সিরিয়ায় গণহত্যা : বিশ্ববিবেক নির্বিকার

নীরব কেন বিশ্ববিবেক
কাঁদছে দেখ সিরিয়া,
মজলুমানের কাঁদন দেখে
চাওনা কেন ফিরিয়া ॥
নিরীহ নারী-পুরুষ, শিশুর রক্তে স্নাত সিরিয়ার মাটি, বাতাসে বারুদের গন্ধ, সিরিয়ার ওই মজলুমরা করছে শুধু ফরিয়াদ, চাইছে খোদার রহম, কাঁদছে মানবতা, কিন্তু কোথায় আজ বিশ্ব বিবেক, বিশ্ব মোড়ল, কেন আজ বিশ্ববাসী নীরব?
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত রাষ্ট্র হচ্ছে সিরিয়া। একজন মুমিন মুসলমানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও একটি পবিত্রতম ভূখণ্ড হলো সিরিয়া। সিরিয়া সম্পর্কে নবী (সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অনেক হাদিসও আছে। বর্তমানে সিরিয়ার প্রাচীন নাম হলো শাম, এই শামের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরকতের দোয়া করেছেন: ইবনে উমার (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, হে আল্লাহ! আমাদের শামে (সিরিয়া) ও ইয়ামেনে বরকত দান করুন। (সহিহ বোখারি : ১০৩৭)। প্রিয় নবী যে দেশের জন্য দোয়া করলেন আজ সে দেশেই জালিম শাসকদের জুলুমের কারণে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। যারা আজ নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে আল্লাহর গজব এবং তার হাবিবের বদ দোয়া থেকে তারা কখনো পরিত্রাণ পাবেনা। বিশ্ব বিবেক এবং বিশ্ব মোড়লরা যতই নীরব থাকেনা কেন ইনশাআল্লাহ এর বিচার একদিন হবেই।

সিরিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং বিশ্ববিবেক
আরব বসন্তের বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০১০ সালে। জুলাই ২০১১ সালে বাশার আল-আসাদ বিরোধী জোট দামেস্কের রাস্তায় সরকার বিরোধী বিক্ষোভ করে। তাদের সাথে সেনাবাহিনীর দলত্যাগী ফ্রি সিরিয়ান সেনারাও সরকার বিরোধী দল গঠন করে এবং যুদ্ধ ইউনিট তৈরি করে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। বিক্ষোভকারীদের বিপক্ষে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। সেদিন দামেস্কের রাস্তায় শুরু হওয়া বিচ্ছিন্ন সংঘাত আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। (গ্লোবাল পিস ইনডেক্স ২০১৬-র রিপোর্টে বিশ্বের সবচেয়ে অশান্ত দেশ হচ্ছে সিরিয়া)। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বর্তমানে এমন এক জটিল অবস্থায় পৌঁছেছে যে, পরাশক্তির দেশগুলোও সেখানকার নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে প্রতিনিধি (প্রক্সি) যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে।
সিরিয়া ইস্যুতে পৃথিবীর বড়-বড় শক্তি গুলো দুই ভাগে বিভক্ত এবং প্রধান শক্তিগুলোর কূটনৈতিক শিষ্ঠাচারের (সিভিলিটি) মধ্যে থেকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করছেন। বড় বড় শক্তিশালী দেশগুলোর প্রত্যেকেরই স্বার্থ একে অপরের বিপরীত। তবে সবচাইতে ভয়ংকর বিষয় হলো নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব! মুসলমান রাষ্ট্রগুলো একে অন্যের বিরুদ্ধে রণহুংকার ছাড়ছে, ক্ষমতাসম্পন্ন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো শিয়া-সূন্নীতে বিভক্ত ।

কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে-তাতে অনেকেই ভীত! প্রশ্ন করছেন, এবার কি পরাশক্তিগুলোর মধ্যেই মহাযুদ্ধ বেধে গেল? এবার কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হতে যাচ্ছে?? এই সব ঘটনাপ্রবাহের কারণে সিরিয়ার পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক পথে মোড় নিচ্ছে। (এস,এন,এইচ,আর) সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের মতে ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সিরিয়াতে ৫ লাখের উপরে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ৪ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। ৩০ হাজারের উপর বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠী। ২০ হাজারের কিছু বেশি বাশার আল-আসাদ ও তার মিত্রবাহিনী। মহিলা ও শিশু মৃতের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার (এর মধ্যে শিশু মারা গেছে ২৪ হাজারের বেশি) আহত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ১২ লাখের বেশি। অসংখ্য নবী ওলীর পদচারণায় ধন্য সিরিয়া আজ পৃথিবীর সব থেকে বড় ‘কবরস্থান’। সিরিয়াতে আজ মানবিক সহায়তার খুবই প্রয়োজন! শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লক্ষ। যা সিরিয়ার পুরো শিশু জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ।
বিবিসির রিপোর্টার সেবেস্টিয়ান উষার লিখছেন,
(ঝুৎরধ পড়হভষরপঃ, রিষষ ঢ়ড়বিৎং বহফ ঁঢ় রহ ফরৎবপঃ ধিৎ) সিরিয়া সংঘাত, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সরাসরি যুদ্ধের মধ্যে শেষ হবে। তিনি আরো বলেন “সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং তার বিরোধীদের মধ্যে যে সংঘাত থেকে এই সংকটের সূচনা হয়েছিল-তা এখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। দেশটি এখন নানা শক্তির পরস্পরের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বাইরের যেসব শক্তি আগে কূটনীতির পথে ছিল, তারা এখন সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পথে নেমে পড়েছে। সিরিয়া যুদ্ধ এখন শুধু বাশার আল-আসাদের মরণকামড় দিয়ে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং অপরদিকে ফ্রি সিরিয়ান আর্মিদের সরকারবিরোধী যুদ্ধ নয় বরং বিশ্বের অন্যান্য শক্তির স্বার্থ ও জড়িত। রাশিয়া আর ইরান হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, কারণ তাদের আর্থিক, সামরিক, রাজনৈতিক সব স্বার্থই এখানে বিদ্যমান। রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো বৃদ্ধি করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় দেশগুলো অপেক্ষাকৃত কম জড়িত হলেও তাদের স্বার্থ হল অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রাধান্যতা! তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আরেক ধাপ এগিয়ে, যে কোন মূল্যে মধ্যেপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং রাশিয়ার প্রভাব হ্রাস করে মধ্যপ্রাচ্যকে তাদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখাই তাদের বড় চিন্তা। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিশালী দেশ সৌদি আরবের স্বার্থ ও কম নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অন্যতম মিত্র রাষ্ট্র খ্যাত সৌদির অন্যতম লক্ষ্য হল আমেরিকা-ইসরায়েলের সাথে তাদের বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখে রাজতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করা।
ইরান ও হিযবুল্লাহ সহ শিয়া পন্থীদের স্বার্থ হল শিয়াবিরোধী বলয়কে কোণঠাসা করে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের শক্ত ভিত্তি স্থাপন করা। এজন্য সব ধরণের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ইরান সব সময় করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। আল-কায়েদা, আল-নুসরা, আইসিস ওঝওঝ (ইসলামিক স্টেট) সহ খারেজী মতাবলম্বীদের স্বার্থ ধুম্রজালের মত। এরা মূলত ইহুদী কতৃক ব্যবহৃত, এদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্ভবত মুসলমানদের মধ্যে ফাটল ধরানো এবং নিরীহ মানুষকে হত্যা করা। কুর্দিরাও সিরিয়ার যুদ্ধে সক্রিয়, তাদের স্বার্থ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র কুর্দিস্তান।
কুর্দিদের দমনে তুরস্ক অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তুরস্ক কখনো চায়না কুর্দিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক, কারণ সিরিয়ার কুর্দিরা স্বাধীনতা লাভ করে স্বতন্ত্র কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠিত করলে তুরস্কের কুর্দিরাও তুরস্ক থেকে স্বাধীনতা লাভ করতে চাইবে। কাতার একটি ছোট্ট রাষ্ট্র হলেও তাদের স্বার্থ একটুও কম নয়, পারস্য উপসাগর থেকে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে তুরস্ক ও ইউরোপে গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে যাওয়া তাদের অন্যতম উদ্দেশ্যে ।
সিরিয়ার যুদ্ধের তীব্রতা এবং ঘটনাপ্রবাহ খুবই বিপজ্জনক ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিচ্ছে!! বাইরের শক্তির মদদে যে বা যারা ইতিপূর্বে বিদ্রোহ করেছেন অথবা জুলুম নির্যাতন করে ক্ষমতায় ঠিকে থাকার চেষ্টা করেছেন তাদের ইতিহাস কিন্তু সুখকর নয়। পেছনের শক্তিগুলো সব সময়ই উস্কে দিয়ে সংঘাত থেকে পিছিয়ে এসেছে। তাই এইসব যুদ্ধের ফলে সমাধানের পথ উম্মোচন হবে এ রকম আশ্বস্ত হওয়া যায় না। এরকম যুদ্ধের কথা শুনতে অদ্ভূত শোনাতে পারে, কিন্তু গত কিছুদিনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ফলে সিরিয়ায় সর্বগ্রাসী সংঘাতের আশংকা বেড়েই চলছে এবং সিরিয়ার সংকটকে আরো দীর্ঘায়িত করছে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব করেছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছেনা এবং হবেও না।
বিশ্ব বিবেক আজ নির্বাক, আর নির্বাক হবারই কথা কারণ ইতিপূর্বে ইরাক, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইয়েমেন সহ অসংখ্য মুসলিম দেশে তথাকথিত জঙ্গি দমনের নামে নির্বিচারে মুসলমানদের গণহত্যা করা হয়েছে। তাই মানবতার ধ্বজাধারী বিশ্ব মোড়লরা সিরিয়ার মজলুমদের রক্ষা করতে কখনো এগিয়ে আসবেনা। কিন্তু সবচেয়ে আফসোসের ব্যপার হচ্ছে মুসলমানদের নির্বাক থাকা। সিরিয়ার মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে আর প্রতিবেশী মুসলিমরা শুধু তাকিয়ে দেখছে! এ যেন নিষ্ঠুরতা। মুসলমান রাষ্ট্র প্রধানদের নীরবতা দেখে মনে হচ্ছে তাদের বিবেক ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু সিরিয়াই আক্রান্ত হয়েছে এবং আগামীতে আমরা আক্রান্ত হবো না এই মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে মুসলিম উম্মাহ তলিয়ে যাবে আরও নিচে, ধ্বংস হবে দেশের পর দেশ। তাই মুসলিম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানরা চুপ থেকে নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে যদি না দাঁড়ান তবে তাঁরাও ক্ষমতায় ঠিকে থাকতে পারবেনা। যুদ্ধে জয় পরাজয় বড় কথা নয়। বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন, একটি দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ বন্ধে এ যাবত বিশ্বের অভিভাবক সংস্থা জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদ, ওআইসি কিংবা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কারো কি দায়িত্ব নেই? নিরীহ মানুষ মরছে, ভয়ে দেশত্যাগ করছে, মানবতা ধ্বংস হচ্ছে, এসব বন্ধে কেউ কথা বলছে না। আজ সিরিয়া আক্রান্ত হয়েছে আগামীতে আরো অনেক দেশ আক্রান্ত হবে। বর্তমান বিশ্ব সংস্থা খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এগুলো অকার্যকর আন্তর্জাতিক সংগঠন। একটি দুর্বল দেশের ওপর যুদ্ধের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হল। কোথায় বিশ্ব বিবেক আর কোথায় মানবতা?
তথ্যসূত্রঃ
১. বিবিসি নিউজ বাংলা ২৫ ফেব্র“য়ারি ২০১৮।
২. ইউনিসেফ, এসএনএইচআর, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর বিভিন্ন রিপোর্ট।
৩. বিবিসি নিউজ ২২ ফেব্র“য়ারি ২০১৮।
৪. সিরিয়া এখন কবরস্থান, গৃহযুদ্ধের ৭ বছর যুগান্তর ডেস্ক ০৫ মার্চ ২০১৮।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *