গল্প

অমানুষ

By mumin

July 17, 2023

তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে শফিক চৌধুরী একদিন মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছিলেন। সেই তুচ্ছ ব্যাপারটি দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর একটি মহা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত বৃদ্ধ শফিক চৌধুরী আজ হাড়েহাড়ে টের পান ইসলাম ধর্মের প্রয়োজনীয়তা। একজন ইমামের সত্য-বাণীর উপদেশকে খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর সাথে বেশ অশালীন আচরণ করেছিলেন তিনি। সেই দিনের কথা আজ বারবার স্মরণ হচ্ছে আর চোখ দুটো দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে শফিক চৌধুরীর।ইমাম সাহেব জুমার দিনে মসজিদের মিম্বরে বসে সহজ-সরলভাবে সবার উদ্দেশ্যে নসিহত করছিলেন। নসিহতের বিষয়টি ছিল-‘সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য’। তিনি বলেছিলেন-‘সন্তান মানুষের জন্য মূল্যবান সম্পদ। দুনিয়ার সৌন্দর্য এই অমূল্য সম্পদকে যেভাবে প্রতিপালন করবেন ঠিক সেভাবেই তারা গড়ে উঠবে। ছেলে-মেয়েকে ইসলামী আদর্শে গড়ে তুললে তারা দুনিয়াতে যেমন উপকারে আসবে তেমনি পিতামাতার জন্য পরকালে মুক্তির উছিলা হবে। অনেক পিতামাতা আপন সন্তানদের শুধু আধুনিক শিক্ষা দিচ্ছেন বড় বড় চাকুরির লোভে। তারা ইসলামি শিক্ষাকে কোনো গুরুত্ব দেন না। এই ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে পিতামাতাকে বাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এরা শিক্ষিত হলেও কোনো মানবিক গুণ তাদের থাকে না। হয়ে উঠে অমানুষ। ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে অজ্ঞ সন্তানরা দুনিয়ায় যেমন উপকারে আসবে না তেমনি মৃত্যুর পরও কোনো কাজে আসবে না। একজন মুসলিম পিতামাতা হয়ে সন্তান লালনপালনের আসল উদ্দেশ্য না জানাটা চরম লজ্জার ব্যাপার।’শফিক চৌধুরী সেদিন কথাগুলো শুনে রাগে ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। তিনি ধারণা করছিলেন, ইমাম বেটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বক্তব্য দিচ্ছে। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে আজ উচ্চ বেতনে চাকুরি করছে। আমি ব্যাংক থেকে চড়া-সুদে ঋণ নিয়ে দু’তলা ভবন দিয়ে বাড়ি বানিয়েছি। সবাই ভাবছে এসব কিছু ছেলেমেয়েদের চাকুরির টাকা দিয়ে করছি। গ্রামের কারো সহ্য হচ্ছে না আমার উন্নতি দেখে। এখন দেখছি এই নগন্য ইমামও হিংসা করছে। মসজিদের মাইকে সবাইকে শুনিয়ে আমাকে অপমান করছে।ইমাম সাহেব আরও বলছিলেন-‘আপনারা মনযোগ দিয়ে শুনুন। হাদিস শরীফে এসেছে-‘জনৈক ব্যক্তিকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন করা হলে সে অবাক হয়ে বলবে, এমন মর্যাদা কোন আমলের বিনিময়ে পেলাম? আমিতো এতো সৎআমল করিনি। বলা হবে, তোমার সন্তানের প্রার্থনার কারণেই তোমাকে এ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।’ মানুষ মৃত্যুবরণ করলে সৎ সন্তানের দোয়া পিতামাতার উপকারে আসে। নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি সন্তানদেরকেও জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে।’ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন শফিক চৌধুরী। মনে মনে বলছেন-‘বেটা ইমাম, আমাকে জান্নাতের লোভ দেখাচ্ছো। আমি জাহান্নামে যাওয়ার মতো কিছুই-তো করছি না। আমার পিতার অনেক জায়গা-জমি ছিল। আমি লেখা পড়া করে চাকুরি করতে না পারলেও কোনো অভাব কখনো বুঝিনি। বাপ-দাদার অনেক জমি বিক্রি করলেও এখনো প্রচুর অবশিষ্ট আছে। মরহুম বাপ-দাদার স্মরণে ঈসালে সাওয়াব মাহফিল করে ইমামকে কোনো দিন দাওয়াত দিয়ে খাওয়াইনি বলে বেটা বেশ চটে আছে। কাউকে দান-সদকা করি না, ইমামকে হাদিয়া দেই না ঠিকই কিন্তু কখনো কোনো পাপ কাজ-তো আমি করিনি। হাদিয়া না পাওয়ার ঝাল ইচ্ছা মতো আজ মেটাচ্ছে। জুমার নামাজ শেষে বেটাকে মজা বুঝাবো।’জুমার নামাজ শেষে ক্ষিপ্ত বাঘের মতো ইমামের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলেন শফিক চৌধুরী। ইচ্ছা মতো মনের খেদ মিটিয়ে ইমামকে গালাগাল করেন তিনি। সেসব কথা আজ ভাবতেও লজ্জা লাগে তার। শরীর ঘেমে উঠে। হৃদপিÐ কাঁপতে থাকে। তিনি স্মরণ করতে লাগলেন, ইমাম সাহেব আর কি কি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। বিছানায় শুয়ে থেকে স্মৃতি হাতড়াতে লাগলেন শফিক চৌধুরী। তার স্মরণ শক্তি বেশ প্রখর। সেদিনের সব কথা ঠিকই স্মরণে চলে এলো। ইমাম সাহেব বলেছিলেন-‘আদর্শ দীনদার সন্তান পেতে হলে প্রথমে নেককার, পর্দানশীন, সচ্চরিত্রের মেয়ে খোঁজে বিয়ে করা উচিত। আল্লাহ পাক পিতা-মাতার হৃদয়ে সন্তানের জীবনের মূল্য ও মর্যাদার প্রবল অনুভূতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সন্তানসন্ততি দান করে তিনি বান্দাদের পরীক্ষা করেন।’‘জেনে রাখুন হে মুসল্লিয়ানে কেরাম, সন্তান জন্মগ্রহণের পর থেকে পরিণত বয়সে পৌঁছা পর্যন্ত পিতামাতার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সেগুলো পালন না করলে আপনার সন্তান বিপদগ্রস্ত হবে। আর আপনিও ইহকাল এবং পরকালে তাদের দ্বারা কোনো উপকার পাবেন না। প্রথমত, জন্মের পরই সন্তানকে গোসল দিয়ে ডান কানে আযান ও বাম কানে একামত দিবেন। এর পর যখন সন্তানেরা কথা বলতে শেখে তখন তাদেরকে কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু শিক্ষা দিতে হবে। এভাবে তাহনিক করা, সুন্দর ও অর্থবহ নাম রাখা আবশ্যকীয়। মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে নামের মাধ্যমে। দুনিয়ার এ নামেই পরকালে সবাইকে ডাকা হবে। এ নামের প্রভাব পড়ে জীবন চলার পথে ও বংশের মধ্যে। রাসূল সা. এরশাদ করেন-তোমরা যখন আমার কাছে কোনো দূত পাঠাবে তখন সুন্দর চেহারা ও সুন্দর নামবিশিষ্ট ব্যক্তিকে পাঠাবে। মহানবী সা. অর্থবহ নয় এমন অনেক নাম পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। জনৈক ব্যক্তি বলেন, তাঁর পিতা একদা মহানবী সা.-এর দরবারে আসেন। রাসুল সা. তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার নাম কী? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘হাজন’ (শক্ত)। মহানবী সা.-এ নাম পরিবর্তন করে ২য় পর্ব সাহল (সহজ) রাখতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পিতা আমার যে নাম রেখেছেন তা পরিবর্তন করবো না। জনৈক সেই ব্যক্তি বলেন, এর পর থেকে আমাদের পরিবারে সদা কঠিন অবস্থা ও পেরেশানি লেগে থাকত।

আপনারা সাধ্যমতো সন্তানের আকিকা করবেন। সাধ্যমতো সন্তানদের জন্য দান সদাকাহ করবেন। একটি হাদিস হচ্ছে-‘রাসুলুল্লাহ সা. হাসান রা. পক্ষ থেকে ১টি বকরী আকীকা দিয়েছেন এবং বলেছেন, হে ফাতেমা ! তার মাথা মুন্ডন করো এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদাকাহ কর।’ হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সঙ্গে বন্ধক থাকে। সুতরাং তার জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে পশু জবেহ করবে, মাথার চুল মুন্ডন করবে ও নাম রাখবে।’ আর পুত্রসন্তানের খাতনার ব্যবস্থা করবেন। খাতনা হচ্ছে সুন্নতে ইবরাহিমি। এটি স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও অনেক উপকারিতা রয়েছে।হে মুসল্লিয়ানে কেরাম, আপনার সন্তানদের অবশ্যই তাওহীদ ও রিসালত শিক্ষা দিবেন। শিশু যখন কথা বলা শুরু করবে তখন থেকেই আল্লাহর একত্ববাদ ও নবীর রিসালত শিক্ষা দিতে হবে। আসমান, চাঁদ-সূর্য, বৃষ্টিতে যে মহান শক্তির হাত তা শুনিয়ে সুকৌশলে ধীরে ধীরে তিলে তিলে শিশুর কোমল হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা-বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভীতির বীজ বপন করে দিবেন। এভাবে কুরআনুল কারীম শিক্ষা দেয়া, দ্বীনি জ্ঞান প্রদান করা পিতা-মাতার জন্য প্রধান দায়িত্ব। মহানবী সা. এর বাণী হলো-‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা ফরজ।’ কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। রাসুল সা. এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের সন্তানকে কুরআন শরীফ নাজেরা পড়ায়, তার আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর যে সন্তানকে হাফেজ বানাবে, তাকে হাশরের ময়দানে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল করে উঠানো হবে, এবং তার সন্তানকে বলা হবে পড়তে শুরু কর। সন্তান যখন একটি আয়াত পড়বে, তখন পিতার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। এ ভাবে সমস্ত কুরআন পড়া হবে এবং মাতা-পিতার মর্যাদাও শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাইতো রাসুল সা.-এর মহামূল্যবান বাণী হলো-‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে-ই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’শফিক চৌধুরী আজকাল পরকালের কথা বারবার ভাবেন। আজ একাকি নিরিবিলি শুয়ে শুয়ে নিজের মধ্যে স্মৃতি রোমন্থনে একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। তার চোখের সামনে যেন কবরের জীবন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। হঠাৎ তিনি অতীতের গøানি এবং পরকালের ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। পাশেই বসা ছিলেন বৃদ্ধা। কাছে এসে স্বামীর মুখের উপর চোখ রেখে জানতে চাইলেন, কি হয়েছে। শফিক চৌধুরী শিশুর মতো কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন-‘আমাদের সন্তানরা আজ থেকেও যেন নেই। দুনিয়ার মোহে পড়ে তাদেরকে ইসলামি শিক্ষার কিছুই শেখাইনি কখনো। এজন্য তারা ইসলামের দেয়া পিতামাতার প্রতি কর্তব্য কিছুই শিখেনি। তারা হয়েছে অমানুষ। তাদের দ্বারা আমরা দুনিয়ায়ও কিছু পেলাম না, পরকালেও কিছুই পাব না। বৃদ্ধ মা-বাবাকে গ্রামের বাড়িতে ফেলে রেখে ছেলেরা স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে শহরে থাকছে। ঈদের ছুটিতেও বাড়িতে আসে না। দেখতে আসাতো দূরের কথা, খবরও নেয় না। আমাদের প্রতি তাদের যেন কোনোই দায়িত্ববোধ নেই!’স্ত্রী শান্তনা দিয়ে বললেন-‘তারাতো আমাদেরকে শহরে নিয়ে যেতে বারবার বলেছে, তুমি রাজি হলে না। তাদের দোষ দিয়ে কী হবে।’ শফিক চৌধুরী দুর্বল হাতে চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে বলেন-‘সব দোষ আমাদের। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও লোভের পরিণতি এটা। আমাদের গ্রামের যেসব পরিবারের সন্তানরা সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামি জ্ঞানার্জন করেছিল তাদের অবস্থা একবার চেয়ে দেখো। চাকুরির পাশাপাশি তারা পিতামাতার খেয়াল রাখে, নিয়মিত বাড়িতে আসা যাওয়া করে, সাধ্যমতো পিতামাতার খেদমত নিজেরা করে যায়।’ স্ত্রী বললেন-‘তোমার কথায় মনে হচ্ছে, আমরা যেন বৃদ্ধাশ্রমে আছি। ছেলেরা চাকুরির কারণে বাড়িতে থাকতে পারছে না। তাদের অভিশাপ দিও না।’ স্ত্রীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শফিক চৌধুরী বললেন-‘গ্রামের এই বাড়িটি না থাকলে আজ আমাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হতো। বাড়িতে আমরা দু’জন ছাড়া কেউ নেই। সবদিকে শুধু শূন্যতা, হাহাকার। সমস্ত বাড়ি যেন গোরস্থানে পরিণত হয়েছে। এরচেয়ে বৃদ্ধাশ্রম মনে হয় ভালো। সেখানে অন্তত কথা বলার মতো মানুষ পাওয়া যেতো।’ তার স্ত্রী আর কথা বাড়ালেন না। তিনিও বুঝতে পারেন স্বামীর মনোবেদনা। স্বামীকে শান্তনা দিয়ে এখন যা-ই বলবেন না কেন, বাস্তবতার রুদ্রমূর্তি তাদের শান্তনাকে বিদ্রƒপ করতে থাকবে। ইসলামি শিক্ষা ব্যতীত মানবসন্তান বাস্তবিকই অমানুষ সন্তান হয়ে বড়ে উঠে। ভেতরে ভেতরে শফিক চৌধুরীর স্ত্রীও মেনে নেন কথাটি।

লেখকঃ মাহবুবুর রহীম

Comments

comments