দিল্লির হৃৎপিণ্ডে!

মুসলিম ইতিহাস এবং ঐতিহ্যঘেরা শহর দিল্লি। ঐতিহ্য এবং পর্যটকের শহরও বটে। নৃতাত্তিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিশাল দেশ ভারতের রাজধানী। দিল্লি শহরের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে ভারতবর্ষের মুসলমানদের উত্থান-পতনের নানা কাহিনী। প্রবাদ আছে, ‘ভারত দেখলে বিশ্ব দেখা হয়। আর দিল্লি দেখলে ভারত দেখা হয়। ’ এ প্রবাদ কেবল বাংলাদেশেই নয় দূরপ্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যেও সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। দিল্লি শহর ও আশপাশের এলাকাজুড়ে রয়েছে বিশ্বের সপ্তাশ্চার্যের অন্যতম তাজমহলসহ ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃত বেশকিছু প্রাচীন নান্দনিক স্থাপনার সমাহার। তাই সারা বছরই পর্যটকের ভিড় দিল্লিতে। তাজমহল, কুতুব মিনার, হুমায়ুন মমমাকবারা, লোটাস টেম্পল, অক্ষরধামে বিদেশী পর্যটকদের ভিড় দেখে মাঝে মধ্যে বিভ্রম হয়। কখনও একা, কখনওবা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচেছন নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা সংস্কৃতি ও নানা দেশে মানুষ।
এই মুসলিমদের ঐতিহ্যঘেরা দিল্লি দর্শনে আমাদের এক কাফেলা বেরুই দারুল উলূম দেওবন্দ’র ছুটির দিনে। একে একে দেখি অনেক মুসলিম ঐতিহ্য। বিচরণ করতে থাকি ইতিহাসের প্রতিটা পাতায় পাতায়। আমাদের সফর শুরু হয় আমদেরই ঐতিহ্য আর লাল টকটকে স্মৃতিভাণ্ডার নিয়ে আজও দন্ডয়মান থাকা লাল কেল্লা দিয়ে…

১. লাল কেল্লা।
সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট শাহজাহান দিল্লিতে নির্মাণ করেন। এটা বিশাল প্রাচীর বিশিষ্ট একটি দুর্গ। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এই দুর্গটি ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে। তারপর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা এই দুর্গটিকে একটি সামরিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে।
মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম নিদর্শন দিল্লির রেড ফোর্ট বা লাল কেল্লা। অপূর্ব নির্মাণশৈলীর লাল রঙের বিশাল এ স্থাপনাটি ভারতের সমৃদ্ধ প্রাচীন স্থাপত্যকলার অন্যতম উদাহরণ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও জড়িয়ে আছে দিল্লির এ কেল্লার সঙ্গে। ১৬৩৮ সালে সম্রাট শাহজাহান এই কেল্লাটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে এর নাম ছিল কিলা-ই-মুবারক। কারণ এই দুর্গে সম্রাটের পরিবারবর্গ বাস করতেন। দুর্গটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদীর পানিতে পুষ্ট হতো দুর্গের পরিখাগুলো। এর উত্তর-পূর্ব কোণের প্রাচীর সালিমগড় দুর্গ নামে অপর একটি প্রাচীন দুর্গের সঙ্গে সংযুক্ত। ১৫৪৬ সালে ইসলাম শাহ সুরি এই প্রতিরক্ষা দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। লাল কেল্লার পরিকল্পনা ও সাজসজ্জা শাহজাহানের শাসনকালে মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলার উৎকর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। প্রকৃতপক্ষে লাল কেল্লা ছিল দিল্লি ক্ষেত্রের সপ্তম নগরী তথা শাহজাহানের নতুন রাজধানী শাহজাহানাবাদের রাজপ্রাসাদ। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি দিল্লি থেকে আগ্রা শহরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। লাল কেল্লায় বসবাসকারী শেষ মুঘল সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ১৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর লাল কেল্লা পরিত্যাগ করেন। পরে তিনি ব্রিটিশ বন্দি হিসেবে এই দুর্গে ফিরে আসেন। ১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি তার বিচার শুরু হয় এবং ৭ অক্টোবর তাকে নির্বাসন দণ্ড দেয়া হয়। এরপর লাল কেল্লার কর্তৃত্ব ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। তারা এটিকে একটি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের পরাজয়ের পর লাল কেল্লাতেই যুদ্ধবন্দিদের বিচার হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই কেল্লাটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন।
লাল কেল্লার অলঙ্করণ ও শিল্পকর্ম অতি উচ্চমানের। পারসিক, ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পকলার সংমিশ্রণে তৈরি এই অভিনব শিল্পকলাটি স্বতন্ত্রতার দাবিদার। স্থাপত্য শিল্পের বিচারেও এই দুর্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুগের্র প্রাচীর মসৃণ এবং দৃঢ়। এর দুটি প্রধান দরজা হলো দিল্লি গেট ও লাহোর গেট। লাহোর গেট প্রধান দরজা। এই গেট দিয়ে ঢুকলে একটি লম্বা আচ্ছাদিত বাজার পথ পড়ে। এর নাম চট্টা চক। এই পথের দু’দিকের দেয়াল দোকানের মতো করে স্টল দিয়ে সাজানো। চট্টা চক ধরে সোজা এলে উত্তর-দক্ষিণ পথ পাওয়া যায়। এই পথটি আসলে দুর্গের পশ্চিমের সামরিক ক্ষেত্র ও পূর্বের রাজপ্রাসাদের সীমানা। এই পথের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দরজাটিই হলো দিল্লি গেট। দিল্লি গেটের বাইরে একটি বড় মুক্তাঙ্গন রয়েছে। এটি এককালে দিওয়ান-ই-আম-এর অঙ্গন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখানে ঝরোখা নামে একটি অলঙ্কৃত সিংহাসনে বসে সম্রাট জনসাধারণকে দর্শন দিতেন। এই স্তম্ভগুলো সোনায় চিত্রিত ছিল এবং সোনা ও রুপার রেলিং দিয়ে সাধারণকে সিংহাসনের থেকে পৃথক করে রাখা হতো। আর দিওয়ান-ই-খাস ছিল পুরোপুরি শ্বেতপাথরে মোড়া একটি কক্ষ। এর স্তম্ভগুলো পুষ্পচিত্রে সজ্জিত ছিল। ভেতরের অলঙ্করণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল মহামূল্যবান ধাতুগুলো।
সিংহাসনের পেছনের দিকে ছিল সম্রাট পরিবারের নিজস্ব কক্ষগুলো। প্রাসাদ প্রাঙ্গণটিকে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মনে করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ্ দেখলাম। পড়লাম। জানলাম। আর মুসলিম ঐতিহ্যে চক্ষু শীতল করলাম।
এর পর আমরা এগুলাম কুতুব মিনার’র দিকে।

২. কুতুব মিনার। মনে হলো ভারতের দিল্লীতে অবস্থিত একটি স্তম্ভ বা মিনার, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ ইটনির্মিত মিনার। এটি কুতুব কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত, প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের পাথর দিযে কুতুব কমপ্লেক্স এবং মিনারটি তৈরি করা হয়েছে। লাল বেলেপাথরে নির্মিত এই মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট)। মিনারটির পাদদেশের ব্যাস ১৪.৩২ মিটার (৪৭ ফুট) এবং শীর্ষ অংশের ব্যাস ২.৭৫ মিটার (৯ ফুট)। তয়োদদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই মিনারের নির্মাণক্য সমাপ্ত হয়। মিনার প্রাঙ্গনে আলাই দরজা (১৩১১), আলাই মিনার (এটি অসমাপ্ত মিনারের স্তূপ, এটা নির্মাণের কথা থাকলেও, নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়নি), কুওয়ত-উল-ইসলাম মসজিদ (ভারতের প্রাচীনতম মসজিদসমূহের অন্যতম, যেসব বর্তমানে আছে), ইলতুতমিসের সমাধি এবং একটি লৌহস্তম্ভ আছে। একাধিক হিন্দু এবং জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই মিনার নির্মিত হয় বলে কথিত আছে। অনুমান করা হয় যে ভারতে ইসলাম শাসনের প্রথম দিকে বহিরাগত আক্রমণে এই মন্দিরসমূহ ধ্বংস¯তূপ্ত হয়েছিল। প্ াঙ্গন কেন্দ্ স্থল ৭.০২ মিটার (২৩ ফুট) উচ্চতাবিশিষ্ট যেখানে চকচকীয া লৌহস্তম্ভ আছে, যা আজ পর্যন্ত একটু ও মরিচা ধরে নাই। এই লৌহস্তম্ভে সংস্কৃত ভাষায দ্বিতীয চন্দ্ গুপ্তের একটা লেখা আছে। ১১৯২ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক এই মিনারের নি ্মাণ কাজ আরম্ভ করেছিলেন। ইলতোতমিসের রাজত্বকালে (১২১১-৩৮) মিনারের কাজ শেষ হয ।
আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬) এটার প্রাঙ্গণ এবং নির্মাণ নি ্মাণকা ্য সম্পাদন হয । পরব ্তীকালে বজ্ পাতে মিনার ক্ষতিগ্ স্থ হয যদিও তার সংস্কার করা হযে ছিল। এর আশে পাশে আরও বেশ কিছু প্রচীন এবং মধ্যযুগীয স্থাপনা এবং ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যারা একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। ইসলামিক স্থাপত্য এবং শিল্পকৌশলের এক অনবদ্য প্ তিফলন হিসাবে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার (রা) বিভাগে এই প্রাঙ্গণ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা লাভ করে।
এটি দিল্লীর অন্যতম জনপ্রিয পর্যটন গন্তব্য এবং এটি ২০০৬ সালে সর্বোচ্চ পরিদর্শিত সৌধ, এবং পর্যটকের সংখ্যা ছিল৩৮.৯৫ লাখ যা তাজমহলের চেযে ও বেশি, যেখানে তাজমহলের পর্যটন সংখ্যা ছিল ২৫.৪ লাখ।
আফগানিস্তানের জাম মিনার এর অনুকরণে এটি নির্মিত হয়। পাঁচ তলা বিশিষ্ট মিনারের প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি বা ঝুলন্ত বারান্দা। কুতুব মিনারের নামকরণের পেছনে দুটি অভিমত রয়েছে, প্রথমত এর নির্মাতা কুতুব উদ্দিন আইবেকের নামানুসারে এর নামকরণ। দ্বিতীয়ত ট্রান্সঅক্সিয়ানা হতে আগত বিখ্যাত সুফী সাধক হযরত কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর সম্মানার্থে এটি নির্মিত হয়।
কুতুব মিনার বিভিন্ন নলাকার শ্যাফট দিযে গঠিত যা বারান্দা দ্বারা পৃথকীকৃত। মিনার লাল বেলেপাথর দিয়ে তৈরী যার আচ্ছাদন এর উপরে পবিত্র কোরআনের আয াত খোদাই করা। ভূমিকম্প এবং বজ্রপাত এর দরুন মিনার এর কিছু ক্ষতি হয কিন্তু সেটি পুণরায শাসকদের দ্বারা ঠিক করা হয । ফিরোজ শাহ এর শাসনকালে, মিনার এর দুই শীর্ষ তলা বাজ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয কিন্তু তা ফিরোজ শাহ দ্বারা সংশোধিত হযে ছিল।
১৫০৫ সালে একটি ভূমিকম্প প্রহত এবং এটি সিকান্দার লোদী দ্বারা সংশোধিত হযে ছিল। কুতুব মিনার এর দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি একটি ঢাল আছে যা “নিরাপদ সীমার মধ্যে” বিবেচিত হয । কুতুব মিনারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মনোরম একটি কমপ্লেক্স। ১০০ একর জমির উপর স্থাপিত এ কমপ্লেক্সে রয়েছে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, আলাই মিনার, আলাই গেট, সুলতান ইলতুৎমিশ, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন, সুলতান আলাউদ্দিন খলজী ও ইমাম জামিনের সমাধি ও লৌহ পিলার। এছাড়া মিনারের প্রাচীর গাত্র নানা প্রকারের অলঙ্করণ দ্বারা শোভিত। ভারত বর্ষের প্রথম মুসলিম শাসক ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেক কুতুব মিনারের গোড়া পত্তন করেন। তার তত্ত্বাবধানে ১ম ও ২য় তলা নির্মিত হয়। পরবর্তী সময়ে (১২১১-৩৬) সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মিনারের ৩য় ও ৪র্থ তলা এবং শেষে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের হাতে ৫ম তলা নির্মাণ সমাপ্ত হয়। ঐতিহাসিকদের অভিমত হচ্ছে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ-এর মুসল্লিদের সুবিধার্থে আযান দেওয়ার জন্য কুতুব মিনার ব্যবহৃত হতো। ১ম তলা হতে আযান দেয়া হতো নিয়মিত। সর্বাধিক উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এটাকে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হিসেবে ব্যবহারের উপযোগিতা লক্ষণীয়।
এবার আমরা মনস্থির করলাম এগুবো হুমায়ূন মাকবারার দিকে। সফরসঙ্গী মুনশি মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ’র সঙ্গে সঙ্গেই দুষ্টুমির সুর-
-এই শুনছো?
-হুম। বলো।
-তাজমহল যাবার ইচ্ছে আছে?
আছেতো কেন?
-এটা তো তাজমহলের মতোই। পরেতো আবার তাজমহল গেলে মজা পাবা না।
-আচ্ছা তাই বুঝি! তাইলে তো খরচটাও বাচলো। আসো যাওয়া যাক।
এবার টিকিট কেটে ভেতরে গেলাম।
হ্যা সত্যিই তো। হুমায়ূন মাকবারা! দেখলে পরে তাজমহল দেখতে মন চাইবে না। দেখে সত্যিই অবাক হলাম। কিছুটা তমকে গেলাম। ভাবলাম আসলে ব্যাপারটা কি! বলল, তাজমহল এর নান্দনিকতা আর হুমায়ূন মাকবারা নান্দনিকতা প্রায় একিরকম। আগে বলিনি? এবার মনোনিবেশ করলাম ইতিহাসের পাতায়। খোঁজলাম তা নির্মাণের ইতিবৃত্ত। হ্যা সত্যিই তো তাজমহল সৃষ্টিরও শতবর্ষ আগে (১৫৬২ সালে) এক মহান মুঘলপত্মী হামিদা বানু বেগম তার প্রয়াত স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেন “হুমায়ুন কা মাকবারা” বা হুমায়ুনের সমাধি। মুঘলরা উদ্যান-সমাধিক্ষেত্র পছন্দ করতো। তারই নমুনা দেখা যায় হুমায়ুন সমাধিতে। এমনকি বাবরের কবরেও (আফগানিস্তানে) এরকম উদ্যান-সমাধিতেই অবস্থিত। তবে, সব মোঘল সম্রাটদের এরকম উদ্যান-সমাধি জোটেনি, বিশেষ করে শেষ মুঘলরা অতি সাধারণ সমাধিতেই আজ শায়িত।
দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ উদ্যান-সমাধিক্ষেত্রের স্থপতি ছিলেন মিরাক মির্জা গিয াথ। এ জায়গাটি হয়তো হুমায়ুনের পছন্দই ছিলো। তাই তিনি তার জীবদ্দশাতেই এর কাছাকাছি দিনা-পানাহ বা পুরানা কিল্লা নির্মাণ করেছিলেন (১৫৩৩ সালে)।
হামিদা বানু বেগম হয়তো দিল্লিশ্বরের অন্তিম ইচ্ছার কথা জানতেন। তাই মৃত্যুর পর তাকে এখানেই সমাহিত করা হয়।
হুমায়ুনকে এখানে সমাহিত করার আরো কারণ থাকতে পারে। এই বিশাল এলাকার অংশবিশেষে হমায়ূুনের কবর হওয়ারও কমপক্ষে কুড়ি বছর আগে থেকেই কবর স্থান ছিল। বেশকিছু কবর এখনো আছে।
যমুনার তীর ঘেঁষেই এ সমাধিক্ষেত্রের বিস্তার। এ কবরের স্তম্ভের ওপর দাঁড়ালে একসময় দিল্লি শহর এক নজরে দেখা যেতো। মোঘল সম্রাটদের অনেকেই সুফিসাধকদের ভক্ত ছিলেন। কোনো কোনো সম্রাটের চরিত্রে কিছু ত্রুটি থাকলেও হুমায়ুন সম্পর্কে সেরকম বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি শুধু আফিম খেতেন বলে কোনো কোনো বর্ণনায় আছে। তবে, হুমায়ুন যে খাজা নিজামুদ্দিনের ভক্ত ছিলেন তা অনেকেই বর্ণনা করেছেন। প্রথম দিকের মুঘল সম্রাটরা খাজা নিজামুদ্দিনের ভক্ত ছিলেন এক ঐতিহাসিক কারণে। অনেকে মনে করেন, নিজাম ভক্ত হুমায়ুনকে তার সুপ্ত ইচ্ছার কারণেই নিজামুদ্দিনের কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়। নিজামুদ্দিনের কবরের পাশে শুধু হুমায়ুন না, শাহজাহান কন্যা জাহানারার কবরও আছে।
এতো বিশাল জায়গা নিয়ে অন্য কোনো মুঘল সম্রাটের সমাধি নেই। চারটে গেট পার হয়ে মূল সমাধি সংলগ্ন জায়গায় যেতে হয়। চারপাশটা কয়েক স্তরের সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। একই মুঘল স্থাপত্যরীতির অনুসরণ দেখতে পাই অপরাপর সম্রাটদের সমাধী উদ্যানগুলোতেও।
এ সমাধির চারপাশে রয়েছে একই রকম চারটি ফটক। বর্তমানে শুধু একটি খোলা। বাকি ফটক বা গেটগুলো বন্ধই থাকে। লাল ও সাদা বেলেপাথর দিয়েই তৈরি এ সমাধিক্ষেত্র। সর্বশেষ গেটটি পার হওয়ার পরও অনেকটা পথ হেটে তবেই পৌঁছা যাবে মূল সমাধি ভবনে। মূল ভবনের চারপাশে রয়েছে অনেকের কবর। এর ওপরের ছাদে রয়েছে তিন-চারটি কবর। চারপাশের ছাদের ঠিক মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছে আরেকটি বর্ধিত ভবন বা মিনার। এর ঠিক মাঝখানেই হুমায়ুনের সমাধি। হুমায়ুনের কবরের চারপাশে রয়েছে আরো কয়েকটি কবর। যা তার স্ত্রী ও অন্যান্য মুঘল পরিবারের সদস্যদের। মূল গম্বুজটিও দু’তলা বিশিষ্ট। কবরের চারপাশে আটটি গেট আছে। চারপাশ থেই এখানে আলো ও বাতাসের আনাগোনা। একই স্থাপত্যরীতি ও প্রযুক্তি তাজমহলেও লক্ষ্য করা যায়। সমাধির বাইরে কোনো বাতাস নেই। অথচ ভবনের ঠিক ভেতরেই হুহু বাতাস।
এখানে আছে হুমায়ুনের পতœী হামিদা বেগমের কবরও। ঠিক যেভাবে মমতাজ মহালের পাশেই সমাহিত শাহজাহান। হুমায়ূনের পাশে সেভাবেই হামিদা বানু। শাহজাহানের পুত্র দারাশিকো, আছে জাহান্দার শাহ, ফারুক শিয়ার, ও দ্বিতীয় আলমগীরের সমাধিও আছে এখানে। শাহজাহান যে হুমায়ুনের ভক্ত ছিলেন তারই নজির তার এক কন্যা ও এক পুত্রের কবর এখানে। যে কেউ তাজমহল ও হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র ভ্রমণ করলে সহজেই বুঝতে পারবেন শাহজাহান তাজমহলের অনুপ্রেরণাটি কোত্থেকে পেয়েছেন। হ্যাঁ, শাহজাহান তার দাদার (আকবর) মায়ের কাছেই পেয়েছেন এ অনুপ্রেরণা।
হুমায়ুনের কবর মুঘল সাম্রাজ্যের আরো অনেক রাজকীয় স্থাত্রের পূর্বসূরি।
এরপর আমরা মুখ ফিরালাম গালিব একাডেমীর দিকে…

Comments

comments

About

Check Also

করোনা ভাইরাস এপেডেমিক থেকে পেনডেমিক: একটি পর্যালোচনা

একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মহামারীর নাম করোনা ভাইরাস বা (COVID-19)। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে সারা পৃথিবী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *