সৌদি-ইরান যুদ্ধ কি আসন্ন?

গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সৌদি আরবের তেল স্থাপনা আবকাইক শোধনাগার এবং খুরাইস তেলক্ষেত্রের ওপর অত্যাধুনিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে আক্রমণ চালানো হয়েছে। ইরান সমর্থিত ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা বলছে, তারাই এ আক্রমণ চালিয়েছে এবং ভবিষ্যতে সৌদি আরবের ওপর তাদের আক্রমণের পরিধি আরো সম্প্রসারিত করা হবে। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি ও গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে আমেরিকা দাবি করেছে, ইরান-ই ওই হামলার জন্য দায়ী। সৌদি আরবও ঠিক একই মনোভাব নিয়ে বলেছে হামলার জন্য ইরান দায়ী। যদিও ইরান ওই হামলার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। আমেরিকা গত শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯) সৌদি আরবের তেল স্থাপনাগুলো হামলা থেকে রক্ষার জন্য সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে সৌদি আরবে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে। সৌদি আরবে মার্কিন সেনা পাঠানোর ঘোষণা আসার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইরান। ইরানের এক সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা হুমকির সুরে বলেছেন, ইরানের অভ্যন্তরে কোনো প্রকার হামলা তারা বরদাশত করবে না। আক্রমণকারী যেকোনো দেশকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে ইরান। ইরান, সৌদি ও আমেরিকার এ রকম উত্তপ্ত বাকযুদ্ধ ও হুমকি ধামকি দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছে সৌদি আরব কি আমেরিকার সাহায্যে ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে?
তবে যে মাত্রায় হামলার ঘটনাটি ঘটেছে সৌদি আরব তা কোনমতেই এড়িয়ে যেতে পারবে না এবং ইরানই যে ওই হামলার জন্য দায়ী সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর সৌদি আরবকে অবশ্যই একটা পাল্টা জবাব দিতে হবে। সে জবাবটা কি শুধুই প্রাণঘাতী যুদ্ধ? এই প্রশ্ন অনেক বিজ্ঞজনই করছেন। যুদ্ধ কখনো কোন সমাধানের পথ বের করে না বরং জটিলতার সৃষ্টি করে। আমরা জানি, ইতিমধ্যে সৌদিআরবের হাত অনেক নিরীহ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। সৌদি তার মিত্রদের সাথে নিয়ে ইয়েমেনের সাথে অবিবেচনাপ্রসূত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। এই অসম যুদ্ধে মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে অধিকাংশই নিষ্পাপ শিশু ও বৃদ্ধ। তাই সৌদিআরব যদি আমেরিকার ফাঁদে পা দিয়ে তাদের অহংকারী মনোভাবের কারণে ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়ায় তাহলে নিঃসন্দেহে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে এক কালো অধ্যায় শুরু হবে এবং লক্ষ লক্ষ মুসলমানের প্রাণহানি ঘটবে। ইতিমধ্যে ঐ হামলার ঘটনাটি জাতিসংঘ তদন্ত করে দেখছে। সেই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সৌদি সরকারকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে সৌদি কখনো এককভাবে কোন পদক্ষেপ নেয়ার যোগ্যতা রাখেনা। আর এখন তাদের প্রতিপক্ষ যেহেতু শক্তিশালী ইরান, তাই তাদেরকে অবশ্যই মিত্র শক্তি আমেরিকার সাহায্য নিতেই হবে । সৌদি আরবের সামরিক বাহিনী যে কতোটা দুর্বল সে সম্পর্কে ব্রিটেনের জাতিয় পত্রিকা “ঞযব এঁধৎফরধহ” একটি হাস্যকর মন্তব্য করে বলেছে; ঝধঁফর অৎধনরধ ড়িহ’ঃ ধঃঃধপশ ওৎধহ নঁঃ রঃ সধু ঢ়ধু ংড়সবড়হব বষংব ঃড় ধঃঃধপশ রহ ঃযবরৎ নবযধষভ! ঞযবৎব রং ধ ষড়হমংঃধহফরহম লড়শব ঃড়ষফ রহ ঃযব গরফফষব ঊধংঃ ধনড়ঁঃ ঝধঁফর অৎধনরধ’ং ৎবষঁপঃধহপব ঃড় ভরমযঃ রঃং ড়হি ধিৎং.
অর্থ: সৌদিআরব কখনো ইরানে আক্রমণ করবে না; হয়তোবা অন্য কাউকে তার পক্ষে আক্রমণ করার জন্য পারিশ্রমিক দিবে! মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম একটি জোক (ঠাট্টা) হলো, সৌদিআরব তাদের নিজেদের যুদ্ধে অনিচ্ছুক!!
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমেরিকা ও তার মিত্র শক্তি ইসরাইল চায় ইরানের সাথে সৌদিআরব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়–ক! কারণ, যুদ্ধ হলে কোন না কোন ভাবে আমেরিকা ও ইসরাইল লাভবান হবে। সৌদিআরবের কাছে পরীক্ষামূলক তাদের অস্ত্রশস্ত্রও বিক্রি করতে পারবে! তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের একক প্রধান্যও সৃষ্টি হবে! আমেরিকা তো অনেকদিন ধরে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে দেশটির ওপর সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টির নীতি গ্রহণ করেছে এমনকি সম্প্রতি সামরিক হামলারও হুমকি দিয়েছে। তবে ইরানও সম্ভাব্য সামরিক হামলার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোয় এবং ইরানের ব্যাপারে ড্রোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে আমেরিকার ভেতরে ও বাইরে এমনকি ইউরোপীয় মিত্ররাও অবস্থান নেয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে হামলার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে।


প্রতিবেশী দেশ অথচ চিরশত্র“ ইরান ও আমেরিকার মধ্যে সৃষ্ট যুদ্ধ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ইতিপূর্বে সৌদিআরব পবিত্র মক্কা নগরীতে উপসাগরীয় মুসলিম দেশগুলোর জরুরী সম্মেলন ডেকেছিল। প্রায় সব মুসলিম প্রধান দেশ যে সৌদি আরবের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মক্কায় উপস্থিত হয়েছে তা বোঝাতে ইরান বিরোধী এই সম্মেলনটি ডাকা হয়েছিল ৩০ মে ২০১৯। ওয়াশিংটনে অবস্থিত আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউট এর বিশেষজ্ঞ হুসেইন আইবিশ বার্তা সংস্থাটিকে বলেন, রিয়াদের লক্ষ্য হলো এই সম্মেলনের মাধ্যমে “আরব ও মুসলিম সমর্থনকে ঐক্যবদ্ধ রেখে (সৌদি আরব) সরাসরি যুদ্ধের পথে হাঁটবে, না কী কূটনীতির আশ্রয় নিবে” সেই পথ খুঁজে নেওয়া। এদিকে দিনে দিনে জটিল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি। ইরানের ওপর চলছে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোরতম অবরোধ। সৌদিআরবের সঙ্গে ইরানের দীর্ঘদিনের শত্রুতা থাকলেও তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সেই সম্পর্কও নষ্ট হয় ২০১৬ সালে। সে বছর সৌদি আরবের একজন শীর্ষ শিয়া নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে ইরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায় ইরানের প্রতিবাদকারীরা। এর পর পরই প্রতিবেশী অনুগত রাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদিআরব। সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলোর অভিযোগ; ইরান বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে এবং এসব আরব দেশে সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তুলছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ মে মাসে এক টুইটার বার্তায় বলেন, “এই সঙ্কটময় মুহূর্তে প্রয়োজন একতা এবং সমন্বয়। সৌদি আরব সেই (নেতৃত্বের) ভূমিকা পালন করার যোগ্যতা রাখে।” বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের বিরুদ্ধে সব মুসলিম দেশকে একত্র করা সৌদি আরবের জন্যে খুবই কঠিন কাজ হবে। বিশেষ করে যেসব দেশ ইরানের তেলের ওপর নির্ভরশীল তারা কখনো দেশটির বিপক্ষে সশস্ত্র অবস্থান নিতে চাইবে না। ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির গবেষক “সিমন হেন্ডারসন ও একই সুরে কথা বলেনছেন! তিনি বলেন: “অনেক দেশ হয়তো ইরানকে পছন্দ নাও করতে পারে কিন্তু, তারাই আবার চেষ্টা করবে ইরানের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলতে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্র“পের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান আবারো তাদের “পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের শক্তির জানান দিচ্ছে। এছাড়াও, সৌদি বা আমিরাতের তেল রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করে নিজের শক্তি প্রমাণ করেছে ইরান।” এমন পরিস্থিতিতে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জাবের সম্প্রতি এক বার্তায় বলেছেন যে তার দেশও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। কিন্তু, ইরানকে জানাতে চায় যে সৌদি আরব তার স্বার্থ রক্ষায় সবসময়ই প্রস্তুত রয়েছে।
সৌদি আরব খুব সম্ভব শক্তিশালী ইরানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ এড়াতে চায়! তাইতো ইরান সৌদির উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই দেশটিতে ডিপ্লোমাটিক সফরের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নিমন্ত্রণ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এ মুহূর্তে সৌদি আরবে রয়েছেন। আশা করা যায় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেয়া বক্তৃতায়ও কাশ্মীর প্রসঙ্গের সাথে সাথে ইরান ও সৌদির প্রসঙ্গেও কথা বলবেন ইমরান খান। যুদ্ধ বিগ্রহ এড়িয়ে কূটনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান হলে মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি উপসাগরীয় যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। বিশ্বের শান্তিকামী প্রতিটি মানুষ সেই কামনাই করে।
সৌদি-ইরান সঙ্কট নিরসনে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পথ উন্মুক্ত হোক। ইরানিরা যেমন আমাদের ভাই, সৌদি এবং অন্যান্য আরবরাও আমাদের ভাই। আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে আর কোনো দ্বন্দ্ব চাই না বরং মিলেমিশে থাকতে চাই। আমরা নিজেদের মধ্যে কোনো অনৈক্য, দূরত্ব ও বিভাজন চাই না। আমরা চাই স্থিতিশীল সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে সকলেই এগিয়ে যাক। শত্র“তার বিপরীতে মিত্রতার বন্ধন অটুট হোক। ভালোবাসা, সৌহার্দতা আরও দৃঢ় হোক। হৃদ্যতা আরও গভীর হোক। আমেরিকা ও ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ হোক।

তথ্যসূত্র:
১. বিবিসি নিউজ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
২. ঞযব এঁধৎফরধহ ২২হফ ঝবঢ়ঃবসনবৎ ২০১৯.
৩. উধরষু ংঃধৎ ২৮ঃয গধু ২০১৯, ও বার্তা সংস্থা এএফপি
৪. বিবিসি সংবাদ ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *