স্পেনে ইসলাম ও মুসলমান

স্পেন তিনদিকে সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিতে। পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণে জিব্রাল্টার প্রণালী ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর। স্পেনের সঙ্গে ফ্রান্সের যে ভূখণ্ড সংযুক্ত, তা হচ্ছে প্রায় তিনশত মাইল পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত পিরেনিজ পর্বতমালা। মুসলমানদের শাসনামলে স্পেনের নাম ছিলো আন্দালুস। ইসলামপূর্ব সময়ে চির সৌন্দর্যময় এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক অবস্থা ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়। তখন গথিক রাজাদের শাসন চলছিলো স্পেনে। তাদের সময়ে শাসক আর শোষিত-দুটি শ্রেণীর অস্তিত্ব পাওয়া যেতো। গথিক রাজাদের ৩০০ বছরের শাসিত সময়ে স্পেনের জনসাধারণের কোনোরূপ কল্যাণ সাধিত হয়নি। বরং তারা শাসক শ্রেণির দ্বারা নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হতো। ছিলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। ইহুদিদের সদা ভূমিদাস, কৃতদাস আর বর্গাদার হয়ে থাকতে হতো। মনিবের অনুমতিক্রমে বিয়ে করতে পারলেও সন্তান জন্ম দেয়ার অধিকার ছিলো লুপ্ত। এমন কষ্ট সইতে না পেরে তারা মনিব থেকে পালিয়ে গিয়ে জড়িয়ে পড়তো দস্যুবৃত্তিতে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বলতে গেলে ছিলোই না। ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে ৯০ হাজার ইহুদীকে বলপূর্বক খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। ঘোষণা করা হয়, খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করতে হবে নতুবা দেশ ত্যাগ করতে হবে। সমগ্র ইউরোপ ছিলো শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর, হীনমন্য এবং জ্ঞান-বুদ্ধিতে জড় এক আড়ষ্ট জনপদ। গৃহযুদ্ধ আর অন্তর্কলহ তদানীন্তন স্পেনের রাজনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিলো। তাদের ভেতরকার এসব খারাপ পরিস্থিতিই মূলত স্পেনে মুসলমানদের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত করে। মুসলমানদের বিজয়ের পূর্বে গথিক রাজা রডারিক পূর্ববর্তী রাজা উইটিজাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে। ফলে উইটিজার ভ্রাতা, পুত্র আর জামাতা সবাই রডারিকের বিরোধী হয়ে ওঠে। অপরদিকে কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যা ফ্লোরিডা রাজা রডারিক কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়। এতে কাউন্ট জুলিয়ান রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে রডারিকের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্ণর মুসা বিন নুসাইরকে (র.) স্পেন আক্রমনের অনুরোধ করে। মুসা বিন নুসাইর (র.) খলিফার অনুমতিক্রমে তারেক বিন জিয়াদের (র.) এর নেতৃত্বে ৩০০ আরব এবং ৭০০০ বার্বার সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি ছোট দলকে স্পেন অভিযানে প্রেরণ করেন। এরপরে এ সৈন্যসংখ্যা বারো হাজারে উন্নীত হয়। অপরদিকে রডারিকের সৈন্যসংখ্যা ছিলো ১ লাখেরও উপরে। তারিক বিন জিয়াদ (র.) জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করেন। তিনি যে স্থানে ঘাটি স্থাপন করছিলেন, তা আজও জাবালুত তারিক নামে পরিচিত। ৭১১ সালের ১৯ জুলাই ওয়াদি লাস্কের নিকটবর্তী সারিস বা জেরেখে মুসলিম ও গথিক বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ‘ওয়াদি লাস্কে’র যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে রাজা রডারিক শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হন। ফলে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজধানী কর্ডোভার এবং মূল রাজধানী টলেডোর পতন ঘটে। মুসলিম সৈন্যরা একে একে বিভিন্ন শহর জয় করতে থাকেন।

এভাবে মাত্র দুই বছরে পুরো স্পেন জয় হয়ে দামেস্কের শাসনভার উমাইয়া খিলাফতের অধীনে চলে আসে। মুসলমানদের আগমনের কারণে স্পেনে বয়ে যায় শান্তি-সুখের হাওয়া। বঞ্চিত জনসাধারণ ফিরে পায় তাদের হারানো স্বাধীনতা। মুসলমানদের অনুপম আদর্শ দেখে মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। বিশেষ করে দাস এবং নিম্নবর্ণের লোকেরা ইসলামের সাম্য সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সমস্ত ধর্ম এবং বর্ণের মানুষেরা পায় নিজ ধর্ম পালন আর মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অধিকার। প্রকৃতপক্ষে এ সময় থেকেই ইউরোপে মুসলিম রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়। মুসলমানগণ ৭১১ সাল থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত স্পেন শাসন করেন। প্রথমদিকে মুসলিম শাসকদের খোদাভীতি আর ন্যায়পরায়ণতায় স্পেনে কুরআনি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল প্রকার অশান্তি, পেরেশানি, দ্বন্দ্ব-বিবাদ, বিদ্রোহ থেকে মুক্তি পায় সাধারণ মানুষ। কিন্তু শেষের দিকে মুসলিম শাসকদের আন্তঃকলহ, বিরোধিতা, ক্ষমতার লোভ, গানবাদ্য, নারী, ভোগ-বিলাসে মত্ততা, নৈতিকতার অবক্ষয়, বিরোধী শক্তিদের একাত্মতা, ষড়যন্ত্র, ইসলাম বিদ্বেষিতা, বিদ্রোহী শক্তির একাত্মতা, বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থতা সব মিলিয়ে মুসলিম খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের রাজ্য ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শত্রুদের বিরুদ্ধে ক্ষণে ক্ষণে লড়াই অব্যাহত থাকে। আবার মুসলমানরাও নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই সুযোগে মুসলমানদেরকে স্পেন থেকে সমূলে উৎখাত করতে পর্তুগিজ রাণী ইসাবেলা পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান রাজা ফার্দিনান্দকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর দুজন মিলে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম নিধনের। খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল-াস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায়। সেদিন ছিলো ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাসঘাতকতায় বলি হয় গ্রানাডার হাজার হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ। নিরাপত্তার জন্যে মুসলমানরা আশ্রয় নেয় মসজিদে। কিন্তু খ্রিষ্টানরা মসজিদে তালা লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় মুসলমানরা। চিরতরে হারিয়ে যায় তাদের আটশত বছর স্পেন শাসনের গৌরবময় স্মৃতি। স্পেন থেকে মুছে যায় ইসলামের শেষ চিহ্নটুকুও। এভাবে পুনরায় স্পেন চলে যায় অমুসলিমদের হাতে। এখনও সেখানে বিধর্মীদের শাসন অব্যাহত। তবে দাওয়াত ও তাবলিগের ফলে স্পেনের মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় ক্রমেই আশ্রয় নিচ্ছে। দিন দিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিই পাচ্ছে। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে স্পেনের সাড়ে চার কোটি জনসংখ্যার ৪.৫ ভাগ মুসলিম। ২০২৭ সালে স্পেনে মুসলিম জনসংখ্যা ৭ লাখে দাঁড়াবে, যা হবে জনসংখ্যার প্রায় ১৪ ভাগ। মুসলমানদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে সখানে নির্মিত হচ্ছে অধিক হারে মসজিদ-মাদ্রাসা। সরকার থেকেও পাচ্ছে সুযোগ-সুবিধা আর নিরাপত্তা। মুসলমানদের সংখ্যা এভাবে বৃদ্ধি পেলে একসময় হয়তো স্পেন আবার হয়ে উঠবে মুসলিম প্রধান দেশ।
-তথ্যসূত্র: আল ইসলামু ফিল আন্দালুস

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *