সফল সমাজসংস্কারক আল্লামা ফুলতলী রহ.

একজন সমাজ সংস্কারকের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডই হলো সমাজকে ঘিরে। সমাজের জন্য করা সব কাজকেই সামাজিক খিদমত হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। তাই প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. দীনী খিদমতে প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম সম্পাদনে যেমন শীর্ষস্থানীয়, তেমনি সমাজসেবা তথা দেশ ও দশের খিদমতে তাঁর অবদান ছিল আদর্শস্থানীয়। তিনি নীরবে-নিভৃতে সারা জীবন খিদমতে খালক তথা সৃষ্টির সেবা করে গেছেন। তিনি মানব সেবাকে রাসূলে করীম সা.-এর সুন্নতের ধারা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন।
দারুল কেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট এবং লতিফিয়া কারী সোসাইটি প্রতিষ্ঠা : পবিত্র কোরআন শরীফ বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত না করলে নামাজ শুদ্ধ হয় না। তখন মুসলিম সমাজে কোরআন তিলাওয়াতে ভুলত্র“টি ব্যাপক ছিল। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. নিজ বাড়িতে শুরু করেন বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষার কার্যক্রম।
১৯৫০ সালে গঠন করেন ‘দারুল কেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট’। তাঁর সম্পত্তির বিশাল এক অংশ (প্রায় ৩৩ একর জমি) এ ট্রাস্টে ওয়াকফ করে দেন। তখন স্থায়ী কেরাতের মাদরাসা, রমদ্বান শরীফের দারুল কেরাত, মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক দারুল কেরাতের মাধ্যমে সমাজে সংস্কার সাধনে বিপুল সাড়া পান। তখন চার সহস্রাধিক শিক্ষার্থী এবং আড়াই শতাধিক উস্তাদ ট্রাস্টের অধিনে খেদমত করেন। ১৯৮০ সালে উক্ত ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত ‘সংক্ষিপ্ত বাৎসরিক রিপোর্ট’ পড়ে জানা যায় যে, ১৯৭৫ সালে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। ফুলতলী ছাহেব বাড়ির বাংলা ঘর, এতিমখানা, মসজিদ ও বাড়ির বাইরে ফুলতলী আলিয়া মাদরাসা, প্রাইমারি স্কুল এবং আশপাশের মসজিদগুলোতেও শিক্ষার্থীদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় জেলার বিভিন্ন স্থানে ৮টি নতুন কেন্দ্র খোলা হয়। মূলকেন্দ্র ফুলতলীতে শেষ দুই জামাত রেখে অন্যান্য কেন্দ্রে ৪টি জামাত(রাবে) পর্যন্ত পড়ানোর অনুমতি দেয়া হতে থাকে। এভাবে ১৯৮০ সালে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে কেন্দ্র সংখ্যা ৪৪টিতে পৌঁছে। তখন ৩৯টি কেন্দ্রে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০১৪ জন ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে প্রায় দুই হাজার শাখা কেন্দ্র রয়েছে।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. অর্ধ-শতাব্দিরও অধিক সময় ধরে দেশবিদেশে ইলমে কেরাত শিক্ষা দান করেন। হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাঁর কাছে বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শিখে সনদ অর্জন করেন। এ সকল শিক্ষক বা কারী ছাহেবকে সহীহ আকীদা বিশ্বাসে একতাবদ্ধ ও ইলমে কেরাতের খেদমতকে চালু রাখার জন্য গঠন করেন ‘লতিফিয়া কারী সোসাইটি বাংলাদেশ।’ এ সংগঠনের রয়েছে অসংখ্য শাখা। প্রতিটি শাখা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকারের সামাজিক খেদমতের উদ্যোগ গ্রহণ করে। যার মধ্যে রয়েছে খৎনা, গৃহ সংস্কার, নলকূপ প্রদান, বৃক্ষ চারা বন্টন, এতিম ও অন্ধ-আতুর এবং বিধবাদের সহায়তা ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, উক্ত দুই সংগঠন পরোক্ষভাবে সামাজিক খেদমত আঞ্জাম দিলেও প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক সংস্কারে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।


ইয়াকুবিয়া হিফযুল কোরআন বোর্ড : হাফিজিয়া মাদরাসাগুলো পরিচালনার লক্ষে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. ২০০৬ সালে গঠন করেন ‘ইয়াকুবিয়া হিফযুল কোরআন বোর্ড’। এ বোর্ডের কার্যক্রম লতিফিয়া কারী সোসাইটির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তৃত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২২টির অধিক উপজেলায় সাড়ে তিন শতাধিক মাদরাসা এ বোর্ডের অন্তর্ভুুক্ত রয়েছে। এ বোর্ডের বিশেষ সামাজিক লক্ষ হলো, হিফজের শিক্ষার্থীদের বিশুদ্ধ তরিকা বা উচ্চারণে কোরআন হিফজ সম্পন্ন করণ।
বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ ও তালামীযে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠা : মুসলিম সমাজে তাবলীগের নাম ধরে একটি দল গ্রামাঞ্চলের মসজিদে মসজিদে ঘুরে বিশেষ একটি মতবাদ ছড়াতে শুরু করলে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর নজরে বিষয়টি পড়ে। তিনি স্বীয় বিশেষ খলিফাদের নিয়ে পরামর্শে বসেন। তাবলীগের প্রচারিত মতবাদের বিপরীতে সমাজকে সংশোধিত বা ইসলাহ করার মানসে ১৯৭৯ সালে গঠন করেন ‘আনজুমানে আল-ইসলাহ’। সমাজ সংস্কারের প্রেক্ষাপটে গঠিত সংগঠনটি পরবর্তীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে সংগঠনটির মাধ্যমে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়।
আল-ইসলাহ এর ছাত্র সংগঠন হলো আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. যখন দেখলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভ্রান্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি দল উঠে পড়ে লেগেছে তখন তিনি একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
লতিফিয়া এতিমখানা ও মুসলিম হ্যান্ডস বাংলাদেশ : ১৯৭২ সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. নিজ বাড়িতে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এর নাম ‘লতিফিয়া এতিমখানা’। এখানে প্রায় দেড় হাজার এতীম অবস্থান করে সুশিক্ষা গ্রহণ করছে। এছাড়া বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিং এর মাধ্যমে এতিমদের দক্ষ জনসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা হয় এখানে। উক্ত এতিমখানা প্রতিষ্ঠার প্রাক্ষালে এতিমখানার ধারণা সমাজে ছিল। সামাজিক খেদমতের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল উক্ত এতিমখানা প্রতিষ্ঠা।
মুসলিম হ্যান্ডস বাংলাদেশ হলো আর্ত-মানবতার সেবায় নিবেদিত একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠন আর্ত-মানবতার সেবায় কাজ করলেও এটি ছিল সুনির্দিষ্টভাবে সামাজিক খেদমতের জন্য নিবেদিত প্রতিষ্ঠান। গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ, এতিমদের বৃত্তি প্রদান, বৃক্ষরোপন, অন্ধ-আতুরদের সাহায্য প্রদান, নলকুপ স্থাপন, খৎনা দেয়া, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে এ সংগঠন। এর অধিনে ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে একটি ডিসপেনসারিও রয়েছে।
আলিয়া মাদরাসা এবং বাংলাদেশ আনজুমানে মাদারিছে আরাবিয়া প্রতিষ্ঠা : আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন। তৎকালে আলিয়া মাদরাসা ও কওমী মাদরাসা নামে দুটি ধারা ছিল। বাংলা, অংক, ইংরেজি বিষয়ে লেখাপড়া করা কওমি মাদরাসার জন্য ছিল খুবই দৃষ্টিকটু। এমনকি এটা নিয়ে আলিয়া মাদরাসাপন্থীদের বেশ কটাক্ষ করতেন কওমিপন্থীগণ। সমাজের সেই কলহকালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব র. বেছে নেন আলিয়া মাদরাসা ধারাকে। কেননা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বাংলা, অংক বিশেষ করে ইংরেজি বিষয়ে লেখাপড়া না করলে মুসলিম সমাজ ব্রিটিশ আমলের মতো সবদিক দিয়ে পিছিয়ে থাকবে। চাকুরীর ক্ষেত্রে হোক আর সামাজিকভাবে হোক মুসলিম সমাজ অবহেলিত থেকেই যাবে। তাঁর এই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনার ফলে সমাজে আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর অক্লান্ত শ্রমে মাদরাসাটি দাখিল, আলিম, ফাজিল এবং কামিল স্তরে পৌঁছে এবং পর্যায়ক্রমে এমপিওভূক্ত হয়। বর্তমানে বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল (এম.এ) মাদরাসায় ফাজিল (বি.এ) অনার্সসহ কামিল স্তরে হাদীস ও তাফসীর দুটি বিভাগ চালু আছে।
১৯৮৩ সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব র. সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র সোবহানীঘাটে প্রতিষ্ঠা করেন ‘হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসা’। বর্তমানে এ মাদরাসায় দাখিল ও আলিম জামাতে বিজ্ঞান বিভাগ এবং ফাজিল (বি.এ) অনার্সসহ কামিল জামাতে ফিকহ ও হাদীস দুটি বিভাগ চালু আছে।
এছাড়া দেশবিদেশের বিভিন্ন স্থানে দারুল কেরাতের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘রমদ্বানিয়া মাদরাসাগুলোকে আলিয়া মাদরাসায় উন্নীত করতে প্রচেষ্টা চালান এবং সফল হন।
আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকমণ্ডলীকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষকদের দাবীদাওয়া আদায়ে সংঘবদ্ধ রাখার অভিপ্রায়ে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব র. ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে মাদারিছে আরাবিয়া’। শিক্ষক-কর্মচারীর প্রশিক্ষণ, সংগঠনের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলীর সমাধান, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা, বৃত্তি প্রদান ইত্যাদি শিক্ষা উন্নয়নমূলক যাবতীয় কাজ সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়ে থাকে সংগঠনটি।
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব র.-এর আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতার সিদ্ধান্তটি মুসলিম সমাজকে আজ যে মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে তা সর্ব মহলে মাইলফলক হিসেবে পরিগনিত। সমাজ সংস্কারের উক্ত সিদ্ধান্ত ও নানা পদক্ষেপের কারণে তাঁর অনুসারীরা তাঁর কাছে চির ঋণী হয়ে আছেন।
যুক্তরাজ্যে সফর, ইসলাম গ্রহণ ও দীনী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা : আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. এর দীনী খেদমত বাংলাদেশ, ভারত তথা সমগ্র উপমহাদেশে ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ইলমে কেরাত, ইলমে হাদীস, ইলমে তাসাওউফসহ সব ধরনের খেদমত পরিচালনার জন্য তিনি যুক্তরাজ্যে অসংখ্য দীনী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যুক্তরাজ্যে সর্বপ্রথম ১৯৭৮ সালে সফর করেন। সেখানকার মুসলিম সমাজ তখন এমন একজন সমাজ সংস্কারক ওলীর অভাব বোধ করছিল। তাঁরা যেন অপেক্ষার প্রহর গুণছিল আল্লামা ফুলতলী র.-এর শুভাগমনের। বাংলাদেশের মতো সেখানেও অনেকে তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর নির্দেশ, তত্ত্বাবধান, পৃষ্ঠপোষকতা, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এবং স্বীয় মুরীদীন-মুহিব্বীনের উদ্যোগে ধীরে ধীরে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বর্তমানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মাদরাসা, মক্তব, মসজিদ, ইসলামিক সেন্টার ও সমাজসেবক সংগঠন।
পরিশেষে বলা যায় যে, একজন সফল সমাজসংস্কারক হিসেবে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলা র.-এর অবদান অনস্বীকার্য। মহান আল্লাহ তাঁর দরজা বহু গুণ বৃদ্ধি করুণ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *