ভারতীয় ইসলাম ও সংস্কৃতি মুসলমানদের ইতিকথা

ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুসলিম অবদানের পরিমাণ নির্ণয় খুব সহজ না। এক সংস্কৃতিতে অন্য সংস্কৃতির প্রভাব পরিমাণ নির্ধারণ একটি দুঃসাধ্য কাজ। জাতীয় জীবনই হলো সংস্কৃতির রূপায়ণ। সংস্কৃতি নিয়েই জাতীয় জীবনের বেসাতি। সংস্কৃতির পটভূমিকা হতে জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে বিশ্লেষণ করে দেখা এবং ভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব জাতীয় জীবনে কতদূর কার্যকর এবং প্রতিফলিত, তার পরিমাণ নির্ণয়ে যে সাধনা এবং মুক্তবুদ্ধি-প্রবুদ্ধ মানসিকতার প্রয়োজন, তা আজ আমাদের অনেকের মাঝেই পরিলক্ষিত হয় না। এতৎসত্ত্বেও, ভারতীয় জীবনের কয়েকটি প্রধান অভিব্যক্তিতে মুসলিম সংস্কৃতির যে সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে, তৎপ্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমার বর্তমান এ আলোচনার অবতারণা।
ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আরবরাই ভারতের প্রাচীনতম মুসলিম আগমনকারী। হজরত মুহম্মদ সা.’-এর জীবদ্দশায় (৭৫১-৬২৩ খ্রি.) তাঁর এক শিষ্য কাফেলা সরন্দীপ বা শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত কিংবদন্তী -বিশ্রুত হজরত আদম আ.-এর পদচিহ্ন দর্শনার্থী হয়ে লঙ্কাভিমুখে সমুদ্র পথে যাত্রা করেন। এ আরব তীর্থযাত্রিগণ মালাবার উপকূলে ‘চেরুমান পেরমল’য় জনৈক হিন্দু রাজার সঙ্গে ‘ক্রেঙ্গানো’ তে সাক্ষাৎ করে হজরত মুহম্মদ সা. কর্তৃক চন্দ্র বিভাজন কাহিনী বর্ণনা করেন। রাজা তাদের মুখে শোনা এ অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিশ্বাস করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। আরব মুসলমানগণ লঙ্কা হতে তীর্থ সমাধা করে যাওয়ার সময় রাজা ‘চেরুমন পেরুমল’ গোপনে তাদের সঙ্গে হজরত মুহম্মদকে সা.-এর সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য মক্কায় যান। গমনকারী তাদের একজনের নাম ছিলো শরফ বিন মালিক। রাজা কিছু দিন আরবে থেকে দেশে ফিরে ইসলাম প্রচারে বদ্ধপরিকর হলে, তা পরিপূর্ণ হয়ে উঠেনি এর ভেতরেই তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি শরফ বিন মালিক ও তাঁর সঙ্গিগণকে মালাবারে ইসলাম প্রচার করতে অনুরোধ করেন এবং একপত্রে এই অনুরোধের কথা রাজ্যের প্রধানগণকে জানিয়ে দেন।
রাজার মৃত্যুর পর,শরফ বিন মালিক ও তাঁর বন্ধুগণ রাজার অনুরোধপত্র সঙ্গে নিয়ে যথাসময়ে ‘ক্রেঙ্গানোরে’ এসে উপস্থিত হোন এবং রাজপ্রধানগণ কর্তৃক তা গ্রহণ করেন। রাজপ্রধানগণ তাঁদেরকে বাসবাসের জন্য এক খণ্ড ভূমি দান করেন। এবং তথায় তাঁরা একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই ধর্মপ্রচারক দলের একজন মালিক বিন দীনার এস্থানে থেকে যান। তাঁদের মধ্য হতে অন্য আরেক ধর্ম প্রচারক, মালিক বিন হবীব সমগ্র মালাবারে ধর্ম প্রচার ও মসজিদ নির্মাণ করে ঘুরে বেড়ান। তার যাত্রাপথে সর্বপ্রথম ‘কুইলন’ এবং তারপর ‘হিল্েিল মরবীতে মসজিদ নিরর্মাণ করেন। এবং ধীরে ধীরে আরও সাত সাতটি স্থানে মসজিদ নির্মাণ করেন। পরিশেষ তিনি ‘ক্রেঙ্গানোরে ’ ফিরে যান। মালাবারের ‘মোপলা’- দের মধ্যে এখনও এক প্রকারের বিকৃত আরবি ভাষার প্রচলন আজও বিদ্যমান। ভারতের সঙ্গে মুসলিম সম্বন্ধের প্রাচীনতম ইতিহাস রূপ এই। যা যুদ্ধ -বিগ্রহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তারপর আরবি – বণিকেরা ভারতে আগমন করতে থাকেন। এবং ভারতের উপকূলীয় বন্দরসমূহে ব্যবসা বাণিজ্য করেন পাশাপাশি ধর্ম প্রচারও করেন। তাদের হাতও ভারতীয় শোণিতে রঞ্জিত হয় নি। ভারতে যখন হর্ষবর্ধন রাজত্ব করছিলেন, তখন আরবে হজরত উমর (রা.) খলীফার পদে সমাসীন। হর্ষবর্ধনই (মৃত্যু- ৬৪৮ খ্রি.) হলেন ভারতের শেষ হিন্দু সম্রাট। তার মৃত্যুর পর ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
হযরত উমর রা.-এর খিলাফতকালেই ছিলো (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.) মুসলিম রাজ্য বিস্তৃতির স্বর্ণময় যুগ। এবং তখনই ভারতীয় উপকূলভাগ কয়েকবার মুসলমান কর্তৃক আক্রান্ত হয় বলেই আল বলাজুরী ‘ফাতহুল বুলদান’ বা ‘নগরী বিজয়’ নামক ইতিহাসে আজও লিপিবদ্ধ। এসমস্ত আক্রমণ ছিলো সাময়িক; তাতে আরবদের কোনো স্থায়ী ফললাভ হয়নি। ৬৬৪ খৃস্ট. আরব সেনাপতি আল মুহাল্লাব কর্তৃক স্থলপথে মুলতান বিজয়ও একটি অনুরূপ ঘটনা।

তারপর ৭১১ খৃস্টা. মুহম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু-বিজয় ভারতের ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করে। নানা কারণে তার সিন্ধু অধিকার একটি স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। সিন্ধু দেশে মুসলিম রাজত্ব বেশী দিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি,তার পর থেকে ভারতের সঙ্গে আরব জাতির ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্বন্ধ একরূপ পাকাপাকিভাবে স্থাপিত হয়। খৃস্ট. অষ্টম,নবম, দশম ও একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে এই সম্পর্ক অবিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্যি, ভারতের সঙ্গে ইউরোপ ও আফ্রিকার বাণিজ্য এ সময়ে আরবী মুসলমানদের মধ্যস্থতায় চলছিলো। কেরল, সুরাট, কালিকট প্রভৃতি সমুদ্রতীরবর্তী বন্দরমালা, মালদ্বীপ, লাক্ষ্যদ্বীপ ও সরদ্বীপ প্রকৃতি ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ এবং লাহোর, মুলতান, কাবুল প্রভৃতি ভারতীয় ও ভারত প্রভাবিত নগরগুলি এ সময়ে গড়ে উঠে। এবং তা বহিঃর্বিশ্বের নিকট পরিচিতি লাভ করে। বলাবাহুল্য, কেবল ব্যবসা- বাণিজ্যের জন্যই মূলত এ সমস্ত স্থানের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
আরবি মুসলমানদের সঙ্গে ভারতের এ দীর্ঘ সংশ্রবের কি কোন ফল ফলে নি ? এ সময় ভারতে সাংস্কৃতিক জগতে যে কতিপয় ফল ফলেছিলো, তন্মধ্যে নিম্নের কয়েকটি প্রধান বলে আজও স্বীকৃত।
১.
দেখা যায়, ভারতীয় সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য স্থানগুলোর (যেমন-মিশর, বাবিল, উর, কালদিয়া, ফিনিসিয়া প্রভৃতি) সংস্কৃতি হতে খুব অল্প প্রাচীন না হলেও, স্মরণাতীতকাল হতে ভারতবর্ষ নিকটবর্তী ব্রহ্ম, মালয়, শ্যাম, লঙ্কা প্রভৃতি কতিপয় এশীয় অঞ্চল ব্যতীত সভ্য জগতের জন্য কোন অংশের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত ছিল না। কালক্রমে ভারতের সঙ্গে এ সমস্ত অঞ্চলের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারতের সঙ্গে আরবী মুসলমানদের সংশ্রবকালে ভারত একরূপ একক ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করিতেছিল। ভারতবাসী মনে করতো, তাদের এ নিঃসঙ্গ জীবনই পরিপূর্ণ জীবন। এই আত্মতৃপ্ত ও আত্মসমাহিত জীবনের ফাঁকে যে অপরিপূর্ণতা বিরাজ করিতেছিল, তা তখনও ভারতবাসীর নিকট প্রকট হয়ে ধরা পড়ে নি। ভারতে আরবি মুসলমানদের আগমনে, ভারতীয় সংস্কৃতির দুর্বলতা ভারতবাসীর নিকট প্রকট হয়ে উঠে। মুসলিম সংস্কৃতিকে সম্মুখে উপস্থিত দেখে তার সঙ্গে তুলনামূলক সমালোচনায় ভারতীয় মনমানস এ সময় হতে আপন সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট ও স্বাভাবিকভাবেই সজাগ হয়ে উঠতে থাকে।
২.
আরব মুসলমানদের আগমনেই ভারতের সঙ্গে বহিঃর্বিশ্বের যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ভারতের নিঃসঙ্গত্ব ভেঙ্গে পড়ে। প্রাচীন কাল হতে অমূল্য ও অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও শ্রমজাত সম্পদের অধিকারী হলেও, আপন নিঃসঙ্গতার জন্য এ সমস্ত সম্পদের বিষয় ভারত বিশেষভাবে অবগত ছিলো না। আরব বণিকেরাই ভারতের এ সম্পদ একদিকে স্বয়ং ভারতের নিকট এবং এন্যদিকে ইউরোপ ও আফ্রিকার নিকট পরিচিত করে দেন। এ সমস্ত বাণিজ্য সম্পদের জন্যই ভারতের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এবং এভাবেই ভারতের পরিচয় এবং পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী তার প্রতিষ্ঠা ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে আরবি মুসলমানেরই এক অপূর্ব অবদান।
৩.
বহিঃর্বিশ্বে বাণিজ্য সম্পর্কে প্রাচীন ভারতের কোন ধারণাই ছিলো না। তবে আন্তর্বাণিজ্য সম্বন্ধে ভারত পূর্ব হতেই অবগত ছিলো। ভারতীয় প্রদেশগুলিতে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচলিত বটে, কিন্তু তদদ্বারা ভারতের আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধির আয়োজন করা হয় নি কখনো। বাণিজ্য সম্বন্ধে প্রাচীন ভারতীয় ধারণা ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির ধারণা-জাতি ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ধারণা নেই। নিম্নের সুপ্রসিদ্ধ সংস্কৃত শ্লোকটি বিশ্লেষণ করে দেখলে উক্ত উক্তির বাস্তবতা সহজে বোঝেত আসে:
“বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীস্তদর্ধং কৃষিকর্মণি।
তর্দধং রাজসোয়াং ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ।”
অনুবাদ, বাণিজ্যে গৃহস্থের সৌভাগ্য অর্থাৎ বাণিজ্য দ্বারা পর্যাপ্ত অর্থসংগ্রহ হয়, কৃষিকর্মের দ্বারা তার অর্ধেক পাওয়া যায়, রাজসেবা বা চাকরি দ্বারা তারও অর্ধেক পাওয়া যায়, কিন্তু ভিক্ষায় সামান্যও লাভ হয় না।
৪.
ভারতে হিন্দু ধর্মের পার্শ্বে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা এ কথা যারা বলেন বা মনে করেন, বা ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম ধর্মও এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানানো হয়েছে, তাদের গভীর ঐতিহাসিক জ্ঞানের প্রশংসার সঙ্গে বিভ্রান্ত সৃষ্টির যশোগাথাও ঘোষণা দিতে হয়। ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ইতিহাস, শান্তি প্রবর্তনেরই ইতিহাস। এ ইতিহাস কোনো কলঙ্কিত নয়। প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের অন্তর্নিহিত গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস, আত্মত্যাগ ও প্রবল প্রেরণাই সে যুগে ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রধান কারণ। পরবর্তী যুগের মুসলিম রাজ্য পূর্ব প্রতিষ্ঠিত ইসলামের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত ও সুদৃঢ় করে দিয়েছে মাত্র। চলবে
আরবদের পরই খৃস্টীয় একাদশ শতাব্দী হতে মুসলিম তুর্কীগণ ভারতে আসতে থাকেন। এবং তারাই ভারতের ইতিহাসে প্রথম ‘পাঠান’ নামে আজও পরিচিত। গজনবীর সুলতান মাহমুদ (১০০০ খৃস্টা.) কর্তৃক পাঞ্জাব বিজয় হওয়ার পর হতে ভারতের এ প্রদেশ সুদীর্ঘকালের জন্য মুসলমান রাজ্যভুক্ত হয়। অতঃপর খৃস্টীয় ১২০০ হতে দিল্লীতে যে তুর্কী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তা আর লোপ পায় নি ; আফগান ও মোঘলগণ তুর্কীদের উত্তরাধিকারী হয়ে ভারতে মুসলিম শাসন বজায় রাখেন। এ সময়ে ভারতের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মুসলিম রাজ্য বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠিত এবং মুসলমানদের ধর্ম-কর্ম, আচার-ব্যবহার ও রাজ্যশাসন-ব্যবস্থা বিকীর্ন হয়।
ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত হওয়ার ফলে এদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন প্রভাবও অনুভূত হয়। হর্ষবর্ধনের (মৃত্যু : ৬৪৮ খৃস্ট.) পর ভারতে কোনো হিন্দু রাজা একচ্ছত্র রাজত্ব করেন নি। এ সময়ে ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডরাজ্যে বিভক্ত হয়ে আত্মঘাতী বিষ পান করে। তখনকার ভারতীয় সংস্কৃতির মূল উৎস এক হলেও ভারতের রাষ্ট্রীয় ভিন্নতা সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় রূপান্তরিত হতে থাকে। এ কারণেই আজও মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ এবং বাঙ্গালী ব্রাহ্মণে, কিংবা মাদ্রাজী হিন্দু এবং মৈথিল হিন্দুতে এত প্রভেদ। এ কারণেই মনুসংহিতা ভারতের সর্বত্র হিন্দুদের মধ্যে একমাত্র ধর্মীয় বিধানরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে নাই বা করতে সামর্থ হয় নি। এই কারণেই ভারতের হিন্দুদের মধ্যে দেশে দেশে নতুন শাস্ত্র, নতুন বিধান এবং নতুন আচার -বিচার আজ পরিলক্ষিত হয়।
কেউ তখন কল্পনা করতে পারেনি, সমগ্র ভারত এক রাজার শাসনে শাসিত হবে। কেউ তখন ভাবতে পারেনি,ভারত এক রাজার শাসনে শাসিত হয়ে কখনও এক রাজ্যের স্বপ্ন দেখতে পাবে। কেউ তখন মনে করেনি, ভারতীয় হিন্দুরা কখনও উপলব্দি করবে যে, তারা এ দেশের অধিবাসী এবং একই ধর্মের অনুসারী। একমাত্র মুসলমান রাজত্বকালেই তা সম্ভব হয়।মুসলমান আমলে ভারতে রাজনৈতিক একত্ব ও একচ্ছত্রত্ব, ভারতীয় সাংস্কৃতিক একত্বকে এবং ভারতীয় রাষ্ট্রের একচ্ছত্রত্বকে সুদৃঢ় করে তুলোছিল।
পাক-মুসলিম-ভারত বিশ্বপরিবারে একরূপ একক ও নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছিলো। এইম নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব ভারতের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় নি। তা ভারতবাসীর রাষ্ট্রীয় জীবন গ্রাস করে মানস -রাজ্যেও প্রবেশ করেছিলো। সে সময় রাষ্ট্রীয় জীবনের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে মানসিক সষ্কীর্ণতাও ভারতীয়দের মনে ক্রমশঃ দানা বাঁধতে শুরু করে। তাদের এ মানসিক সঙ্কীর্নতাও কালক্রমে এক একটি সংস্কারে এবং পরে সেই সংস্কারগুলি ধর্মে পরিণত হতে থাকে। যতোই দিন যেতে থাকে ততোই ভারতবাসী ভাই ভাই হতে লাগে। এ অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ হিন্দু জাতিকেই মহাত্মা গান্ধী ‘হরিজন’ নামে অভিহিত করেন। এ সময় মুসলমানগণ ইসলামের সাম্যের বাণী নিয়ে মানবতার জয়গান গেয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তাদের এ বাণীকে দরবেশ ও মুসলিম সাধকেরা আপন জীবনে রূপদান এবং শাসক সম্প্রদায় রাষ্ট্রীয় জীবনে গ্রহণ করে। ভারতীয়রা তখন ই প্রথম শুনে, “ মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। শিক্ষা- দীক্ষা, ব্যবসা- বাণিজ্য, ক্ষমতা, রাজপদ ও জীবন -জীবিকা মানুষকে মানুষ হতে পৃথক, উত্তম অথবা অধম করতে পারে না। সকল মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি। তার ইচ্ছে ও ইঙ্গিতেই সমস্ত সৃষ্টি হয়েছে, হচ্ছে আর হবে।”
তখন ইসলামের এ সুদৃঢ় “তৌহিদ” বা একত্ববাদ এবং এই বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী এক মহা চিন্তা-বিপ্লবরূপে দেখা দিয়াছিলো। প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ এ বৈপ্লবিক চিন্তার আধার ও বাহনরূপেই জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মধ্যযুগে এসেও এ চিন্তা বিপ্লবে ভাটা পড়ে নাই, অবশ্য তখন এরর বেগ ক্রমশ মন্দভূত হয়ে আসতেছিল। এতৎসত্ত্বেও প্রাচীন ভারতীয় হিন্দুর সনাতন চিন্তাধারায় মুসলমানেরা বিপ্লব আনতে সমর্থ হয়। ভারতে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতার অনুধ্যানে, ইসলামের ‘তৌহিদ ’ দারুণ আঘাত আনে; ভারতের বর্ণ – হিন্দু পীড়িত অন্ত্যজ- জাতিগুলি ইসলামের বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের বাণী শুনে এবং কর্মক্ষেত্রে সে বাণীর কোন ব্যতিক্রম না দেখে উল্লাসে মুসলমানগণকে মুক্তিদাতারূপে বরণ করতে থাকে। ভারতের লোক দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লাগে। ফলে, ভারতে ইসলাম ধর্ম উত্তরোত্তর সম্প্রসারিত হতে শুরু করে এবং ভারতীয় সনাতন হিন্দু -ধর্মের পার্শ্বে অর্বাচীন ইসলাম ধর্ম সুদৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতেই শঙ্কারাচার্যের মতবাদে ইসলামের প্রভাব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
তাতে ভারতের মানসিক সঙ্কীর্ণতা বিদূরিত এবং মানসিক দৃষ্টিও কতকটা সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য হয়। কেননা, ভারতীয়রা তখন দেখললো যে, পৃথিবী শুধু ভারতবর্ষ নয় এবং প্রথিবীর লোক শুধু হিন্দু নয়, এ সমস্ত লোকের ধর্ম, আচার -ব্যবহার, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতি ভারতীয়দের চেয়ে কোন অংশে খর্ব ও নিকৃষ্ট নয়, বরং কোনো কোনো অংশে উন্নত ও উৎকৃষ্ট। ইসলামের প্রতি পুরোহিত শ্রেণীর অর্থাৎ রাহ্মণ শ্রেণীরও তখন দৃষ্টি পড়লো। এ বিদ্যান ও বুদ্ধিজীবী ভারতীয়গণই ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির সনাতন ধর্মের (হিন্দু -ধর্মের) একটি বুঝাপড়া করতে তৎপর হয়ে পড়লো। ফলে আল্লাহকে ভারতের সনাতন-ধর্মে স্থান দেবার জন্য খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বা তৎপরবর্তী পুরোহিত শ্রেণীর দ্বারাই “ অল্পোপনিষদ ” নামে এক নূতন উপনিষদ রচিত হয়। তাতে আল্লাহ ও তার প্রেরিত পুরুষ হজরত মুহম্মদ (সা.) এর মহিমা পরিকীর্তিত হয়। পুরোহিত শ্রেণীর এ চেষ্টা কতটা সফল হলো তা বলা যায় না, তবে তাদের দ্বারা রচিত “ অল্পোপনিষদ ” এখনও ভারতীয় হিন্দুগণ রক্ষা করতেছেন। ভারত বেদ-বেদাত্তের দেশ। কিন্তু পুরোনের লীলাক্ষেত্র। মুসলমান শাসনের পূর্বে, ভারত বেদ-বেদাত্তকে একরূপ ছেড়ে দিয়ে পৌরাণিক উপাখ্যান ও পূরাণ -চর্চায় ডুবে থাকে। এ যুগেই ভারতে মূর্তিপূজা প্রবল হয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতা ঢুকে পড়ে। এ শাসনে ভারতের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে পুরাণ যেরূপ প্রবল হয়, ভারতীয় সংস্কৃতির মূল উৎস বেদ-বেদান্ত তেমনি তলিয়ে যায়। ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয়রা নতুন করে বেদ-বেদান্ত চর্চায় মনোনিবেশ করেন। কেননা একমাত্র বেদ-বেদান্ত ব্যতীত নিরাকার ঈশ্বরবাদী মুসলিম সংস্কৃতির সম্মুখীন হওয়ার মতো শাস্ত্রীয় গ্রন্থ তাদের নিকট বেশী ছিলো না।
মুসলমান শাসনামলে ভারতে ভক্তিবাদ প্রবল হয়। গীটার ভক্তিযোগের প্রতি ভারতীয় হিন্দুদের বিশেষ প্রবনতাও পরিলক্ষিত হয়। খৃস্টীয় একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে দাক্ষিণাত্যে রমানুজ কর্তৃক ‘বৈষ্ণব’ মত প্রচার এবং চতুর্দশ শতাব্দীর রামানন্দ কর্তৃক “রামাৎ বৈষ্ণব”- বাদ ঘোষণা, ভারতে ভক্তিবাদের জয় প্রকাশ করে। ইসলাম ধর্ম প্রধানতঃ বিশ্বাস ও ভক্তির ধর্ম। এই ধর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াবার জন্য বৈষ্ণববাদ প্রচারের আবশ্যকতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং বলতেই হয়, ভারতের পরবর্তী ভক্তিবাদ মুসলিম সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ বলে অস্বীকৃত হলেও পরোক্ষ অবদান বলে স্বীকার না করে উপায় নেই।
মুসলমানদের সঙ্গে তাদের মর্মবাদী (সুংঃরপ) সূফী সাধকরাও ভারতে প্রবেশ করেছিলো। ভারতে মুসলিম সংস্কৃতি ও ইসলাম ধর্ম প্রচারে এদের দান অপরিসীম। ভারতের সাধু সন্ন্যাসীরা পাতঞ্জল মুনির যোগ সাধনা লয়ে সূফী সাধকের মোকাবিলা করেছিলো। ফলে মুসলমান সূফীরা হিন্দু-শিষ্য এবং হিন্দু-সন্ন্যাসীর মুসলমান চেলা দেখতে পাওয়া যায়। সাধনার ক্ষেত্রে এরূপ ভাবের বিনিময়ে ভারতীয় সংস্কৃতি যে বিশিষ্ট রূপ গ্রহণ করে থাকে, তা অল্প কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করতে পারি, মধ্যযুগীয় ভারতেই কবীর (১৩৯৮-১৪৪৮), নানক (১৬৯-১৫৩৯), দাদু (১৫৪৪-১৬০৩) ও চৈতন্য দেবের (১৪৮৪-১৫৩৩) ন্যায় ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারকের জন্ম সম্ভবপর হয়েছিলো এবং এ সংস্কৃতির অন্য যুগে এদের ন্যায় মহাপুরুষগণের আবির্ভাব সম্ভবপর হয় নি। এদের আবির্ভাবে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব, এমন কি এদের জীবনেও ইসলামিক প্রভাব দেদীপ্যমান। এদের সকলেই একেশ্বরবাদিতায় প্রবুদ্ধ এবং মানুষে-মানুষে, ধর্মে -ধর্মে ভিন্নতর বাঁধ ভাঙ্গিয়া দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ইসলামের ঔদার্য্য ও ভ্রাতৃভাবকে গ্রহণ করে ভারতের অস্পৃশ্যতাকে দূরীভূত করে দেওয়ার সাধনার সাধনাই এদের জীবনের সাধনমালার অন্যতম।
আমরা পূর্বে দেখেছি, ভারতের রাষ্ট্রীয় একত্ববোধ মুসলমানদের আমলেই জেগেছে। এ রাষ্ট্রীয় একত্ববোধ ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে রূপ গ্রহণ করতেছিললো। উদাহরণসরূপ উর্দু ভাষা উদ্ভবের কথা উল্লেখ করা যায়। একদিকে রাষ্ট্রীয় একত্ববোধ এবং অন্যদিকে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ভাব বিনিময়ের আবশ্যকতার মৌলিক উপলব্ধি হতেই এ ভাষার উদ্ভব ঘটে। একেও আরো একটু স্পষ্টতর করে বলা উচিত।
একথা সত্য যে, উত্তর ভারতী সমুদয় ভাষা প্রাচীন ভারতীয় আর্যা -ভাষা (যা পরবর্তীকালে প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হইয়াছিল) হতে সমুৎপন্ন। এতৎসত্বেও উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ভাষা পরস্পর এতই বিভিন্ন যে, এক ভাষাভাষীর অন্য ভাষাভাষীকে বুঝবার উপায় নাই। এ বিভিন্নতা মধ্য যুগীয় বিভিন্নতা নয়। ভারতে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই উত্তর ভারতীয় প্রদেশিক ভাষা পরস্পর বিভিন্ন হয়ে রূপ পরিবর্তন করেছিলো। এর কারণ খুঁজতে গেলে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্নতাই সকলের আগে মনে পড়ে, কেননা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা যখন প্রাকৃতে বিবর্তিত হলো, সৌরসেনী, মাগধী, উদীচ্য, প্রাচ্য প্রাকৃতরূপেই আখ্যা লাভ করলো। এগুলি প্রয়ই এক একটি রাষ্ট্রীয় মণ্ডলের নাম। মুসলমান রাজত্বের প্রারম্ভে উত্তর ভারতীয় এক প্রদেশ অন্য প্রদেশকে বুঝতো না বা বুঝতে পারতনা। মুসলমান আমলে প্রায় সমগ্র ভারত এক শাসনাধীন হয়, ভারতের নানা প্রদেশের লোক মুসলিম রাজধানী দিল্লি ও আগ্রায় সমবেত হতে বাধ্য হয়। এতদ্ব্যতীত এ দু’স্থানে বোখারা, সমরকন্দ, তুর্কীস্থান, কুর্দীস্তান, ইরান, ইরাক, তুরান, আফগানিস্তান, মিশর, বাগদাদ, বসরা প্রভৃতি স্থানের বহু লোক নানা কার্যব্যপ্রদেশে সমবেত হয়েছিলো। মুসলিম শাসন -কালের গোড়ার দিকে, কেবল বিদেশীয় মুসলমানদের মধ্যে ভারতে তুর্কী ভাষা ও সংস্কৃতি প্রবল ছিলো বটে, কিন্তু তা বেশী দিন চলে নি। ভারতে ফারসী ভাষাই রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হয়েছিলো এবং ইরানী সংস্কৃতিই মুসলিমদের মধ্যে জোর চলছিলো।
