মা-বাবা আমার সবচেয়ে আপন

মা-বাবা। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও আপনজন। সন্তানের জন্য মা-বাবার চেয়ে বড় আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ অবশ্যই নেই। কেননা, জন্মের পর সর্ব প্রথম যে দোলনায় দুলেছিলাম তা আমার মায়ের তুলতুলে দোলনা। চোখ খুলে প্রথমে যে আখি দেখেছিলাম তা আমার মায়ের মায়াবি আঁখি। শুরুতে যে মোবারক চেহারা দেখেছিলাম তা আমার মায়ের পবিত্র চেহারা। প্রথমে যে ভাষায় কথা বলেছিলাম তা আমার মায়ের ভাষা। আকাশের নিচে আর জমিনের উপর সবচেয়ে প্রিয় আদুরে, পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে দয়ালু, সোহাগি মা ছাড়া আর কেউ নাই। শিশুর মুখের পবিত্র হাসি মায়ের মনে সুখের ঢেউ তুলে। সন্তানের জন্মলাভ করার পর মানব সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মা-বাবা যে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেন, পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়ে তার পরিমাপ করা যাবে না। প্রতি মুহুর্তে শিশুর সেবা সুস্থ্যতা করতে মা-বাবাকে গলদর্ঘম হতে হয়। শিশুর অসুস্থতায় মায়ের গুমহীন রাত কাটে। এত কষ্টের পরও মা বাবার সঙ্গে সন্তানের থাকে স্বর্গীয় একটি সম্পর্ক। সন্তানের পড়া-লেখা, খাওয়া-দাওয়া, আর শালিনতার উপর মা-বাবার কতোইনা গুরুত্ব। এসব কারণেই বুঝি মা-বাবা আমার সবচেয়ে আপন। মা-বাবাই আমার দুনিয়া ও আখেরাতের অনাবিল শান্তি। এ প্রসঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, পিতা-মাতাই সন্তানের জান্নাত ও জাহান্নাম। সত্যিই মা-বাবার সন্তুষ্টিই জান্নাত লাভের সহজ উপায়। আর তাদের অসুন্তুষ্টিই জাহান্নামের অধিবাসী করে দেয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম আর বলেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের জান্নাত। সত্য কথা বলতে গেলে মা-বাবা আমাদেরকে নিজের প্রাণের চাইতেও ভালোবাসে। আর আমাদের সেখান লেখা-পড়া, ভদ্রতা, শালীনতা ও শিষ্টাচার। সীমাহীন পরিশ্রম করেন আমাদের প্রয়োজন মেটাতে। আমাদের জামা কাপড় আসবাবপত্র সংগ্রহে। আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে শরীরের ঘাম ঝরান।
কিন্তু আমরা! আমাদের বন্ধুরা! চিনলাম না তাদের। মা-বাবা যে কত বড় অমূল্য স্বর্গীয় সম্পদ, তা না জানার কারণেই যতসব বিভ্রান্তি আর ভুলে ভরা আমাদের জগৎ সংসার। অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থেকে আমরা অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি যে অন্যায় আচরণ করে যাচ্ছি, তা অবসানের জন্যই এ সংক্রান্ত জ্ঞানের আলো আজ অতি প্রয়োজন।
মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা, আদব, সম্মান, সদ্ব্যবহার ও আনুগত্য করা অবশ্য কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের সূরা লোকমানের ১৪নং আয়াতে কারিমায় এরশাদ ফরমান, “আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। সন্তানের দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। নির্দেশ দিয়েছি, আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং মা-বাবার প্রতিও কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।” পবিত্র কুরআনে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, “তোমরা সবাই আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করনা। মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।” (সূরা আন-নিসাঃ ৩৬) “আমি মানুষকে নিজেদের মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি।” (সূরা আন-কাবুত)।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেন, “যথা সময়ে নামাজ আদায় করার পর সর্বোত্তম কাজ হচ্ছে পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ, সদ্ব্যবহার করা।”
বাইবেল গ্রন্থে বলা হয়েছে, “ঐড়হড়ঁৎ ুড়ঁৎ ভধঃযবৎ ধহফ ুড়ঁৎ সড়ঃযবৎ…” (ঊীড়ফঁং ২০:১২)
অর্থাৎ তোমার পিতা ও তোমার মাতাকে সম্মান প্রদর্শন করো।

কার্ডিনাল মারমিলড বলেছেন, “মা হচ্ছেন তিনি যিনি অন্য সকলের স্থান পূরণ করতে পারেন, কিন্তু তার স্থান কেউ পূরণ করতে পারবে না।”
কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, ‘গড়ঃযবৎযড়ড়ফ’ “অষষ ষড়াব নবমরহং ধহফ বহফং ঃযবৎব” অর্থাৎ মাতৃত্বই সকল ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।
দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক স্রেইনার বলেছেন, “এমন কোনো মহান ব্যক্তি ছিলেন না, যার একজন মহান মা ছিলো না।”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলতেন, “যা কিছু তিনি হয়েছেন বা হবেন, তার জন্য তিনি তার মা এর কাছে ঋণী।”
মার্কিন কবি রালফ ওয়ালজে এমারসন বলেছেন, “মানুষ তাই যা তার মা তাকে বানায়।”
এক কথায় পৃথিবীর সকল ধর্মে মা-বাবার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার ও যথাযোগ্য মর্যাদা দেখানোর নির্দেশ রয়েছে।
আমাদের সকলের মা-বাবা আছে। মা আমাদের আদর করেন। স্নেহ ভালবাসা আর মায়া মমতা দিয়ে কোলে তুলে নেন। গাল ভরে চুমো খান। বাবা অতি সোহাগ করে আমাদের প্রতিপালন করেন, আমাদের উচিত মা-বাবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলা। তাদের সর্বদা সম্মান করা। তাদের সঙ্গে আদৌ রাগ না করা, তাদের কথা মান্য করা। যে কোনো আদেশ মেনে নেয়া। কখনো তাদের অবাধ্য না হওয়া। মাকে আদর করে মায়াবি সূরে ডাকবা। বাবাকে শ্রদ্ধা ভরে ডাকা, মা-বাবাকে পেলেই সালাম দেয়া। তাহলে কি হবে? বাবা-মা প্রাণ খুলে মন উজাড় করে দোয়া করবেন। আর আমরা সকলেই জানি মা-বাবার দোয়া পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দোয়া। হযরত খিজির আলাইহিসসালাতু ওয়া-সাল্লাম, হযরত আবদুল কাদের জীলানি রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি ও হযরত বায়েজিদ বোস্তামি রাহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি এদের ইতিহাস তো আমরা অনেকেই জানি। এরা তো মা-বাবার দোয়ায় এই বিশ্বে ইতিহাস হয়ে আছেন।
কিন্তু আমি! আমরা! আমাদের সন্তানেরা! আমার বন্ধুরা! কী রকম আচরণ করছি তাদের সঙ্গে। প্রতিটি সন্তান মাত্রই তার মায়ের আদর, সোহাগ ও স্নেহ পায় তা এক বাক্যে স্বীকার করতে হবে। কতো রাত মায়ের নির্ঘুম কেটেছে। কতো কষ্ট না জানি আমার বাবা করেছেন। তাদের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলা ভদ্র ও সুন্দর আচরণ করা প্রতিটি সন্তানের অবশ্যই দায়িত্ব। আর মুসলমান হিসেবে এটা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। তাই মহান পালনে ওয়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতিত অন্য কারো ইবাদত না করতে ও মাতা-পিতার প্রতি ভালো ব্যবহার করতে। তাদের একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে পৌছলে তাদের প্রতি ‘ঊফ’ তথা বিরক্তি, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, ক্রোধ ও ঘৃনাসূচক কোনো কথা বলবে না। আদর করবে। মমতাদেশে তাদের প্রতি নম্রতার সঙ্গে ব্যবহার করবে। আর বলবে, রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানিস সাগিরা। অর্থাৎ হে আমার প্রতিপালক তাদের প্রতি দয়ার আচরণ কর। যে ভাবে তারা শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছেন।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৩, ২৪)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *