ভালবাসার জন্য ভাংচুর : একটি অবমূল্যায়িত দর্শন

পশ্চিমা মিডিয়া ও কুচক্রী মহল কদিন পরপর ইসলামের নবী সায়্যিদিনা মুহাম্মদ (স.)-এর জীবন বিকৃতভাবে উপস্থাপন এবং কুরুচিপূর্ণ চিত্র অঙ্কন করে মুসলমানদেরকে উস্কানি দেয়ার প্রয়াস পায়। তারা জানে, এই একটি ইস্যুতেই সারা দুনিয়ার মুসলমান সমতালে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে। করেও তাই; কেউ যুক্তি বুদ্ধি দ্বারা আবার কেউ রক্তের লাল কালিতে। তবে প্রতিক্রিয়া হয়; হয় চরম প্রতিবাদ।
এরপর যারা বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় জবাব দিয়েছিল তাঁদেরকে “মুক্তচিন্তার প্রতিবন্ধক” বলে প্রচার করা হয়। আর যারা সহিংস প্রতিবাদ করেছিল তাঁদেরকে “জঙ্গি” খেতাব দিয়ে হত্যা করা হয়। এই প্রক্রিয়া নিউক্লিয়ার চেইন রিএকশ্যানের মতো চলমান।
তবে এই চলমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফাঁকে একটি ‘দর্শন’ অবমূল্যায়িত থেকে যায়। অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না। সেটি কী, তা বলার পূর্বে একটুখানি প্রেক্ষাপট আলোচনা করা প্রয়োজন।
মুসলিম উম্মাহ ১৬০ কোটি মানুষের একটি শতদাবিভক্ত কাফেলা। সাড়ে চৌদ্দশ বছরের যাত্রায় প্রথম দুই প্রজন্ম বাদ দিলে, এর পরে এই উম্মতের কোন বৃহৎ শক্তিশালী ঐক্য গড়ে উঠেনি। খেলাফত-সালতানাত অনেক কিছুই ছিল। তবে খোলাফায়ে রাশিদার পর এই উম্মত আদর্শের ভিত্তিতে আর সুদৃঢ় হয়নি। ১২৫৮ সালে আব্বাসিয় খেলাফতের পতনের পর ‘একক শক্তি’ রূপটি হারিয়ে যায়। তবুও এদিক ওদিক কিছু শক্তি গড়ে উঠেছিল পরবর্তী সাড়ে ছয়শ বছরে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানী (অটোমান) খেলাফতের পতনের ফলে সেই শক্তিও নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৯২৩ সালের পর থেকে অদ্যাবধি মুসলিম উম্মাহ ঐক্য, শক্তি ও শৌর্যবীর্যের সংজ্ঞা হাতড়ে বেড়াচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। এটি উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য বড় পরীক্ষা বটে। আজ যখন কোন ক্রিয়া কিংবা ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়, তখন ঐক্য-শক্তির অভাবটি খুব প্রকটভাবে উপলব্ধ হয়। মনে হয়, আজ যদি একটি একক শক্তিশালী খেলাফত কিংবা সালতানাতও থাকত, তবে একটি জবাব দেয়া যেত। সেই জবাব বুদ্ধিবৃত্তিক হলে তো কথাই নেই। এমনকি যদি জবাবটি সহিংসও হত, তথাপি একে জঙ্গিবাদের নাম দেয়া হতনা। কারণ, এই বিশ্বের যে দৃশ্য আমরা দেখছি, তাতে সবলের দ্বারা দুর্বলের উপর নির্যাতন করাকে জঙ্গিবাদ বলা হয়না। কেবল দুর্বলের প্রতিবাদকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ইত্যাদি বলা হয়। সারা দুনিয়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা যুক্তরাষ্ট্রকে আজ পর্যন্ত কেউ জঙ্গি বলতে পেরেছে? কিংবা ন্যাটোকে?
যখন ঐক্য-শক্তির এই অভাব বোধ হয়, আবার কিছু করাও জরুরি হয়ে পড়ে, তখনই কিছু মানুষ সহিংসতার পথ বেছে নেয়। তবে এটি কোনভাবেই কাম্য নয়। সহিংস ভাংচুরে সুদূরপ্রসারী কোন লাভ তো হয়ই না; উল্টো শার্লি এবদোর মত থার্ডক্লাস ট্যাবলয়েড রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায়।

যে অবমূল্যায়িত দর্শনের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তা হল- মুসলমানদের সবরকম প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে একটি কথা খুব স্পষ্টরূপে ফুটে উঠে। সেটি হল-ভালবাসা। তর্কহীন, যুক্তিহীন, বিবেকবুদ্ধিহীন অন্ধ ভালবাসা। ভালবাসা ঐ একজন মানুষের জন্য, যিনি শিখিয়েছিলেন ‘আল্লাহ এক’। পৃথিবীর সবচেয়ে খাঁটি এই ভালবাসাটি বুদ্ধিজীবীদের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। রয়ে যায় অবমূল্যায়িত।
এই উম্মত বিশ্বাসে-সন্দেহে, আইনে-সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে-অর্থনীতিতে সর্বত্রই বিভক্ত। অন্য কোন ইস্যুতে এই উম্মত একত্র হয়ে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেনা। অন্যধর্মীদের প্রতিবাদ কী করবে; এই উম্মত বাকি তামাম ইস্যুতে নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে অবস্থান করে। কোন সাধুচার এই উম্মতকে এক করতে পারেনা। তবে হ্যাঁ, কোন সাধুচার এক করতে না পারলেও কুচক্রীদের একটি অনাচার কিন্তু এই উম্মতকে এক করে দেয়। সেই অনাচারটি খুব বড় কিছু না। কেবল নবী মুহাম্মদ (স.)-কে নিয়ে একটি বিকৃত ছবি, কখনোবা একটি কুরুচিপূর্ণ কৌতুক, আবার কখনো কেবল একটি অপমানকর বাক্য। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে একশ ষাট কোটি মানুষের সবকটি শিরা-উপশিরা বেয়ে উত্তপ্ত রক্ত সোজা মস্তিস্কে গিয়ে ঠেকে। কালবোশেখির ঝড় উঠে। এমনকি যে মানুষটি ঈমান-ইসলামের সংজ্ঞা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল, তার ভেতরেও হঠাৎ কোথা থেকে জানি একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ধপ করে জ্বলে উঠে।
দেখুন না, চৌদ্দশ বছরের উপরে হয়ে গেল; আজো একটি মুসলিম শিশু জন্ম নিলে তার নামের আগে-পিছে মুহাম্মদ নামটি যুক্ত হয়। দেড় সহস্রাব্দ পেরিয়ে গেল; আজো কেউ ঐ মুহাম্মদ নামের সাথে সামান্যতম বেয়াদবি করলেই এই উম্মত তাকে লাথি দিয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে, সে যত বড় জ্ঞানী পণ্ডিতই হোক না কেন।
ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া সবসময় যথার্থ হয়না, জানি। সহিংস প্রতিবাদ মুক্তচিন্তার প্রতিবন্ধক, জানি। কখনোবা প্রতিবাদ না করে কেবল এড়িয়া যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, জানি। তবে সবসময় এই ‘জানা’ মস্তিস্ক থেকে আসেনা; কখনো আসে বুকের গভীর থেকে। তখন আর কিছু করার থাকেনা। বুদ্ধিজীবীদের মুক্তচিন্তা ও মুক্তশিল্পের প্রতিবাদে দু’চারটি কটু কথা কিংবা উত্তপ্ত স্লোগান মুখ চিরে বেরিয়ে পড়ে। কেউবা অতিমাত্রায় রাগান্বিত হয়ে ভাংচুর এমনকি খুনখারাবির পথেও পা বাড়ায়। সেটি কোনভাবেই উচিৎ নয়। ত্রাস সৃষ্টি করা সবসময়ই নিন্দনীয়।
তবে এই ভাংচুর হিংসা কিংবা লোভের বর্শবর্তী হয়ে করা হয়না; এই ভাংচুর করা হয় ভালবাসার টানে। এই উম্মত তাঁদের নবী সায়্যিদিনা মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব আল-হাশেমী আল-কুরাইশী আল-আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লামকে নিজেদের প্রাণের চেয়েও অধিক ভালবাসে এবং এই ভালবাসার সাথে কোন আপস করেনা। কী করবেন বলুন? অকৃত্রিম, নিখাদ, হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাগুলো এমনই হয়।
আস-সালাতু ওয়াস-সালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ
আস-সালাতু ওয়াস-সালামু আলাইকা ইয়া হাবিবাল্লাহ

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *