গল্প

আনন্দের পর আনন্দ

By mumin

August 10, 2018

নদীতে উথাল পাতাল ঢেউ, ক্ষুরধারা নদী। বইছে শনশন হাওয়া, তোলপাড় করছে মাথায় চুলগুলো, ফাত ফাত করছে জামাটা। এই সময়ে জমে উঠছে আমাদের আসর। বাতাসও তীব্র। আমাদের গল্পের স্বাদ ও হতে চলছে তীব্র। সময়টা বিকেলবেলা। দশ বারো বছর আগের কথা। আট জন বন্ধু বিকেলে আনন্দ নিতে নদীর চরে খোস গল্পের জন্য আগমন। সুর্য লাল হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে হবে অস্তমিত। রনি আমাদের মধ্যে বুদ্ধিমান ও শক্তিশালি। ও হঠাৎ হাতটা জাগিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিল পাল দেয়া তরী। আমরাও চেয়ে দেখতেছি বাদাম দিয়ে দাঁড়বেয়ে উল্টো স্রোতে তরীকে ভাসিয়ে নিচ্ছে দুই জেলে। রনি কি কারণে ইঙ্গিত করছে তা না বুঝলেও এটা বুঝলাম, মাছ ধরতে যাচ্ছে জেলেরা। তাই মুখ থেকে আপছে আপ বেরিয়ে আসল কী? নৌকায় কী? রনি আমাদের কথায় উত্তর না দিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে কী ভাবছে। এবার নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, আজকে রাতে পড়বে মাছ। জল বেশ ঘোলাটে। রুবেল বলল রাখত মাছের চিন্তা। রনি বলল, এই তুই কী বুঝিস? ঘোলাটে জলের কী বুঝিস? এক রাত্রের মাছ ধরে বসে খাওয়া যায় এক বছর। তুই এসবের কী বুঝবি? তুই কী জানিস ঘোলাটে জল থাকার মানে? বেশ মাছ পড়বে। আর হাতছাড়া করা যাবেনা এই সুযোগটা। আজকে রাত্রেই শুরু করব অভিযান। এই পায়রা নদীতে ডিম ছাড়তে আসে বড় বড় ইলিশ মাছ, ইয়া বড় তেল তেলে পাঙ্গাস। দেখতেই বাহার। কাঁটায় পেচিয়ে উঠে জালে। ত্রিশ কেজির উপরে ওজন। দিনের বেলায় জেলেরা জাল দিয়ে ভিড় করে। আর রাত্রে থাকে না, থাকলেও থাকতে পারে দুই একটা। তবে নির্দিষ্ট সময় কষ্ট করে উজাগার থাকতে পারলেই হয় সফলকাম। ওর এই কথার সুত্রে ঘোলাটে জলের মাছের জন্য সারা রাত্র উজাগার করে বিশাল পায়রা নদীতে জাল পাতা কি ঠিক হবে? সামনে আবার বাধা জাল। রনি জানিয়ে দিল, আমার সাথে যারা যারা আছ তারা ব্যতিত চলে যাও। অবশেষে ঠিকলাম চারজন। আমরা উৎফুল্ল মনে রাত্রের নদীর ভাটার অপেক্ষমান। বেশ মজার মধ্যেই পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। আমরা রনির মন রাখতে গিয়ে বললাম, বেশি মাছ না পেলেও অল্প তো পাব? মাছ পাওয়ার চেয়েও বড় কথা হলো, বেশি হবে আনন্দ। অনেক কথার মাধ্যমে রনিকে বিজ্ঞ বানিয়ে খুশি করলাম। সন্ধ্যা নেমে এল অনেকক্ষণ পর ভাটাও। পাল দাড়া করতেই শো শো করে এগিয়ে চলল তরী। চার জনে দুটি নৌকা নিয়ে পাল্লা দিয়ে চলছি অনেক দূর। জাল ফেলা মাত্র ডুবে গেল। ওরাও একটু দূরে ফেলল জাল। চারদিক অন্ধকার নীরব নিথর। একুট ভয় ভয় হলেও ভ্রুক্ষেপ নেই ভয়ের। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দূরাগত মেঘের গুরুম গুরুম আওয়াজ। কেউ নেই নদীতে। ফেলা জাল এতক্ষণে বেশ ভারি হয়েছে বড় বড় মাছ গেঁথে। মাছ গেঁথেছে পোনে পোনে। নৌকা বোঝাই হয়ে গেছে মাছে। আমাদের যথেষ্ঠ কষ্ট হয়েছে মাছ ছাড়াতে। এক পর্যায়ে হলাম অসহ্য। মাছ ছাড়াতে ছাড়াতে তীরে এসে ওদের অপেক্ষা করছি, তাও লুকিয়ে। ওরা যেন দেখে হকচকিয়ে যায়। কিন্তু ওদের মনেও আমাদের অবাক করার জ্ঞান বিদ্যমান। ইয়া বড় দুটি তেল তেলে পাঙ্গাস, অসংখ্য ইলিশ অন্ধকারে চিক চিক করছে। কি যে চাইছে আমাদের মনে। সবাই হয়ে গেছি খুশিতে আত্মহারা। নদীতে কেউ কোথাও নেই। আমরা চার জনও মাছে ভরা দুইটি তরী। বৈঠা দিয়ে আঘাত করা দু একটা ছপ ছপ শব্দ। আমরা বড় উত্তেজিত। এই চল ঘাটে চল। কেন? ঘাটে গিয়ে কী করবি? তায়, এখানে বসে থাকবি? না তাও না। তাহলে এখন কি করবি?

বাজারে আড়তে যাব। না হয় সকাল হতে হতে সব মাছ ফুলে যাবে। স্রোতের তালে তালে দুই তরী নিয়ে চললাম ধীরে ধীরে বাজারে। আমাদের এখন ঠিক করতে হবে, এই টাকা দিয়ে কি করব। কত অসংখ্য ভাবনা আসে মাথায়। ঘুম যে কত প্রিয়, যেই ঘুমের কারণে বন্ধুরা এলনা, কোন জেলেও নদীতে নামল না। কিন্তু এখন সেই মহব্বাতের ঘুম ধরা দেয় না। দুই তরী খুব কোল ঘেঁষে আড়তের কাছাকাছি উপস্থিত। রনি বলল, আমরা এত মাছ পেয়েছি কেউ জানে না। তো কেউ জানবেও না। মানে আমাদের সব হবে গোপন। হ্যাঁ, তাই তুই যা বলবি তা হবে। এখন কী করবি তাই বল? বাদ দে তোর ভাবনা। হিসেবটা কর তো, মাছের দাম পৌছবে কিনা লক্ষ। আচ্ছা হিসেবটা করি, পাঙ্গাস দুইটি, পোনে পোনে ইলিশ, হ্যাঁ, লক্ষ ছাড়াবে। আমাদের বেশ চলবে ইস্কুলের নাস্তা। পৌঁছালাম আড়তে। আমাদের জন্য জিমিয়ে একজন অপেক্ষমান। রনি ঠেলা দিয়ে বলল, তোমার মহাজন কই? মাছ উঠাতে হবে তরী থেকে। কিন্তু সে আমাদের কথায় কান দিলনা। দুই জনে দুটা হাজি নিয়ে মাছ বোঝাই করে রাখতেছি সামনে। ইতিমধ্যে আড়তের মালিক উপস্থিত। হেচকা হিসেব করে আমাদের হাতে তুলে দিল এক লক্ষ টাকা। রনিকে বললাম, তরী নিয়ে ভোর হওয়ার আগে চল। নইলে কেউ জানলে ছড়িয়ে পড়বে গ্রামে। টাকা পয়সার ভাগ দিতে হবে আনেককে। আবার তরী ছেড়ে পাল তুলে শো শো করে পৌঁছলাম ঘাটে। এই রনি টাকা গুলো কি করবি? মাথায় কিছু আসছে না রে। ভাগ করে নিয়ে যাই, চার জনে ভাগ করে নিয়ে যাই। না, ভাগা ভাগি হবে না। তাহলে তো হয়েই গেল। গভীর ভাবে ভেবে দেখ, আমাদের আনন্দ এখানেই শেষ। তার চেয়ে যা করব, চার জনে মিলে করব। আমরা টাকার লোভে পড়ব না। ভাল কিছু একটা করব। কিছু একটা করবি? চল তা পরে হবে। এ ভার রইল রনির উপরে। তাই হবে, ও পৌছাবে সে সিদ্ধান্তে। আমরা মেনে নিলাম এ কথা। চোখ ছোট হয়ে আসছে, সবাই বাড়ি ফিরতে প্রস্তুত। সবাই চলে এলাম বাড়ি। টাকা রইল রনির হেফাজতে। ঘরে উঠে এক ঘুমে পার হয়ে গেল সকাল। গড়িয়ে আসল দুপুর। ঘুম থেকে উঠলাম অনেক কষ্টে। আমাদের চার জনের মধ্যে একটা সুদৃষ্টির ভাব এমন হল। টাকা খাটাবো কোন এক ভাল কাজে। আমরাও অপেক্ষমান কোন এক মহৎ কাজের । রনির মতের উপর সিদ্ধান্ত নিয়ে, ভাল করে ঠাওরিয়ে, এ টাকা ব্যয় করব মহৎ কাজে। কিন্তু ব্যয় করব কোন কাজে, মাথায় কিছু আসে না। অনেক ভাবনা চিন্তা হল, কিন্তু খুঁজে পেলাম না ভাল উপযুক্ত স্থান। যত