মুসলমান আমলের গোড়ার দিকে ভারতীয় কিংবা অভারতীয় কারও মধ্যে পরস্পর ভাবের আদান – প্রদানের জন্য কোন সাধারণ ভাষা ছিলো না। এ অভাবটি মুসলমানদের শিবির- জীবনেই সর্বাধিক অনুভূত হয়। ভারতে খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুসলিম জীবন শিবির-জীবনরূপেই অধিক মাত্রায় কাটে। এ শিবির-জীবনে ভারতীয়দের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ রক্ষা করা একান্তই আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ সময় হিন্দী -ভাষার যে কয়েকটি রূপ প্রচলিত ছিল, তন্মধ্যে ‘ব্রজভাষা’ অন্যতম ; এটা দিল্লী, আগ্রায় এবং তৎপার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে প্রচলিত ছিল। ভারতীয় ও অভারতীয় উভয় শ্রেণীর লোক এই ‘ব্রজভাষাকে ’ কেন্দ্র করে একটি ‘খিচুড়ি’ ভাষার সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। এ ভাষার পদবিন্যাস -পদ্ধতি হিন্দী হলেও, যে ভাবে তাতে আরবী, ফারসী, তুর্কী প্রভৃতি ভাষার শব্দ ও রীতিনীতি গৃহীত হতে লাগে, তাতে অনতিবিলম্বেই তা এক নতুন রূপ গ্রহণ করে বসে। ‘ ব্রজভাষা’ তথা পশ্চিমা হিন্দীর আধারে ঢালিয় যে নতুন ভাষার রূপ দেওয়া হয়, তার নাম হলো- উর্দু। ‘উর্দু ’ তুর্কী শব্দ; অর্থ হলো- ‘শিবির’ ‘স্কন্ধবার’ বা ‘তাঁবু’। ক্রমে ক্রমে দেখা গেল,এ ভাষার সাহায্য শুধু ‘ব্রজমণ্ডলে না, উত্তর ভারতের প্রায় সর্বত্র কাজ-কারবার চলে। এ হিশেবে তা মুসলিম আমলেই ভারতের খরহমঁধ ঋৎধহপধ বা সর্বজনীন ভাষার রূপ গ্রহণ করে। এ ভৌগলিক ও রাষ্ট্রীয় দেশরূপে ভারতীয় ধারণাকে ঘনীভূত করে তুলার পক্ষেও উর্দু ভাষার দান নিতান্তই অবহেলার সামগ্রী নয়।
ভারতে মুসলিম রাজত্ব যতই সুদৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, ভারতীয় জীবনে মুসলমান সংস্কৃতির ছাপ ততোই সম্প্রসারিত হতে লাগে। খানাপিনা, পোশাক-পরিচ্ছেদ হতে আরম্ভ করে ভারতীয় সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব ও অনুকরণ সভ্যতার নিদর্শনরূপে গৃহীত হতে লাগে। সঙ্গীতকে এবং পূজার উপাদান হিশেবে মূর্তি নির্মাণ, চিত্রাঙ্কন ও সংরক্ষণ ইসলাম যে শুধু ভাল চক্ষে দেখে নাই, তাহা নহে, বরং সুস্পষ্ট ভাষায় নিন্দা করিয়াছে।
ভারতে মুসলমান আমলে মুসলমানেরা শুধু সঙ্গীতচর্চা করেন নাই, চিত্রচর্চাও করে। তাঁদের চিত্রচর্চার রীতি, মোটামুটিভাবে ইরানী রীতি; ইহা ভারতীয় রীতি হতে পৃথক। ভারতের চিত্র-জগতে মুসলমানদের এই রীতি ভারতীয় রীতির সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে ‘মোগঘলাই রীতি’ মানে একটি পৃথক ভারতীয় অঙ্কন-শিল্পের জন্মদান করে। ভারতীয় মুসলমানেরা সঙ্গীরচর্চার জন্য চির খ্যাত। তাদের সঙ্গীত বিদ্যা ও যন্ত্র ভারতীয় এ অংশের সংগ্রবে এসে নতুন রূপ গ্রহণ করে। ফলে, ধুরপদ, ভৈরব, মেঘমল্লার, গান্ধার প্রভৃতি ভারতীয় রাগরাগিণীর সঙ্গে মুসলমানদের গজল, কাওয়ালী, দাদরা, খেয়াল প্রভৃতি মিলে যায়। বীণা, মুরলী, ঢাক, ঢোল প্রভৃতি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র জগতে মুসল্মানদের তবলা, রবার, সেতার, নাকারা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রও স্থান করে নেয়। ধীরে ধীরে ঠুমরী, টপ্পা, জৌনপুরী, আশাবরী প্রভৃতি নানা মিশ্র রাগিণীর উদ্ভবে ভারতীয় সঙ্গীতে এক যুগান্তর হয়।
মোদ্দাকথা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোন থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় সংস্কৃতি মুসলিম সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি; বরং লাভবানই হয়।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *