সাহাবায়ে কেরামের অনুধাবন ও আমাদের উল্টোপথ

পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ইসলাম আমাদেরকে যা দিয়েছে, তার মধ্যে মৌলিক বিশ্বাস, জীবনব্যবস্থার নিয়মাবলী, সভ্যতা-সংস্কৃতির দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে মনের গভিরে উত্থিত অনুভূতির শুদ্ধিও বিদ্যমান। তন্মধ্যে কিছু বিশ্বাস ও মূলনীতি চিরকালই অনড় থাকবে। কিছু শাখা-প্রশাখা মূল কিতাবের সূত্র ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হতে পারে।
যা চিরকাল অপরিবর্তিত থাকবে তা হচ্ছে দ্বীনের স্থায়ী বিশ্বাস তথা আকীদা। রাসুলুল্লাহ (স.) রিসালাতের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে পরবর্তী ১৩ বছর মক্কা মুকাররামায় কয়েকশ মানুষের আত্মিক বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি করেছিলেন। কোনরূপ আইন-কানুন, এমনকি গ্রন্থবদ্ধ কোন ইবাদাতের নির্দেশও আসেনি সে যুগে। উদ্দেশ্য ছিল একটিই- ভেতরের অবস্থা পরিবর্তন করা, পরিশুদ্ধ করা। প্রায় যুগব্যাপী চলা ঐ শুদ্ধি অভিযানের পর সেই কয়েকশ মানুষ যখন মদীনা তাইয়্যিবায় হিজরত করলেন তখন পুরো চিত্রটিই বদলে গেল। তাঁদের দিন কাটতে লাগল আল্লাহর পথে বিরামহীন সংগ্রামে আর রাত পার হতে লাগল আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নির্ঘুম ইবাদতে। রাসুলের (স.) সুহবাতে তাঁরা এমন উচ্চ মাকামে সমাসীন হয়েছিলেন যে, সেদিন থেকে অদ্যাবধি সেই কয়েকশ/কয়েক হাজার মানুষের পায়ের ধুলিকণার সমমর্যাদার কোন মানুষ আল্লাহর যমিনে আসেনি, কিয়ামত পর্যন্ত আসবেনা।
সাহাবায়ে কেরামের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মোবারক সুহবত বা সাহচর্য। এরপর যে বিষয়টি তাঁদের বড়ত্বের প্রতিক হয়ে আছে, তা হল মক্কী যুগের সেই বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি। রাসুল (স.) তাঁদেরকে কিছু সহজ-সরল বিশ্বাস শিক্ষা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরিক নেই। ইবাদত কেবল তাঁরই প্রাপ্য। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা, তিনিই পালনকর্তা এবং মৃত্যুদাতা। আমাদের অস্তিত্ব ও সক্ষমতা সবই তাঁর হুকুমে এবং চলে যেতে হবে তাঁরই সকাশে। দয়া ও ক্রোধের বাদশাহি কেবল তাঁরই। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব আল-হাশেমী আল-কুরাইশী আল-আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কুরআন হচ্ছে আল্লাহর কালাম, যা সর্বশ্রেষ্ঠ হেদায়াত। আল্লাহর ফেরেশতাগণ অস্তিত্ববান এবং আল্লাহর হুকুমে কর্মরত। পূর্ববর্তী নবী-রাসুল এবং তাঁদের প্রতি প্রেরিত কিতাবসমূহ সত্য। মৃত্যু পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থান সত্য। কবরের পরীক্ষা, হাশর দিনের বিচার এবং জান্নাত-জাহান্নামের যে বর্ণনা আল্লাহর কালাম ও রাসুলের (স.) হাদিসে রয়েছে- তা সত্য। তাকদীরের ভাল-মন্দ একান্তভাবে আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত।
ব্যস, এটুকুই। এরচেয়ে জটিল কোন তত্ত্ব-দর্শনে আল্লাহর নবী (স.) প্রবেশ করতে চাননি, যদিও আল্লাহ তাঁকে পূর্বাপর জ্ঞান দান করেছিলেন। আল্লাহর নবী (স.) দ্বীনের ভিত্তিকে সহজ ও সুদৃঢ় বিশ্বাসের উপর স্থাপন করেছিলেন। এমনকি উপরোক্ত বিশ্বাসগুলো নিয়েও কাঁটাছেড়া করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কুরআন-হাদিসের একটি নসও পাওয়া যাবেনা, যাতে ফেরেশতাদের জীবনপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে। এই সহজ-সরল বিশ্বাসের বুনিয়াদে সাহাবায়ে কেরাম আজীবন অটল ছিলেন।

দ্বিতীয় কথা হল- সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও উপলব্ধিগত ফিকহী মতানৈক্য ছিল, যদিও তাঁরা সবাই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষকের নিকট দ্বীনের পাঠ নিয়েছিলেন। কেবল যে নিজেদের সমসাময়িক যুগেই তাঁদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছিল তা না, বরং রাসুলুল্লাহ (স.) পৃথিবীতে থাকাকালীন সময়েই সাহাবিরা ফিকহী বিষয়ে ভিন্নতর মত গ্রহণ ও পালন করেছিলেন। পরবর্তী যতদিন পর্যন্ত সাহাবায়ে কেরামের যুগ ছিল, ততদিনই তাঁদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফিকহী অনুশীলন লক্ষ্য করা যায়। কেবল সাহাবায়ে কেরামের আমল, আকওয়াল ও ফতোয়া নিয়েই যুগেযুগে শত শত গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং পরবর্তী আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের মধ্যে যে ফিকহী মতপার্থক্য দেখা যায়, তা মূলত সাহাবায়ে কেরাম (রা.) থেকেই গৃহীত। না এতে দ্বীনের কোনরূপ ক্ষতি সাধিত হয়েছিল, না রাসুলুল্লাহ (স.) এতে নিষেধ করেছিলেন, না তাঁরা একে অপরকে গালিগালাজ করেছিলেন। বরং এতে দ্বীনি জ্ঞানের শাখা-প্রশাখা আরো ব্যাপ্তিত হয়েছিল।
দুটি বিষয় পরিষ্কার।
১. সাহাবায়ে কেরামের আকীদা ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল এবং সুদৃঢ়।
২. ফিকহী মতপার্থক্যকে তাঁরা অত্যন্ত দায়িত্ববোধের সাথে স্বাগতম জানিয়েছিলেন।
এজন্যই আল্লাহর নবী (স.) ইরশাদ করেছেন- আমার সাহাবিরা আকাশের তারকাসম। তাঁদের যেকোন একজনকে অনুসরণ করলেই সুপথ প্রাপ্ত হবে।
আমরা ইদানিং যা করছি তা হচ্ছে ঠিক উল্টো। মানাকিব ও কালাম শাস্ত্রের জটিল বিষয় এবং নিজেদের ফিকহী অনুধাবনকে আকীদার স্তরে নিয়ে যাচ্ছি। এগুলোকেই ঈমানের দাবীদার বানিয়ে নিয়েছি।
অপরদিকে আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও উপলব্ধিগত ফিকহী মতপার্থক্যকে ভুল বুঝে তাঁদেরকে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে যাচ্ছি। আকীদা চলে এসেছে ফিকহের কাতারে, ফিকহ চলে গেছে আকীদার কাতারে। আমরা উল্টোপথে হাটছি।
দিনকে দিন একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে যাচ্ছি। অযাচিত উপদেশ দিয়ে আপনাদের বিরক্তির উদ্রেক ঘটাচ্ছি, এটি জানি। তবুও লিখছি, কারণ এটি জরুরি। আমরা কেন ভুলে যাই যে, ইসলাম সেটিই, যা সাহাবায়ে কেরাম শিখেছিলেন সাইয়্যিদিনা মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লামের মজলিসে বসে। ইসলাম সেটিই, যেখানে ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর ও ইবনে মাসউদের (রা.) ফিকহী অনুধাবন ভিন্নতর হওয়া সত্ত্বেও একই আকীদার উপর তাঁরা ছিলেন অবিচল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা ভাইভাই। ইসলাম সেটি, যার বাণী প্রচার করেছিলেন হাজার হাজার সাহাবি-সাহাবিয়্যাত, বলে।
অতি বুদ্ধির দরূণ মনগড়া আকীদা লালন করতে গিয়ে একদল মূর্খ সাহাবায়ে কেরামের জামা’আত ছেড়ে খারেজি, শি’আ ইত্যাদি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। অপরদিকে ঐ সহজ-সরল সুদৃঢ় আকীদাকে ধারণ করে ফিকহী অনুধাবনের ভিন্নতা সত্ত্বেও আজো আবু হানিফা, মালিক, শাফেয়ী, আহমদ, বুখারী, মুসলিম, গাযালী (রহ.) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ উম্মতে মুহাম্মাদির ইমাম হয়ে স্মরিত হচ্ছেন।
আসুন, আমরা আমাদের আকীদার বিস্তৃতিকে ততটুকু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখি যতটুকু পর্যন্ত রেখেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম। আবেগকে আকীদা না বানাই। অপরদিকে, ফিকহী মতপার্থক্য এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের পরিশ্রমকে সম্মান করতে শিখি। ইসলাম পালন করি যেভাবে পালন করে গিয়েছিলেন সালফে সালিহীন, মুহাক্কিক আইম্মা ও আউলিয়ায়ে কেরাম।
পাঠপ্রতিক্রিয়া: আর রিসালাতুল কুশায়রিয়্যা
মো. আবদুল আউয়াল হেলাল

আর রিসালাতুল কুশায়রিয়্যা ইলমে তাসাউফ’র বুনিয়াদি গ্রন্থগুলোর একটি। আরবি ভাষায় রচিত এ অমূল্য গ্রন্থের রচনাকাল ৪৩৮ হিজরী, ১০৪৬ খ্রিস্টাব্দ। এখন থেকে ৯৭১ বছর পূর্বে। রচয়িতা ইমাম আবুল কাসিম আবদুল কারীম আল কুশাইরী (৩৭৬-৪৬৫ হিজরি, ৯৮৬-১০৭২খ্রিস্টাব্দ)।
যারা ইলমে তাসাউফকে ইসলামের অনুসঙ্গ মনে করেন, সুফিগণ প্রবর্তিত বিভিন্ন তরিকা অনুসরণ করেন; আর যারা ইলমে তাসাউফকে ইসলামে নব আবিষ্কার বা বিদআত আখ্যায়িত করে সুফিবাদের বিরুদ্ধে বহুমূখি প্রচারণায় ব্যস্থ সময় কাটান উভয়ের জন্য এ গ্রন্থখানা অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত।
সম্প্রতি মূল আরবি থেকে বাংলা অনুবাদ হয়েছে প্রামাণ্য এ গ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ যোবায়ের। পাঠকের জন্য সহজবোধ্য করতে অনুবাদক প্রয়োজনিয় টীকা সংযোজন করেছেন। অনুবাদ জগতে নবাগত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবি ছাত্র আব্দুল্লাহ যোবায়ের বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে নিজের আসন পোক্ত করে নিয়েছেন নি:সন্দেহে। শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ স্যারের সম্পাদনা অনুবাদ কর্মটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। গ্রন্থখানার গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য সম্পাদক মহোদয়কে উদ্ধৃত করতে পারি। তিনি বলেছেন-বাংলা ভাষাভাষী অনেকের মনেই তাসাউফ সম্পর্কে অমূলক ধারণা রয়েছে। আবার সুফি সেজে কেউ কেউ মানুষের ইমান পর্যন্ত লুটে নিচ্ছে। এভাবে মূলধারার তাসাউফের বিরুদ্ধে ভণ্ড সুফি ও সুফিবাদ বিরোধী উভয় ধারাই সমানভাবে সক্রিয়। তাই সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তি দূর করার লক্ষ্যে এই গ্রন্থটির অনুবাদ ছিল সময়ের দাবি।
সম্পাদনা করতে গিয়ে মূলগ্রন্থের সাথে অনুবাদ মিলিয়ে দেখেছি। শব্দচয়ন, বাক্য গঠন ও ভাষার অলংকার বিবেচনায় অনুবাদটি অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে।
৫২৮ পৃষ্ঠার অনুবাদ গ্রন্থটি পড়ে এতটাই প্রাণিত হয়েছি যে, বন্ধুদেরকে পড়ার অনুরোধ করার লোভ সামলাতে পারিনি।
আসুন নিজে পড়ি এবং অন্যকে উৎসাহিত করি ।

আর রিসালাতুল কুশায়রিয়্যা
মূল: ইমাম কুশাইরী; অনুবাদ ও টীকা: আব্দুল্লাহ যোবায়ের
সম্পাদনা: প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ; মোট পৃষ্ঠা: ৫২৮
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬; প্রকাশক: ঐতিহ্য, বাংলাবাজার, ঢাকা
মূল্য: পাঁচশত টাকা।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *