সন্ত্রাস বনাম ইসলাম

ইসলাম ও সন্ত্রাসের সম্পর্ক হচ্ছে আলো আঁধারের মত। একটি আসলে অপরটি উধাও হয়ে যায়। সুতরাং ইসলাম কায়েম হলে সন্ত্রাস টিকতে পারে না। আর সন্ত্রাস কায়েম হয়ে গেলে বুঝতে হবে সেখানে ইসলাম কায়েম নেই। এ ক্ষেত্রে ইসলামের মানে হচ্ছে শান্তি, স্বস্তি ও সুবিচার। মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীকে আমাদের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করে দিয়েছেন। বহু জীবনোপকরণ সৃষ্টি করেছেন, যাতে মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তায় জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু একদল মানুষ আছে, যারা আল্লাহর স্বাভাবিক সৃষ্টিতে অনাসৃষ্টি ঘটায়, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, মানুষের জীবন ও মালের নিরাপত্তা বিনষ্ট করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায় তারা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীরা পৃথিবী ও মানবতার শত্রু। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের দুশমন তারা। কারণ সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। এ বিশ্ব পরিবারে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, পরিবারের মালিক আল্লাহ তাকে অপছন্দ করেন। এ জন্য কুরআনের একাধিক আয়াতে আছে –
‘আল্লাহ হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ তিনি পৃথিবীর মানুষকে শান্তির পথে আহ্বানের তরে যুগে যুগে অগণিত নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন। আর সে যুগের বিভিন্ন জাতি ও ক্ষমতাধর অধিবাসীরা শান্তির পথে বিঘœ সৃষ্টি করেছে। ইরশাদ হচ্ছে –
‘ফেরাউন সম্প্রদায়- যারা রাষ্ট্রে সীমালঙ্ঘন করেছিল, দেশে সন্ত্রাস বাড়িয়ে দিয়েছিল।’ ফেরাউন বার হাজার বনী ইসরাইলীকে হত্যা করেছিল। সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সাধারণ মানুষদের জিম্মী করে ফেলেছিল। সুতরাং যারা সাধারণ ও নীরিহ মানুষের উপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় তারা সে ফেরাউন, নমরুদ, হামান, কারুন, শাদ্দাদ তথা আদ জাতি ও ছামুদ জাতির সমগ্রোত্রীয়। যারা যুগে যুগে শান্তির বার্তাবাহক আল্লাহর নবীদের হত্যা করেছে, মুসলমানদের হত্যা করেছে। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও কালেমা পাঠকারী নীরিহ মুসলমানদের উপর হত্যা, লুণ্ঠন, অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে আবু জাহল, আবু লাহাব, উতবা, শায়বা, অলীদ ইবনে মুগীরা, উমাইয়া বিন খালফ সহ বহু আল্লাহর দুশমন। সুতরাং সন্ত্রাসীদের কোনো ইসলামী পরিচয় থাকতে পারে না। তাদের কোনো ধর্মীয় পরিচয়-ই নেই। কারণ সন্ত্রাসবাদের স্থান নেই কোনো ধর্মে। মহান আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন-
পৃথিবীতে আল্লাহর রিযিক হতে খাও এবং পান করো। কিন্তু ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িও না। সুরা বাকারা: আয়াত ৬০।
সন্ত্রাস ও হাঙ্গামা না করার এ নিষেধাজ্ঞাটি আরো উচ্চারিত হয়েছে সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৭৭, সুরা হুদ, আয়াত: ৮৫, সুরা শুয়ারা, আয়াত: ১৮৩, সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৩৬। এরূপ বহু আয়াতে নিষেধাজ্ঞা আসার কারণ হচ্ছে সন্ত্রাসী হামলা একটি জঘন্য আপরাধ, মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী। একটি দৃষ্টান্ত দিলে আরো স্পষ্ট করে হামলার কুফলটা উপলব্ধি করতে পারবো। কোনো গাছে যদি একটি পাখিকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়, তাহলে মারা যায় একটি পাখি কিন্তু বাকি শত শত পাখি প্রাণ ভয়ে উড়ে পালিয়ে বেড়ায়। যখন একজন ব্যবসায়ীকে বাসায় ঢুকে হত্যা করা হয়, বাকি ব্যবসায়ীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে বেড়ায় নিজ ঘরেও ঘুমাতে পারে না। যখন একটি হোটেলে কিংবা একটি ভবনে হামলা করা হয়, বাকি হোটেলগুলো, বাকি ভবনগুলো পরিত্যাক্ত জনশূন্যতায় স্থবির হয়ে পড়ে। সুতরাং একটি হত্যা নিছক একটি হত্যা নয়। এর কুফল সর্বব্যাপী। এ জন্য সুরা মায়েদার ৩২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করছেন-
‘প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যদি কেউ কাউকে হত্যা করে- সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে কাউকে জীবিত করলো, অর্থাৎ, প্রাণ রক্ষা করলো- সে যেন সব মানুষকে জীবিত করলো।’ তাই পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের জন্য দেশ, জাতি ও মানবতার দুশমন সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতেই হবে।
সন্ত্রাসের সাথে ইসলামের কোনো আপোষ নেই। তাই ইসলাম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুধু নিষেধ বা নিরুৎসাহিত করেই ক্ষান্ত হয়নি। কেবল ইসলামই দিয়েছে সন্ত্রাস নির্মূলের কার্যকর ব্যবস্থাপত্র। সুরা মায়েদা এর ৩৩ নাম্বার আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-
যারা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট- তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা হাত পা বিপরীত দিক দিয়ে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটা হচ্ছে তাদের দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে বড় রকমের শাস্তি। বড় রকমের শাস্তি আল্লাহ সন্ত্রাসীদের জন্য বরাদ্দ করার কারণ হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দ্বারা সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। বুখারী শরীফের ৩১ নাম্বার হাদীসে এসেছে
‘দুই মুসলমান যখন তরবারি নিয়ে মুখোমুখী হয়, তখন হত্যাকারী ও হত্যাকৃত উভয়ে জাহান্নামী। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ, নিহত ব্যক্তির কি দোষ? নবীজী বললেন- সেও তো তার ভাইকে হত্যা করতে এসেছিল।’ অনুরূপ বুখারী শরীফের ৭০৭৬ নাম্বার হাদীসে এসেছে।
‘মুসলমানকে গালি দেয়া ফাসেকী আর হত্যা করা কুফরী।’ এ হাদিসের পরবর্তী হাদীসে এসেছে-
‘আমার পরে তোমরা কুফরীতে ফিরে যেওনা। সে কুফরী এই যে, তোমরা একে অপরের ঘাড়ে তরাবারির আঘাত করবে। হত্যাকারী কাফিরদের মতই চির জাহান্নামী। সুরা নিসা এর ৯৩ নাম্বার আয়াতে ঘোষণা এসেছে-
‘যে ইচ্ছা করে কোনো মুসলমানকে হত্যা করে তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে, আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত, তাকে লানত করেন এবং তার জন্য বড় ধরনের শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’
এ আয়াতটিতে পাঁচ ধরনের শাস্তির ঘোষণা এসেছে, হুবহু এগুলো মূলত কাফিরদের আযাব। কাফির ছাড়া কেউ জাহান্নামে চিরস্থায়ী হয় না। সুতরাং একজন মুমিনকে হত্যার পরিণতি যদি এই হয়, তাহলে জুমার নামাযরত মুসল্লিদের যারা বোমা মেরে শেষ করে দেয়, ঈদের জামাতে বোমা মেরে হতাহত করে দেয় তারা কি মুসলিম? এর পরেও কি আপনি তাদেরকে মুসলমান বলবেন? যে কাফিরদের মতো জাহান্নামের চিরস্থায়ী খোরাক হয়ে গেছে সে ইসলামের কেউ? সে মুসলিম হলে সে নামাজে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবে না? যেখানে ঘাড় ফিরিয়ে কোনো দিকে তাকাবার অনুমতি নেই, হাতে কোনো কাজ করার অনুমতি নেই সেখানে সে নামাজ বাদ দিয়ে নামাজিদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। নিশ্চয়ই সে আর নামাযী নয়, মুসলিম নয়। অথচ একজন মুসলমানের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে-
‘সকলের প্রতি সে রকম ইহসান করো, যেভাবে আল্লাহ তোমার প্রতি ইহসান করেছেন। আর পৃথিবীতে ফাসাদ করতে চেষ্টা করো না।’ আল্লাহ ফাসাদকারীদের পছন্দ করেন না। সুরা কাসাস, আয়াত ৭৭। তার পরেও কেন এত ফাসাদ? কেন এত বিপর্যয়? এত হাঙ্গামা কেন? উত্তর একটাই
এগুলো সব আমাদের হাতের কামাই। না হয় আল্লাহর খলীফা মানুষ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে এ ছিল আমাদের কাজ। শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রিয় নবীজী প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন। খোলাফায়ে রাশেদার আমলে ৩০ বছর ব্যাপী সন্ত্রাসমুক্ত রাষ্ট্র পরিচালনা করে পৃথিবীতে নযীর রেখে গেছেন। রাজ্যের সকল সন্ত্রাস নির্মূল করে খলীফা ওমর (রা.) গাছের সাথে ঘোড়া বেঁধে গাছ-তলাতেই ঘুমিয়ে থাকতেন। কোনো খুন-খারাবী-সন্ত্রাস রাষ্ট্রে ছিল না। আল্লাহ তায়ালা এরূপ পরিবেশ ধরে রাখতে আমাদের কঠোর নির্দেশ দিয়ে ঘোষণা করেছেন-
‘পৃথিবীকে সংশোধন করে দেয়ার পরে আবার তোমরা ফাসাদ সৃষ্টি করো না।’ সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৫৬। কিন্তু আমরা সে পরিবেশ ধরে রাখতে পারিনি। সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত বিচারে আমরা ব্যর্থ হওয়ায় তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেশে দেশে। ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে রাষ্ট্রের। বদনাম হচ্ছে সরকারের, দেশের, ইসলামের। পরিশেষে সন্ত্রাসী- জঙ্গীদের প্রতি আহ্বান, আল্লাহ দয়াশীল, ক্ষমাশীল; সময় থাকতে তাওবা করো। আল্লাহ কবুল করে নিবেন। বিনা তাওবায় তো বেইমান হয়ে মারা যাবে। আর সকল স্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান আমরা যেন সকল প্রকার স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায় বিচার কায়েমের মাধ্যমে, প্রকৃত অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তির মাধ্যমে সন্ত্রাস নির্মূলের চেষ্টা করি। সকল প্রকার দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও সন্ত্রাসমুক্ত দেশ পরিচালনায় আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *