সৌদিআরব অপবিত্র করার পায়তারা

মুসলমানদের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে মক্কা আল মোকাররমা এবং মদিনা আল মুনাওয়ারাকে বিবেচনা করা হয়। সৌদি আরবের বর্তমান ভূখণ্ড মুলত জাযিরাতুল আরবের অংশ ছিল। মুহাম্মদ বিন সৌদ ১৭ শতকের কোন এক সময় নজদের নির্বাসিত বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের মেয়ের সাথে তার পুত্র আবদুল আজিজের বিয়ে দেন। এভাবেই সৌদ পরিবার ও ওয়াহাবী মতবাদের মিলনযাত্রা শুরু হয়। সৌদ পরিবার ও মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব একত্রে ওয়াহাবী বা খারেজী মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ইবনে আব্দুল ওয়াহাব মুহাম্মদ বিন সৌদকে বলেন, “আমি চাই আপনি উসমানী শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন, বিনিময়ে আপনি হবেন মুসলিম উম্মাহর ইমাম, আর আমি হব ধর্মীয় বিষয়াদির দায়িত্বশীল নেতা।” এই চুক্তির ফলে পরবর্তীতে ১৭৪৪ সালে “দিরিয়া আমিরাত” গঠন করে। ওই “দিরিয়া আমিরাত” বিশ্বের প্রথম সৌদি রাজ্য বা আমিরাত। আবদুল আজিজ তৎকালীন বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী মোড়ল ব্রিটেনের সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সহযোগীতা ও আব্দুল ওয়াহাব নজদির সেই ঐক্যের ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে আব্দুল আজিজ ইবনে সৌদ ১৯৩২ সালে জাযিরাতুল আরব নাম পরিবর্তন করে সৌদি আরব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সৌদ পরিবার মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক উসমানিয়া খিলাফত ভেঙে ওয়াহাবী মতবাদ ব্যবহার করে বিগত বছরগুলোতে পুরোপুরি রাজতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং আইনের ক্ষেত্রে মুঠামুটি ইসলামি আইনের অনুসরণ করে থাকলেও সম্প্রতি দেশটি মোড় নিচ্ছে নগ্নতা ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে। ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারী বাদশাহ আব্দুল্লাহ মারা যাবার পর তার পদে স্থলাভিষিক্ত হন প্রিন্স সালমান বিন আব্দুল আজিজ। সম্প্রতি এক ফরমান জারির মাধ্যমে বাদশাহ সালমান তার ভাতিজা ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ‘ক্রাউন প্রিন্স’ বা যুবরাজের উপাধিতে ভূষিত করেন। সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে ডজনেরও বেশি উত্তরাধিকারী যুবরাজকে পেছনে ঠেলে তাকে সামনের কাতারে নিয়ে আসা হয়। যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে ঘোষণা দেন সৌদি আরবে ফিরিয়ে আনা হবে ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’, তার দেশে ইসলামী রক্ষণশীলতা ভেঙে মধ্যপন্থী ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা হবে, অর্থাৎ আমেরিকা বা পশ্চিমা কালচারের আদলে সৌদি আরবকে পরিচালিত করা হবে। তার এই ঘোষণার মাধ্যমে সৌদি আরবের আকাশে এক অশনি সংকেত দেখা দিচ্ছে! সৌদি আরবের ইসলামী মূল্যবোধকে ধবংস করে অপবিত্র করার ঘৃণ্য প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। যুবরাজ সালমানের গর্হিত কাজে শুধু মুসলিম বিশ্বই শঙ্কিত নয় বরং পশ্চিমা বিশ্বেও শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া! ব্রিটেনের জাতীয় পত্রিকা ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এর রিপোর্টার সামুয়েল ওজবর্ণ বলছেন:
চৎরহপব গড়যধসসবফ নরহ ঝধষসধহ-ধ পড়হঃৎড়াবৎংরধষ ভরমঁৎব যিড় যধং নববহ ফবংপৎরনবফ ধং “ঃযব সড়ংঃ ফধহমবৎড়ঁং সধহ রহ ঃযব ড়িৎষফ”
অর্থঃ প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান একজন বিতর্কিত ব্যক্তি যাকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ডেঞ্জারাস (বিপজ্জনক) মানব বলা যায় ।

সৌদি আরবের ক্ষমতাধর ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবকে একের পর এক পরিবর্তনের মাধ্যমে অপবিত্র ও কলুষিত করে চলেছেন। রিয়াদে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের এক সম্মেলনে ঘোষণা দিয়ে লোহিত সাগরের তীরে ৫০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নতুন মেগা সিটির গোড়াপত্তন করেন এবং সেখানে আলাদা আইন চলবে বলে ঘোষণা দেন। সালমান বলেন, ‘আমরা পশ্চিমা কালচারের আদলে স্বাভাবিক ও আধুনিক জীবন চাই। যে জীবনে ধর্মের মানে হচ্ছে সহনশীলতা ও দয়ার ঐতিহ্য।’তিনি বলেন, ‘ধ্বংসাত্মক ধ্যান-ধারণা নিয়ে আমরা আর চলতে চাই না। সেগুলো আজ থেকেই ধ্বংস করে ফেলা হবে। আমরা শিগগিরই চরমপন্থার অর্থাৎ ইসলামী মূল্যবোধের ইতি টানব। সৌদি যুবরাজ বলেন প্রযুক্তিনির্ভর শহর থাকবে নারী-পুরুষের অবাধে চলাফেরা। সৌদি নারীরা পশ্চিমা নারীদের মত গাড়ি চালাবে। পুরুষের পাশাপাশি মাঠে বসে খেলা দেখার সুযোগ পাবে। সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। সমুদ্র সৈকতে মেয়েরা বিকিনি পরে চলবে! ক্যাসিনো বা জুয়ার আড্ডাখানায় আরবরা মেতে উঠবে। সৌদির ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা খর্ব করে তিনি দেশের অভ্যন্তরে ইসলামী শরিয়তের বিধানকে আরো খর্ব করেছেন। সৌদি আরবে বহু বছরের প্রথা ভেঙে নানান সংস্কারের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসা কুড়িয়েছেন সৌদি যুবরাজ। প্রশংসা তাকে হয়তো আরও উগ্র ও অপবিত্রতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। তবে এর পরিণাম কি হতে পারে তরুণ এবং বিলাসি এই যুবরাজ কি কখনো ভেবেছেন? বিশেষজ্ঞরা অনেকেই বলছেন যে সৌদি যুবরাজ বয়স এবং অনভিজ্ঞতার কারণে বিপজ্জনক খেলায় মেতেছেন। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন তার পূর্বসূরি বাদশাহ ফয়সাল ষাট এবং সত্তরের দশকে সৌদি আরবে ব্যাপক পরিবর্তন এর চেষ্টা করেছিলেন ফলে ১৯৭৫ সালে বাদশাহ ফয়সালকে হত্যা করে দেশটি কট্টর রক্ষণশীলদের শাসনে চলে যায়।
যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, ধর্মীয় সহনশীলতা, নারীর প্রতি উদারতা, তরুণদের প্রাধান্য দিয়ে সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ, চলচ্চিত্র প্রদর্শন, আঞ্চলিক রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকা ইসরাইলের সঙ্গে হঠাৎ মৈত্রী, শত্রু দেশগুলোর প্রতি আরও কঠোরতা প্রদর্শন, এমন একের পর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনায় তিনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একের পর এক একক সিদ্ধান্ত, সৌদি আরবের ইসলামী মূল্যবোধকে অপবিত্র, স্বৈরতন্ত্র ও আঞ্চলিক যুদ্ধের পথ তৈরি করছে না তো! ইয়েমেন যুদ্ধে মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে তাকে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার জন্য তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করা হচ্ছে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে বর্তমানে সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো শাসক মনে করা হয়। ইতিপূর্বে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিলনা। হঠাৎ করে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের মাধ্যমে সম্প্রতি দ্রুতগতিতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছে। মুসলমানদের চিরশত্র“ ইসমাইলের সাথে মধুর সম্পর্ক নিঃসেন্দেহে মুসলিম বিশ্বের জন্য এক অশনি সংকেত!!
যুবরাজ সালমান বর্তমানে সৌদি আরবে উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করছেন।
অচিরেই যুবরাজ তার বয়স্ক ও অসুস্থ বাবা বাদশাহ সালমানের মৃত্যুর পর ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ক্ষমতায় বসবেন। অথচ এর আগেই কোনো বাধা ছাড়াই তিনি একের পর এক সিদ্ধান্ত কার্যকর করছেন। তিনি সেসব বিষয়েই সংস্কার আনছেন যা ইসলাম তথা মুসলমানদের জন্য ঈমান বিধ্বংসী, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উসকানিমুলক ও ক্ষতিকর । যদিও যুবরাজের এসব পদক্ষেপ মিসর ও জর্ডানের মতো সুন্নি দেশ, পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন জয় করেছে। তবে এসব ঘটনায় এমন প্রশ্নও উঠে আসে যে ক্রাউন প্রিন্সের এই আচরণ এই অঞ্চলের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের স্থিতিশীলতা রক্ষায় আদৌ অবদান রাখছে কি?
যুবরাজের সংস্কারে তথাকথিত সংস্কারপন্থীরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও তিনি যে দেশকে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন সে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ।
হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেমের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্লোমো আভেনারি এ ব্যাপারে দীর্ঘ প্রবন্ধে বিশ্লেষণ তুলে ধরেন ইসরায়েলের দৈনিক পত্রিকা হারেটজে। গত বৃহস্পতিবার (৫ এপ্রিল ২০১৮) হিব্রু ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ওই পত্রিকায় শ্লোমো আভেনারি বলেন, যুবরাজের সংস্কার সারা বিশ্বে প্রশংসা কুড়ালেও এটা একনায়কতন্ত্র ও আঞ্চলিক যুদ্ধ সৃষ্টির পথ রচনা করতে পারে। বন্ধু ভেবে সৌদি আরব হঠাৎ করে ইসরায়েলের সঙ্গে ঐক্য বাঁধলেও আভেনারি ইসরায়েলী নেতৃত্বের ব্যপারে যুবরাজকে সতর্ক থাকতে বলেছেন। গবেষণাধর্মী এবং ব্যাখ্যামূলক ওই লেখায় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সোভিয়েত যুগে গর্বাচেভ এত এত সংস্কার এনেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। ক্ষমতায় থাকতে পারেননি গর্বাচেভও। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে একই ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ফলাফলের দায় তাকেও নিতে হতে পারে।
রাজনৈতিক গবেষক ও বিশ্লেষকদের লেখায় সৌদি আরবের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে সবাই শঙ্কিত। মোহাম্মদ বিন সালমানের অধীনে পরিচালিত সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে, এটা এখন এক অনিশ্চিত দুঃস্বপ্নের মত। ইসলামী মূল্যবোধে আঘাত ও ইসরায়েলের জন্য সুবিধা হয় এমন বিষয়ে সমর্থন দিয়ে যদি ক্রাউন প্রিন্স তার কর্মকাণ্ডে সাফল্য পান, তাহলে আরব বিশ্বে আরেকটি একনায়ক নেতৃত্বের উদ্ভব হবে।
মুসলমানদের পবিত্র ভূমি অপবিত্র করার ঘৃণ্য প্রয়াস প্রতিফলিত হবে।
একমাত্র সময়ই বলে দেবে, যুবরাজ সালমানের সংস্কারগুলো শেষ পর্যন্ত সৌদি আরবকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে । বিশ্ব মুসলিমরা বসে বসে যদি আঙ্গুল চুষেন তাহলে পশ্চিমাদের এই ঘৃণ্য প্রয়াস আপনার আমার দেশের আকাশে দুর্বিসহ সাইক্লোন নিয়ে আসবেনা এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা। সৌদিআরবকে অপবিত্র করার ঘৃণ্য পায়তারা ও মুসলিম বিশ্বের অশনি সংকেত ঠেকাতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই । আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

তথ্যসূত্র :
১. আখবারে মাক্কা ওমা জা’আ ফীহা মিনাল আ’সার, লেখক: আবু ওয়ালিদ মোহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আরঝাক্বী ।
২. এ হিস্ট্রি অব সৌদি আরব , ক্যামব্রিজ প্রেস ২০০২, লেখক: মাদউই আল রাশীদ।
৩. ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট, শুক্রবার ২২ জানুয়ারী ২০১৬, রিপোর্টার: সামুয়েল ওজবর্ণ
৪. প্রথম আলো ০৮ এপ্রিল ২০১৮

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *