার পাশে একটা টঙ দোকানে বসে হালকা নাস্তা করে নিলো। কাজের চাপ না থাকায় হেঁটে হেঁটেই পৌঁছল অফিসে। দুজন গার্ড ছাড়া অফিসে কেউ নেই। অফিসের ম্যানেজার পশ্চিম পাকিস্তানের। দেশের খারাপ পরিস্থিতির কারণে সবাইকে ছুটি দিয়ে তিনিও চলে গেছেন পশ্চিম পাকিস্তান। একা একা সময় কাটানো মুশকিল। গরম মাথাটাকে শান্ত করতে গার্ডদ্বয়কে ডেকে খোশগল্পে মেতে রইলো শাহেদ। গল্প করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো, শাহেদ টেরই পায়নি। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে এতটা সময় কথা বন্ধ করে থাকেনি কখনো। নাহ, এবার ওঠা যায়। বাসায় ফিরে স্ত্রীর রাগ ভাঙাতে হবে। আসলে অবন্তিকার কোনো দোষ নেই। ওতো কাজেই ব্যস্ত ছিলো। একদিন নিজেই একটু চা বানিয়ে পান করলে কী হতো! ঝগড়ার কারণে মনে মনে আফসোস করতে লাগলো শাহেদ। অফিসের বাইরে বেরোতেই পুরোনো বন্ধু রিপনের সঙ্গে দেখা। একরকম জোর করেই শাহেদকে ওদের বাসায় নিয়ে গেলো। রিপন বললো, ‘এতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হলো, এতো সহজে আজ তোকে ছাড়ছি না। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করবো তোর সঙ্গে।’ শাহেদ স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার কথাটা লজ্জায় বলতে পারলো না। তাই রিপনের কাছে হার মেনে আসলো ওদের বাসায়। রিপনেরও নীতুর বয়সী একটা মেয়ে আছে। সাবিহা নাম ওর। শাহেদকে দেখেই দৌঁড়ে এসে কোলে চড়ে বসলো। শাহেদ নিজের মেয়ের মতো একেও অনেক আদর করে। রিপনের স্ত্রী শাহেদের জন্য রাতের খাবারে বেশ ভালো আয়োজন করলেন। খেয়েদেয়ে অনেকটা রাত পর্যন্ত তিনজন গল্প করলেন। সাবিহা তখন ঘুমে। শাহেদ বাড়ি ফেরার জন্য যেই উঠলো, অমনি বাইরে থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। সাবাই ভিতু চোখে একে অন্যের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। সাবিহা ঘুম থেকে জেগে জুড়ে দিলো কান্না। পরিস্থিতি জানার জন্য রিপন রেডিও চালু করলো। জানতে পারলো, পশ্চিম পাকিস্তানের মিলেটারিরা ঢাকা আক্রমণ করেছে। অনেক মানুষ মারছে আর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় দরোজায় করাঘাত পড়লো। ভয়ে সবার কলিজা যেনো শুকিয়ে এলো। রিপন শাহেদকে বললো, তার স্ত্রী আর সাবিহাকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাগানে লুকিয়ে পড়তে। কিন্তু রিপনের স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে যাবে না। অনেক জোরাজুরির পরও সে মানতে নারাজ। অগত্যা শাহেদ সাবিহাকে নিয়েই পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। রিপন দরোজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো কয়েকটা মিলিটারি। একটু পর বাগানে বসে ঠাস ঠাস শব্দে গুলির দুটো আওয়াজ শুনতে পেলো শাহেদ। ভয়ে সাবিহা শাহেদকে জড়িয়ে ধরলো। বাগানের নিশাচর কয়েকটা পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো কোথাও। শাহেদের বুঝতে বাকি রইলো না ভেতরে কী ঘটেছে। অবন্তিকা আর নীতু ভালো আছে তো? নাকি ওরাও মিলিটারির গুলির খোরাকে পরিণত হয়েছে! অজানা শঙ্কায় শাহেদের বুকটা কেঁপে উঠলো। পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে সাবিহাকে নিয়ে ভেতরে গেলো শাহেদ। রিপন আর ওর স্ত্রীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো ঘর। মেঝেতে পড়ে আছে ওদের নিথর দেহ দুটো। সাবিহা দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মা-বাবার লাশের ওপর। শাহেদ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। একটু আগেও যাদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে ছিলো, তারা লাশ হয়ে পড়ে আছে চোখের সামনে। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর করুণ মৃত্যু দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। সাবিহাকে বুকে টেনে নিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেললো সেও। শেষ রাতের দিকে বাগানে একটা গর্ত খুড়ে কোনোমতে প্রিয় বন্ধু আর তার স্ত্রীকে দাফন করলো শাহেদ। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে সাবিহা দেখলো মা-বাবার অন্তিম সৎকার। পরদিন পুরো শহরে কারফিউ জারি করেছে মিলিটারি বাহিনী। ভয়ে কেউ বাইরে বের হতে পারছে না। ঘরে ফেরার প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পুরোটা দিন বন্ধুর ঘরে লুকিয়ে থাকতে হলো শাহেদকে। সাবিহা ক্ষণে ক্ষণে মা-বাবার জন্যে কাঁদছে। ওকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া কিছুই করার রইলো না শাহেদের। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সাবিহাকে নিয়ে চুপি চুপি বাসায় রওনা করলো শাহেদ। মিলিটারির ভয়ে রাজপথ ছেড়ে গলিপথে পৌঁছল বাসায়। কিন্তু পুরো বাসা অন্ধকার। কারো কোনো সাড়া নেই। অবন্তিকা আর নীতুর নাম ধরে শাহেদ ডাকলোও বার কয়েক। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ এলো না ঘর থেকে। শাহেদ ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালালো। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো স্ত্রী আর মেয়েকে। কিন্তু কোথাও নেই ওরা। তাহলে গেলো কোথায়? মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যায় নি তো? ঢাকা শহরে তো তেমন কোনো আত্মীয়ও নেই ওদের। অজানা ভয়ের শীতল একটা পরশ বয়ে গেলো শাহেদের বুক চিড়ে। কতবড় ভুল করেছে সে। সেদিন এভাবে ঝগড়াটা না করলে এতক্ষণ স্ত্রী সন্তানের পাশে থাকতো ও। নিজেকে এ নিয়ে ধিক্কার দিতে লাগলো শাহেদ। মনে মনে চিন্তা করলো, গ্রামের বাড়ি চলে যাবে। অবন্তিকারা হয়তো সেখানেই গেছে। কিন্তু এখন যাওয়াটা কি ঠিক হবে? চলে যাওয়ার পর অবন্তিকা যদি ফিসে আসে? ওকে বাসায় ফিরতে না দেখে যদি ওরা অন্য কোথাও চলে যায়, তাহলে তো সারা জনমের জন্য স্ত্রী আর সন্তানকে হারাতে হবে। অবন্তিকার জন্য তাই দুদিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো শাহেদ। দুদিন চলে গেলো। অবন্তিকারা ফিরলো না। এর মধ্যে ঢাকায় আত্মীয়-স্বজন যারা আছেন তাদের বাসায় খোঁজও নেয়া হয়েছে। কিন্তু কারো বাসায়ই যায়নি ওরা। শাহেদ অবশেষে গ্রামেই চলে যাবার মনস্থ করলো। হয়তো ওখানেই গিয়েছে অবন্তিকারা। একদিন রাতে সাবিহাকে নিয়ে গ্রামে রওনা হলো শাহেদ। দুদিন হেঁটে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গ্রামে পৌঁছল শাহেদ। কিন্তু অবন্তিকারা এখানেও নেই। দুশ্চিন্তা আর অজানা ভয়ে শাহেদ যেনো মুষড়িয়ে পড়ল। দেশের কঠিন এ পরিস্থিতিতে কোথায় খুঁজবে ওদের? কোথায় আছে ওরা? আদরের নয়নটা কী অবস্থায় আছে এখন! এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নেমেছেন দেশ রক্ষার লড়াইয়ে। শাহেদ কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে মুক্তিযুদ্ধে যাবে। যুদ্ধ করতে গিয়ে গ্রামে গ্রামে খুঁজবে স্ত্রী আর মেয়েটাকে। সাবিহাকে মায়ের কাছে রেখে শাহেদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলো। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। এ সময়টায় বহু গ্রাম আর শহরে যুদ্ধে গিয়েছে শাহেদ। প্রত্যেকটা জায়গায় অবন্তিকাদের খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও মিললো না ওদের। শাহেদ একসময় সব আশা ছেড়ে দিলো। ধরে নিলো ওর জীবন থেকে প্রিয় দুটিমুখ হারিয়ে গেছে চিরতরে। যুদ্ধ শেষে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামের পথ ধরলো শাহেদ। গ্রামের মেঠো পথ। কোনো ভ্যান বা রিকসা কিছুই চলে না এ পথে। হাঁটতে হাঁটতে তাই একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তীব্র পিপাসায় গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে পড়েছে। দূরে কয়েকটি ঘর নজরে পড়লো শাহেদের। একটু পানির আশায় ওদিকে রওনা হলো। একটা দরজায় কড়া নাড়লো শাহেদ। একটা মেয়ে এসে দরোজা খুললো। মেয়েটাকে দেখে শাহেদ আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়লো। মেয়েটার চোখেও তখন খুশির জোয়ার বইছিলো। এতদিন পর স্ত্রী অবন্তিকাকে দেখে শাহেদের চোখ বেয়ে ঝরতে লাগলো আনন্দের অশ্রুধারা। ঘরের ভেতর থেকে নীতু ‘আব্বু! আব্বু!’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো শাহেদের কোলের ওপর। তিনটে প্রাণির অনাবিল এ আনন্দ যেনো কোনদিন শেষ হবার নয়। এ আনন্দ অনন্ত কালের জন্য।

Comments

comments