দিন যায় আমদের মনে দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায় শক্তি ও স্বপ্ন। তরী নিয়ে ফেলেছি অনেক দিন জাল। কিন্তু দুই একটা ব্যতীত গন্ডাও মেলেনি। চলে গেল এক মাস। আমাদের গ্রামে এল ভীষণ বন্যা। বড় বড় গাছ ভেঙে ভুতের আকারে দাড়াল। উড়িয়ে নিয়ে গেছে অনেক ঘরের টিন। উলটিয়ে দিল আমাদের পুরোনো মসজিদটা। আরও অনেক ক্ষতি করে চলে গেল বন্যা। সবাই কেমন উদাস, নাই কারও মুখে হাসি, নাই আনন্দ, সবাই চিন্তিত। এই সপ্তার জুমা অন্য গ্রামে পড়তে হয় কি না? তবুও সিদ্ধান্ত হল এই পোতায় পড়া হবে নামাজ। আর এই নামাজে নেওয়া হবে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমরা চার জনে একত্রে টাকার পুটলী নিয়ে উপস্থিত হলাম মসজিদে। শেষ হল নামাজ। এর পর যেতে বলা হল ছেলে পেলেকে। কয়েক জন গেল। আমাদের বসা দেখে থেকে গেল অনেক ছেলেপেলে। ভরা মজলিস। থর থর করছে আমাদের বুকটা। আজকে সিন্ধান্ত নেওয়া হল, পূর্ণ সংস্কার করে উঠানো হবে মসজিদ। যাতে ব্যয় হবে দুই লক্ষ টাকা। অনেকে বলতে লাগল বেশ টাকার অংক। তবুও পুরোয় না এক লক্ষ। বন্যায় সবার হয়েছে ক্ষতি। নষ্ট হয়েছে অনেক ধান চাল। তাই উঠতে উঠতে এক লক্ষ টাকার উপরে উঠেনি। এই মুহুর্তে আরও একলক্ষ টাকার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু বন্যায় অনেক কিছু ছিনিয়ে নেয়ায় এই মুহুর্তে এক লক্ষ টাকা যে দুর্লভ বস্তু। দাঁড়িয়ে গেলাম আমরা চারজন। আমাদের দাঁড়াতে অনেকের মুখে ফুটে উঠেছে বিরক্তির ভাব। বললাম, আমরা দেব এক লক্ষ টাকা। সবাই হা করে আমাদের দিকে তাকানো। কারও মুখে নেই কোন কথা। তোমরা দেবে? চারজনে সামনে গিয়ে সবাইকে সাক্ষি রেখে মসজিদ পূর্ণ নির্মাণে হুজুরের হাতে তুলে দিলাম এই এক লক্ষ টাকা। আমরা চারজন ব্যতীত কেউ কিছু জানেন না। আমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি একটা মহৎ কাজ করে। সবাই নির্বাক, নিস্তব্দ। সবার নজর চার জনের উপরে। টাকা হাতে পেয়ে ইমাম সাব কেমন হকচকিয়ে গেল। কেবল আমাদের মুখের দিকে তাকায়। কথা থেমে গেছে। তবুও প্রাণপনে চেষ্টা করে এইটুক বলল, পরবর্তী সমাজ ওদের, ওরা আমাদের চেয়েও উত্তমভাবে চালাবে। বাড়ির লোকেরা দাদা, চাচা এ ব্যাপার দেখে এমন অবাক হলেন যে, একটা কথাও বের হল না তাদের মুখে। সবার নেত্র দিয়ে বেয়ে পড়ছে আনন্দের অশ্র“।

Comments

comments