মজুদদারিরা দেশ ও মানবতার শত্রু

মূল্য বৃদ্ধির জন্য বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্য আটক করে রাখার নাম মজুদদারি। আর সংকটের সময় কাজে লাগানের উদ্দেশ্যে তথা দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করার জন্যে সঞ্চয় করে রাখার নাম সংরক্ষণ। সুরা ইউসুফ এর ভেতরে সাত বছরের উৎপাদিত খাদ্যশস্য সঞ্চয় করে পরবর্তী সাত বছরের কঠিন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার কথা আমরা জানতে পারি। হযরত ইউসুফ আ. এর এই সফল পরিকল্পনাটি গ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে তৎকালীন মিশরসহ আরো বহির্দেশের অগণিত নারী পুরুষ ও শিশুর জীবন না খেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিল।
আবার সুরা বাকারা এর ২৫৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে কুরতুবীতে লেখা আছে-‘নমরুদ খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখতো। সে ছিল সারা পৃথিবীর বাদশা। তাই মানুষকে খাদ্যের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে তার নিকট ক্রয় করতে যেতে হত। যখন তারা তার কছে প্রবেশ করতো, তাকে সাজদা করতে হতো। অতপর যখন হযরত ইবরাহীম আ. প্রবেশ করলেন, তাকে সাজদা করলেন না। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল কি হল তুমি আমাকে সাজদা করলে না? ইবরাহীম আ. বললেন আমি আমার রব ছাড়া আর কাউকে সাজদা করি না। এখান থেকেই নমরুদ ও ইবরাহীম আ. এর বাক বিতর্ক শুরু হয়। যা আমাদের এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের কথা হচ্ছে পাষাণ্ড নরাধম নমরুদই প্রথম ব্যক্তি, খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে যে ব্যক্তি পৃথিবীর মানুষকে জিম্মি করার ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং মজুদদাররা নমরুদের সাথেই হাশরে একই কাতারে শামিল হবে।
সেই থেকে অদ্যাবধি নমরুদের মতই ওরকম এক শ্রেণীর লোকের হাতে আজ পৃথিবীর সাধারণ মানুষগুলো জিম্মি। এই মজুদদারীর বিষাক্ত ছোবলে আজ সমগ্র বিশ্ব আক্রান্ত। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক উৎপাদন ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা মজুদদারীর গভীর ফাঁদে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। ভেস্তে যাচ্ছে সরকারের সমস্ত প্ল্যান পরিকল্পনা, কমছে না ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। দারিদ্র্যের সীমারেখা থেকে মানুষকে উপরে তুলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এর সবটাই যেন মজুদদারীর কুফল। মধ্যস্বত্বভোগ ও মজুদদারী – সুষম বণ্টনের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ¯্রােতের মত সবার কাছে খাদ্যশস্য পৌঁছে যাওয়ার সাবলীল গতিতে পাহাড় সমান বাধা হচ্ছে মজুদদারি- কালোবাজারি। না হয় মানুষ ক্ষুধায় কষ্ট পাবে কেন? আসমান তো কম বারি বর্ষণ করেনি। জমীন তো কম ফসল উৎপাদন করেনি। সুনানে তিরমিযি শরীফের ৩০৪৫ নাম্বার হাদীসে এসেছে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ‘ তোমরা কি ধারণা করতে পারো- আসমান জমিন সৃষ্টি হতে শুরু করে আল্লাহ কী পরিমাণ ব্যয় করছেন?’ অর্থাৎ কি পরিমাণ ফসল উৎপাদন করেছেন? এর উত্তর পৃথিবীর কোন পরিসংখ্যান কোন দিন দিতে পারবে না।
যদি মধ্যস্বত্বভোগ ও মজুদদারী এই দুটো শব্দকে দেশ থেকে বিদায় করা যায়, অপচয় বন্ধ করা যায় তাহলে আবার খাদ্য শস্যের প্রাচুর্য ও উদ্বৃত্ত হতে বাধ্য। খাদ্য শস্যে আগুন, সবজির বাজারে আগুন এসব আগুন লাগার তো প্রশ্নই ওঠে না। দ্রব্যমূল্য হাতের নাগালেই শুধু নয় বরং ঠোঁটের নাগালে চলে আসার কথা। কারণ আল্লাহ তো ওরকম দুর্ভিক্ষ আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন না।


কিন্তু মজুদদারীর মত আমাদের কায়েমী স্বার্থবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষ খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআনে উল্লেখ আছে রাষ্ট্রের মাল- সম্পদ ধনীদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা প্রধানতম দুটি জঘন্য মাধ্যম হচ্ছে সুদ ও মজুদদারী। জাহরাতুত তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ আছে-
‘মজুদদারী হচ্ছে মানুষকে ক্ষুধার্ত রাখার উপায় আর সাধারণ মানুষ তাদের দৃষ্টিতে সব তাদের শত্রু।’ তারা ক্ষুধার্ত থাকলেই মজুদদারদের কাছে আসবে। আর তবেই তাদের লাভ। আর মানুষ খেয়ে পরে ভাল থাকলেই মজুদদারদের গাত্রদাহ। মোটকথা মজুদদারী মানুষকে অমানুষে পরিণত করে দেয়। তাই সহীহ ইবনে হিব্বান এর ৪৯৩৬ নং হাদীসে এসেছে ‘অপরাধী তথা সীমলঙ্ঘনকারী ছাড়া কেউ মজুদদারি করতে পারে না।’ ইবনে হিব্বান এর ২০৭৬৯ নং হাদীসে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের বেশি মজুদ রাখল সে ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দায়মুক্ত হয়ে গেল আর আল্লাহ পাকও তার থেকে দায় মুক্ত হয়ে গেলেন।’ মানে মহান আল্লাহর সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই।
আবু দাউদ শরীফের ২০২২ নং হাদীসে আছে- ‘হেরেম শরীফ তথা মক্কায় খাদ্য মজুদদারি করা কুফরী।’
মোটকথা মহান আল্লাহ তায়ালা জমীনে ফসল উৎপাদন করে তাঁর বান্দাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। কেউ তা আবদ্ধ করে রেখে তাঁর বান্দাদের অভুক্ত রাখার কৌশল করলে আল্লাহ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। যেসব উপায়ে সম্পদ কেবল ধনীদের হাতেই আবর্তিত হয়, তা তিনি নিষিদ্ধ করেছেন। আলকুরআনে কখনও যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন সুদের বিরুদ্ধে, কখনও যাকাত ফরজ করেছেন, কখনও মানুষের প্রতি ইহসান করতে- কখনও সদকা করতে উৎসাতিহ করেছন, আবার কোথাও মজুদদারিকে হারাম করেছেন। তার বান্দারা অভুক্ত থাকবে- এটা কোন মতেই তিনি মেনে নিতে রাজি নন।
হ্যাঁ তবে মানুষ ও পশু- পাখির খাদ্য দ্রব্য ছাড়া অন্য কোন বস্তু মজুদ করা জায়েজ আছে। ইমাম আবু হানিফা র. এর মতে নিজ জমিতে উৎপাদিত শস্য এবং অন্য দেশ থেকে আমদানীকৃত দ্রব্য মজুদ করা জায়েজ আছে। ইমাম মুহাম্মদ র. এর মতে নিজ জমির ফসল মজুদ বৈধ আর আমদানীকৃত দ্রব্য মজুদ বৈধ নয়। ইমাম আবু ইউসুফ র. এর মতে নিজ জমি ও আমদানীকৃত- কোন খাদ্যদ্রব্য মজুদ করা যাবে না। তবে বিশেষ কয়েকটি শর্তে খাদ্যদ্রব্য মজুদ জায়েয। যদি এমন অল্প পরিমাণে হয় যে, তাতে দেশে কোন প্রভাব পড়বে না, জনগণের তাতে কোন অসুবিধা হবে না অথবা ৪০ দিনের কম সময়ের জন্য হয়।
অন্যথায় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অগ্নিমূল্যে দ্রব্য বিক্রি করে, মানুষকে জিম্মি করে অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে অবাঞ্ছিত ও অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার লক্ষ্যে মজুদদারি চরম অপরাধ। সরকার যদি এদের শাস্তির ব্যবস্থা না করে তাহলে শুধু ওয়াজ উপদেশ দিয়ে এদেরকে বারণ করা যাবে না। কারণ এরা তো অবৈধ মুনাফা লোভী, চোর বাটপার। আর কথায় আছে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। আজকেই সরকার এদের দুএকজনকে শাস্তির ব্যবস্থা করুক। দেখবেন আর কেউ এমন কাজ করতে সাহস পাবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মজুদদারির এই কুফল উপলব্ধি করার সুবুদ্ধি দান করুন। এর বিষাক্ত ছোবল ও সর্বনাশা অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে এবং আল্লাহ ও মানুষের লানত থেকে নিজেকে রেহাই করার জন্য মজুদদারির মত জঘন্য কাজ থেকে যেন আমরা তওবা করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমীন

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *