অভিযাত্রিক প্রকাশনার সাত বছর : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

হঠাৎ করে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার চিন্তা মাথায় আসে। বন্ধুমহলের কয়েকজনকে বিষয়টি অবহিত করলে সাহস যোগান তারা। অতঃপর সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত হলে নাম নির্ধারণসহ সার্বিক পরামর্শের জন্য আমার সাহিত্যগুরু কবি আবু জাফর ছালেহী ও লিখিয়ে সহযোদ্ধা কবি মুহিব্বুল্লাহ জামীর সাথে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা করি। এক পর্যায়ে জামী ভাই অভিযাত্রিক নামটি প্রস্তাব করলেন। আমারও মনের মণিকোটায় এই নামটিই প্রিয় হয়ে উঠল। জামী ভাইকে একটি গ্লোগান তৈরি করার কথা বললাম। তিনি ‘মুখর তারুণ্যের দৃপ্ত মিছিল’ স্লোগানটি আবিস্কার করলেন।
পত্রিকা বের করার পূর্বে কোন প্রেস থেকে ছাপাব তা নিয়ে যখন পেরেশান হয়ে ছুটোছুটি করছি, ঠিক তখনি কবি পিয়ার মাহমুদের সাথে সাক্ষাত হলে তিনি নাজমুল হক নাজু ভাইয়ের তৎকালীন পরিচালনাধীন ‘উদয়ন অফসেট প্রেস’ এর কথা খুব বিশ্বস্থতার সাথে বললেন। আমিও আমার সাথীরা নাজু ভাইয়ের সাথে কথা বলে উদ্বোধনী সংখ্যার লেখা জমা দিলাম। শেষমেষ আগস্ট ২০১০ সালে উদ্বোধনী সংখ্যা বের করলাম। বিশ্বনাথ পুরান বাজারস্থ হাজী ইসমাঈল আলী স্মৃতি পাঠাগারকে কার্যালয় করে আমাদের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু হয়। মাত্র পাঁচজন সাথী নিয়ে অভিযাত্রিক তার যাত্রা শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা পাঁচজন সমানভাগে চাঁদা দিয়ে পত্রিকা বের করি। বিজ্ঞাপন বাবৎ সামান্য কিছু টাকা আমরা পাই। বাদ বাকী নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে পত্রিকা বের করে উদ্বোধনী সংখ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলাম। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কবি কালাম আজাদকে আমরা প্রধান অতিথি করি। বিশেষ অতিথি ছিলেন তরুণ লেখক ও কলামিস্ট বর্তমান বৃন্দাবন কলেজের ইংরেজি প্রভাষক নোমান আহমদ। প্রধান অতিথি কবি মহোদয় উদ্বোধনী সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করে তাঁর বক্তব্যে বললেন-‘আমি অনেক পত্র পত্রিকার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি হই এবং পত্রিকা প্রকাশনার দাওয়াত পাই কিন্তু পত্রিকার সলীল সমাধী কখন যে হয় সে দাওয়াতটুকু পাই না। অভিযাত্রিকের বেলায় যেন এমনটি না হয়।’
উদ্বোধনী সংখ্যায় প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছাড়াও আবু জাফর ছালেহী সম্পাদিত ‘অষ্টধাতু’ ও মুহাম্মদ ছাদীকুর রহমানের ‘মুক্তস্বর’ পাঠকদের দৃষ্টি কাড়ে। দ্বিতীয় সংখ্যা আমরা বের করি ২০১১ সালের জানুয়ারিতে। এ সংখ্যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল মাওলানা কবি রূহুল আমীন খানের সাক্ষাৎকার। প্রিয় কবির এ কালজয়ী সাক্ষাৎকারটি অভিযাত্রিকের জন্য একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। ১ম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যা বের করি এপ্রিল ২০১১ তে। এ সংখ্যা থেকে কথাশিল্পী এম. এ. রাশীদ আল ফারিদীর উপন্যাস ‘নতুন ঠিকানা’ ধারাবাহিক প্রকাশ হতে শুরু করে। তখন কুপনের মাধ্যমে কিছু গ্রাহক সংগ্রহ করি। প্রথম বর্ষের চতুর্থ সংখ্যা বের হয় জুলাই ২০১১ তে। এ সংখ্যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল গাজী মুহাম্মদ জাফর ইমামের নিবন্ধ-‘ইসলাম বিরোধীদের কাছে কিছু প্রশ্ন, কিছু জিজ্ঞাসা’। এ সংখ্যা থেকে তরুণ কথাশিল্পী সালমান ফরিদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিশোর উপন্যাস ‘বাবরের সংগ্রাম’ ধারাবাহিক প্রকাশিত হতে শুরু করে। পরের সংখ্যা বের হয় ডিসেম্বর ২০১১ তে। ৩য় বর্ষের প্রথম সংখ্যা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলার ঈসালে সাওয়াব সংখ্যা বের হয় জানুয়ারি ২০১২ তে। এভাবে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হবার পূর্ব পর্যন্ত (আগস্ট-২০১৩) মোট ১১টি সংখ্যা প্রকাশ পায়। ২০১৩ সালের অক্টোবর সংখ্যা হতে অভিযাত্রিক সরকারি নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধন নম্বর ১৩৪। নিবন্ধনের পর নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে পত্রিকাটি। ধীরে ধীরে পাঠক সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
কবি ও কথাশিল্পী সালমান ফরিদের ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন ‘প্রিথি’ পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় হয়। ধারাবাহিক উপন্যাসের মধ্যে মুহাম্মদ হাবীবুর রহমানের কর্মের ফল, নিবন্ধের মধ্যে মো. নূর উদ্দীনের জ্ঞানের কথা মুমিনের হারানো সম্পদ ও আল্লাহ ওয়ালাদের চরিত্র, মো. ছাদীকুর রহমান অলংকারীর ‘খোদাভীতির উজ্জ্বল নমুনা’, মুহিব্বুল্লাহ জামীর ‘কোরআনের আলো হাদীসের আলো’, মাহবুবুর রহীমের ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশন ‘ধুম্রদের অভিযান’, নূর হোসেন সম্পাদিত পাঁচমিশালী বিভাগ ‘রঙ বাহারি’ পাঠকদের প্রশংসা কুড়ায়। উদ্বোধনী সংখ্যা থেকে টানা পাঁচ বছর যায়েদ বিন আ. সালাম ও মাহবুবুর রহীমের গল্পগুলো এখনও পাঠকেরা খুঁজে বেড়ায়। ছোটদের ‘ফুলের মেলা’ বিভাগে গল্প লিখেছেন জাকির মোহাম্মদ, রিয়াজ উদ্দীন, নুফরাত জেরীনসহ অনেকেই। ২০১৬ সাল থেকে অভিযাত্রিকের গল্পের মিছিল বাড়তে শুরু করে। গল্পের এ মিছিলে একে একে যুক্ত হলেন ফাতেমা জাহান লুবনা, মাহবুবা খন্দকার, নাসরীন সাথী, রহিমা আক্তার মৌ সহ অনেকেই। প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও ফিচার লেখায় এগিয়ে রয়েছেন ‘মাহফুজ আল মাদানী, নুরুল আমিন আজমাদী ও এস. এম. নাজমুস সাকীব। প্রবন্ধ ও গল্প লিখেছেন, আবু জাফর ছালেহী। প্রবন্ধ লিখেছেন মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম পারভেজ, মোহাম্মদ নাজমুল হুদা খান, নোমান আহমদ সহ অনেকেই। গবেষণাধর্মী লেখা লিখছেন মারজান আহমদ চৌধুরী। ইদানিং গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার ও ভ্রমণ কাহিনি লিখছেন মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম ও মোস্তফা কামাল গাজী। সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৪৫টি সংখ্যা বের করেছে অভিযাত্রিক।
সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ফেইসবুকের কল্যাণে নবীন প্রবীণ অনেক লেখক লেখিকা যুক্ত হচ্ছেন অভিযাত্রিকের মুখর তারুণ্যের দৃপ্ত মিছিলে। প্রিন্ট সংখ্যার পাশাপাশি প্রতিমাসে আমাদের নিজস্ব ওয়েব সাইটে যুক্ত করা হয় অনলাইন ভার্সন। এতে বিদেশী ও দূরবর্তী পাঠকরা ওয়েবসাইট লগইন করে প্রতিমাসের পত্রিকা পড়তে পারছেন। লেখক-লেখিকারা তাদের প্রকাশিত লেখা শেয়ার করতে পারছেন ফেইসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।
প্রিয় অভিযাত্রিককে এগিয়ে নিতে পাঠকরা নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও মফস্বলে গঠন করছেন ‘অভিযাত্রিক পাঠক ফোরাম’। এক্ষেত্রে দেশের পাঠকদের সাথে রীতিমত প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে চলছেন প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশি পাঠক বন্ধুগণ। যুক্তরাজ্যের ওল্ডহ্যাম, ম্যানচেস্টার ও লন্ডন সিটিতে মোট ৩টি ফোরাম ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নিইইয়র্ক, ফ্রান্সের মাদ্রিদ ও বার্সোলোনা, গ্রিসের এথেন্স সহ বাহরাইন, মালয়েশিয়ায় গঠিত হয়েছে অভিযাত্রিক পাঠক ফোরাম।

দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফোরামের শাখা প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটছে। ফেইসবুকে আমাদের নিজস্ব অফিসিয়াল পেইজটিও কম জনপ্রিয় নয়। অনলাইনে অভিযাত্রিকের এই জনপ্রিয়তার জন্য অনেক হিংসুকদের নজরে পড়ে আমাদের পেজ ও ওয়েবসাইট। পেজকে রিপোর্ট করে ডিজেবল করার অপচেষ্টা করা হয়েছে বারবার। ওয়েবসাইটটিকে হ্যাক করার জন্য ভুল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে বারবার লগইন করা হয়েছে। এজন্য কর্তৃপক্ষ সামায়িকভাবে নিরাপত্তার জন্য সাইটটি বন্ধ রাখে। হ্যাকারদের এ ন্যাক্কারজনক ষড়যন্ত্রের কালো থাবা রুখে দিয়েছে অভিযাত্রিকের অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইডি ডিপার্টমেন্ট। অপরদিকে অভিযাত্রিকের সম্পাদক জেনে আমার ফেইসবুক একাউন্ট হ্যাক করারও ব্যর্থ অপচেষ্টা করেছে চক্রান্তকারীরা। কিন্তু তাদের সে অপচেষ্টা বারবারই ব্যর্থ হয়েছে মহান আল্লাহর অসীম রহমতে আর অভিযাত্রিক শুভানুধ্যায়ী পাঠকদের ভালোবাসায়।
মাসিক অভিযাত্রিক বিগত সাত বছরের একটা বিশাল প্রাপ্তি দেশ বিদেশে তার বহুল পরিচিতি। ব্যাপক পরিচিতির পিছনে লেখক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর অবদান রয়েছে। অতীব যতেœর সাথে পত্রিকার প্রতি সংখ্যার সৃজনশীল ও দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ তৈরি করেন ঐতিহ্যবাহী ঘাস প্রকাশন ও ছাপাকাননের কর্ণধার কবি নাজমুল হক নাজু। অভিযাত্রিকের প্রচ্ছদ কভারে নান্দনিকতার যে সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে-তা সচেতন ও বোদ্ধা পাঠকমহলের কাছে সহজেই অনুমেয়।
মাসিক অভিযাত্রিক নিয়মিত প্রকাশনার পাশাপাশি অভিযাত্রিক প্রকাশনা থেকে আমরা সৃজনশীল বই পুস্তক প্রকাশ, হামদ, নাত ও ইসলামী সংগীতের অ্যালবাম প্রকাশ করে আসছি। অভিযাত্রিক টিভি নামে একটি অনলাইন টিভি চ্যানেল চালু করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ইসলাম বিদ্বেষী চক্রের আস্ফালন, লা-মাযহাবী ও সালাফীদের উত্থান, সর্বোপরী ইসলামের সঠিকবাণী প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে আজ ইসলামী মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তা সময়ের দাবী। অভিযাত্রিক টিভি ও সেই প্রত্যাশা পূরণের প্রত্যয়ী।
মাসিক অভিযাত্রিকের এখন প্রয়োজন নিয়মিত কয়েকটা বিজ্ঞাপন। পত্রিকা নিয়মিত বের হওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন অনেকটাই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ ব্যাপারে সুস্থ সাহিত্য সংস্কৃতির লালনকালী সুধী ব্যবসায়ীমহল ও আর্থিক সামর্থবান এগিয়ে আসলে পত্রিকা উপকৃত হবে।
সকল দুর্নীতি, দুঃশাসন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সীসাঢালা প্রাচীর হতে চায় অভিযাত্রিক। তাই দল মত নির্বিশেষে সকলেই অভিযাত্রিকের হাতকে শক্তিশালী করুন।
পরিশেষে, অভিযাত্রিক ছড়িয়ে যাক দেশ-বিদেশের প্রান্তরে প্রান্তরে। সকল বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে পৌঁছে যাক অভিযাত্রিকের আহ্বান। মুখর তারুণ্যের দৃপ্ত মিছিলে যুক্ত হোক আরো সৃজনশীলতা ও নতুনমাত্রা। অভিযাত্রিকের হোক আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম মুখপত্র। মহান আল্লাহও তাঁর প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্তুষ্টি ও সিরাতাল মুসতাকীমের পথে এই অভিযাত্রা দুর্বার ও দুর্নিবার হোক, কবুল হোক অভিযাত্রিকের সব আয়োজন, মাওলায়ে হাকীকীর দরবারে এই কামনা সতত।

Comments

comments

About

Check Also

ইবাদতের বসন্তকাল রমজান

ঋতুরাজ বসন্ত যেমন প্রকৃতিতে অপার সৌন্দর্যের মোহনীয় রূপ এনে দেয়। তেমনি রমজান মাস পরওয়ারদেগারের পক্ষ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *