সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ভিড়ে

ভ্রমণ আমার কাছে সব সময়ই প্রিয় শখ। ভ্রমণের মাধ্যমে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টিকে উপভোগ করা যায়। ভ্রমণ করার জন্য পবিত্র কালামে পাকেও নির্দেশ আছে। ভ্রমণের মাধ্যমে অনেক কিছু শেখাও যায়। ভ্রমণ মুমিনের ঈমানে শক্তি এনে দেয়, এটা এভাবে যে, নাস্তিক বেদ্বীনেরা যখন বুলি আউড়ায় যে এই পৃথিবী তো আপনা আপনিই হয়ে গেছে! কিন্তু মুমিন যখন ভ্রমণে বের হয়ে মাওলার নয়নজোড়ানো সৃষ্টি অবলোকন করে, যখন ভাবে এসব কি আসলেই আপ্না-আপনি সৃষ্টি হতে পারে? মুমিনের বিবেক তখন পরিস্কার জানিয়ে দেয় অসম্ভব! নিশ্চয় এর পিছনে আছে কোন অদৃশ্য সত্তার কুদরতি কার্যক্রম। কিন্তু অবিশ্বাসীরা আদৌও বুঝতে পারে না।

পরিকল্পনা
ভ্রমণের প্রবল ইচ্ছা থেকেই একদিন আমি আর আমার ফ্রেণ্ড হাফিজ শাহ আলম সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার বেড়াতে যাব! এটা ২০০৯ এর কথা। সিদ্ধান্ত হল, হিফজ শেষ করে দাখিল পরীক্ষার পর যাব। বিষয়টা আমরা হাঃ আব্দুল মজিদ ভাই, হাঃ মাহফুজ, হাঃ জাকির আহমদকেও জানালাম, তারাও আনন্দচিত্তে রাজি! কক্সবাজার বলে কথা।
যেখানে প্রতিদিন লক্ষ মানুষের সমাগম ঘটে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত, কে সেখানে যেতে চাইবে না?

প্রস্তুতি
যেহেতু গন্তব্য অনেক দূরের পথ, ব্যয়বহুলও বটে, তাই আমরা ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট ‘হাফিজ গ্র“প’ নামে একটা গ্র“প করি, যার প্রধান উদ্দেশ্য আমাদের বন্ধুত্ব বাঁধন দৃঢ় করা আর কিছু টাকা জমানো। বিভিন্ন প্রয়োজনে খরচ করব। আর কক্সবাজারে বেড়াতে যেতে হলে মোটা অংকের একটা এমাউন্ট দরকার হবে, এখান থেকে আমরা সেই এমাউন্ট নিতে পারি। এরকম বিভিন্ন উদ্দেশ্যে নিয়েই গ্র“প খোলা। তো সেখানে মোটামুটি রকম টাকা জমা হয়ে গেলে আর্থিক প্রস্তুতিটা আমাদের হয়ে গেলো।

দিনক্ষণ
আমরা যেহেতু কয়েকজন যাব, তাই সবারই তো সুযোগ আসতে হবে, এই অপেক্ষা করতে করতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এলো সেই সুযোগ। টাকার প্রস্তুতি তো আগেই সেরে রেখেছি। এবার আর বিলম্ব করা যায় না! একদিন মিটিং ডেকে একটা ডেইট ফিক্সড করলাম। ২৩শে মার্চ, ২০১৭ আমাদের যাত্রা তারিখ নির্ধারিত হল।

যাত্রা শুরু
বাহন যে লাম্বাগাড়ি (ট্রেন) হবে সেটা তখনই (২০০৯) নির্ধারিত-ই ছিল। রাত সাড়ে নয়টায় ট্রেন। আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই সিলেট কমলাপুর রেল স্টেশন চলে গেলাম। ট্রেনে সিট খুঁজে বের করে বসে পড়লাম যার যার আসনে। রাস্তায় আড্ডা এবং রাত কাটানোর রসদ হিসেবে ব্রেড, কলা, কেক, ড্রিংকস নিতে ভুলিনি। এক ঘন্টা লেট করে মহাশয় ছুটলেন বানিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। ট্রেনে অনেক আনন্দ-ফুর্তির মাধ্যমে রাত কাটল। সকাল ৭:৫০ মিনিটে গিয়ে ট্রেন চট্টগ্রাম পৌছল। গাড়ি থেকে নেমেই প্রথমে পেট পূজা সেরে নিলাম। তারপর বাসে করে রওয়ানা দিলাম স্বপ্নের কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। (এখানে আমার ব্যক্তিগত একটা দুখের কথা বলে নেই, আমার খুব প্রিয় একটা কটি (মুজিবকোট)
ভুল করে গাড়িতে ভুলে ফেলে চলে যাই! খুব কষ্ট পেয়েছিলাম! প্রিয় জিনিস তো!

হোটেলে
দুপুর ১২টা নাগাদ গিয়ে কক্সবাজার পৌছলাম। প্রায় আড়াই ঘন্টা খোঁজার পর, আমাদের কপালে হোটেল জুটলো! তাও এক মামার সহযোগিতায়! দুইটা খাট, আমরা ছয়জনের মোটামুটি চলবে, ভাড়াও তেমন বেশি না, তাই নিয়ে নিলাম। পার নাইট ২০০০ টাকা।

সমুদ্রের নোনাজলে
রুমে ঢুকে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দুপুরের খানা খেয়ে নিলাম। তারপরই চলে গেলাম কাক্সিক্ষত স্থানে, উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের বুকে। পরিকল্পনা ছিল আজ যেহেত ক্লান্ত, সারারাত নির্ঘুম, বাসে কয়েক ঘন্টা জার্নি, সব মিলিয়ে আজ বিশ্রামেই থাকি। আগামীকাল সাগরে ঝাঁপাবোনে। কিন্তু উত্তাল ঢেউগুলো দেখে মনকে সামলাতে পারলে তো! সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে নেমে গেলাম তখনই। হারিয়ে গেলাম হাজারো ঢেউয়ের ভিড়ে !
তীর থেকে লাফ দিয়ে ঢেউয়ে পড়ি, ঢেউগুলো ধাক্কা মেরে বিশ হাত উপরে এনে আঁচড়ে ফেলে। আহা কী অনুভূতি! ভাষায় প্রকাশ? অসম্ভব! উত্তাল ঢেউগুলো যেন বজ্রের মতো হুংকার ছুড়ে ছুড়ে আসে! আবার মুহুর্তেই সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়! এ দৃশ্য কত সুন্দর তা চর্মচক্ষু দিয়ে না দেখলে অনুমান করা যাবে না! হাজার হাজার মানুষ সেই আনন্দে মাতোয়ারা! ক্যামেরা ম্যানরা ব্যস্ত আগ্রহীদের ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। আমরাও কিছু তুললাম ভ্রমণটাকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখতে। ঘন্টা দেড়েক সাঁতার কেটে এদিনকার মত হোটেলে ফিরে এলাম। গোসল টোসল সেরে রাতের কক্সবাজার দেখতে বেরুলাম, সেদিন পাশেই একটা বানিজ্য মেলা নাকি কিসের একটা মেলা চলছিল, কেউ কেউ সেখানে গেলো। কেউ সমুদ্র পাড়ে হাটতে গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে ফিরলাম হোটেলে। শুরু হলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় গজল, মুর্শিদি গান। তারপর ঘুমের দেশে। প্রথম দিনটা এভাবেই কেটে গেলো।

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে
রাতে আমাদের সেই মামার সাথে কথা বলে পরবর্তী দিনের কর্মসূচী ঠিক করলাম। পরের দিনের গন্তব্য ‘সেন্টমার্টিন’। মহান রবের আরো এক সুন্দর সৃষ্টি! প্যাকেজ সিস্টেমে যাওয়া ভাল হবে বলে মামা আমাদের একটা প্যাকেজ এর ব্যবস্থা করে দেন। প্যাকেজটা হল এরকম যে, হোটেল থেকে বাস এসে নিয়ে যাবে জাহাজ ঘাটে, সেখানে জাহাজে করে সেন্টমার্টিন, সকালে নাস্তা, দুপুরে ভাত আর বিকালে নাস্তা, বিকাল তিনটা নাগাদ জাহাজ ফিরে আসবে, এর মধ্যেই যা যা দেখার দেখে নিতে হবে, তারপর আবার ওরা হোটেলে এনে দিয়ে যাবে। খরচ জনপ্রতি ১২৫০ টাকা। পছন্দ হলো। যদিও পরে জেনেছিলাম আরো কমে যাওয়া যেতো। সে যাই হোক।

প্রথমবার জাহাজ চড়া এবং দ্বীপে অবতরণ
জীবনে প্রথমবারের মত জাহাজে চড়া! আহা! সে এক অন্যরকম ফিলিংস! সাগরের বুক চিড়ে দানবের মত এগিয়ে চলছে। মানুষেরা ছাদে উঠছে, নাচছে, গাইছে আনন্দ করছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের মোহাবিষ্ট করে দেয়া অপরূপ দৃশ্য! নজর ফেরানো দায়! আমাদের দেশেও এতো সুন্দর দৃশ্য আছে?ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে যায়! সময়ের ভেতরে যতটুকু পারা যায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
সমুদ্রের নোনাপানির তাজা মাছের ভাজি খেলাম! জিভে জল আসার মত স্বাদ! কচি ডাবগুলোর স্বাদও সেই ছিল। সময় কম বলে মনভরে দেখতে পারিনি! তাই ভারাক্রান্ত হৃদে নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজে করে চলে এলাম আমাদের হোটেলে। এদিন আর সমুদ্রে যাওয়া হয়নি।

মহেশখালী দ্বীপে
আমাদের হাতে সময় কম আবার দেখার ইচ্ছা অনেক জায়গা, তাই পরের দিনই চলে গেলাম বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র মহেশখালী দ্বীপে! এবার আরো একটি নতুন বাহন! স্পীডবোট! সবারই প্রথমবার চড়া। তাই সবাই ভীষণ এক্সাইটেড । আমাদের সাথে আরো ৪জন যাত্রী মিলিয়ে একটা স্পীডবোর্ট রিজার্ভ করে নিলাম। ভাড়া ১১০০ টাকা। বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে চলল বোটটি। যেন মুহুর্তেই পৌঁছে গেলাম মহেশখালীতে। অথচ মনে চাইছিল আরো যদি অনেকক্ষণ এটা চলতো! স্পীডবোটে চড়া যে এতো রোমান্টিক! তা আগে কোনদিনও ভাবিনি!
স্পীডবোট ছেড়ে টমটম নিয়ে দ্বীপের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। সেখানকার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখলাম টমটমে করেই। সেখানে বাস করে বিভিন্ন উপজাতিরা। তাদের নিজ হাতে বানানো অনেক শিল্প দেখলাম। বিকালে আবার সমুদ্রে নামবো এমন পরিকল্পনা থাকায় মহেশখালীতে বেশ সময় কাটানো যায়নি। কয়েকঘন্টা ঘুরার পর ফেরার পথ ধরলাম। এবার আর স্পীডবোট মেলেনি। ইঞ্জিন চালিত বোটে ফিরলাম।
বিঃ দ্রঃ মহেশখালী থেকে বন্ধুরা কে কী নিয়ে ফিরল জানি না তবে, আমি সেখান থেকে জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ স্মৃতিটা নিয়ে ফিরেছিলাম। আজ সেই গল্প বলছি না।

আবারো ঢেউয়ের কোলে
মহেশখালী থেকে ফিরে, খাওয়া-ধাওয়া সেরে আবারো সাগরের ঢেউয়ের উত্তাল আহবানে ছুটে গেলাম সমুদ্র তীরে, সারা বিকালটাই কাটিয়ে দিলাম ঢেউয়ের ভূবনে! সমুদ্রের নোনাজলের ঢেউয়ে ছুটে বেড়ানো! একেকটা ঢেউয়ের সাথে মোকাবেলা করা! আহা কী অনুভূতি! অসাধারণ বললেও কিছু বলা হয় না।
সন্ধ্যা হয়ে এলে হোটেলে ফিরলাম। কেউ কেউ আবার রাতে সাগর পাড়ে গেলাম, রাতের দৃশ্য দেখার জন্য। হাল্কা কেনাকাটাও করলাম।

বিদায়ের পালা
তিনটা দিন যেন তিন ঘন্টাতেই শেষ! সুখের সময়টা যে অতি দ্রুত চলে যায় তা আবারো অনুধাবন হল!
পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে আসতে হবে। তাই রাতেই কেনাকাটা করে নিলাম। তবুও আবার সকালে গেলাম সমুদ্র তীরে। আরো কিছু কেনাকাটা করে আস্তে আস্তে ফেরার পথ ধরলাম, তবে মনের সাথে যুদ্ধ করতে হল রীতিমত! কারণ সময়সল্পতার কারণে যে মনের স্বাদ মিটিয়ে সাঁতার কাটা হল না! কিন্তু ফিরতেও যে হবেই! তাই শত অনিচ্ছা স্বত্তেও স্বপ্নের কক্সবাজারকে ত্যাগ করে ফিরতে হল।
ফেরার ক্ষণে সাগরের ঢেউকে বলে আসলাম, বন্ধু আমরা আসবো আবারো তোর বুকে, তোর প্রেমে পড়ে গেছি রে, তবে হ্যাঁ, খালি হাতে ফিরিনি, স্বপ্নের কক্সবাজার থেকে সাথে নিয়ে এলাম কিছু আলোজ্বলমল স্মৃতি যা আমাদের হৃদয়ে আজীবন সজীব হয়ে থাকবে, আর ব্যক্তিগত স্মৃতিভাণ্ডার তো ব্যতিক্রমী স্মৃতিতে সমৃদ্ধ হয়েই ছিল।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *