বিতর্ক

০১. এক দিরহানের বণ্টন
একদা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (র.) ও ইবনে শুবরুমাহ (র.)-এর মধ্যে একটা জটিল বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্কটি নিম্নে প্রদত্ত হল-
ইবনে মুবারক (র.) : এক ব্যক্তির নিকট একজনের এক দিরহাম এবং অপর এক ব্যক্তির দু’দিরহাম গচ্ছিত ছিল। উক্ত তিন দিরহাম থেকে দু দিরহাম হারিয়ে যায়। এখন উক্ত এক দিরহামের ব্যাপারে আপনার রায় কী?
ইবনে শুবরুমাহ (র.) : উক্ত এক দিরহামকে অর্ধেক অর্ধেক করে উভয় ব্যক্তির মধ্যে বণ্টন করে হবে।
ইবনে শুবরুমাহ (র.)-এর উক্ত ফয়সালাটি মনমত না হওয়ায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (র.) তার সুষ্ঠু ফয়সালার জন্য ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)-এর খেদমতে হাজির হলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (র.) ইমাম আবু হানিফা (র.) কে সম্বোধন করে বললেন,
ইবনে মুবারক (র.) : উপর্যুক্ত ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
ইমাম আযম (র.) : ইবনে শুবরুমার উত্তর সঠিক হয়নি।
কেননা তিন দিরহাম যখন একত্র করা হল তখন তিনটি দিরহামই পরস্পর শরীক হয়ে গেল। এখন হারিয়ে যাওয়া উভয় দিরহামের মধ্যে উভয় ব্যক্তি অংশীদার। অর্থাৎ একজনের দুই তৃতীয়াংশ হারিয়ে গেল আর অপরজনের এক তৃতীয়াংশ হারিয়ে গেল। অবশিষ্ট এক দিরহামকে তিন অংশ করে দুই দিরহামের মালিককে দুই অংশ আর এক দিরহামের মালিককে এক অংশ দিতে হবে।
অবশেষে ইমাম আযম আবু হানিফা (র.)-এর প্রজ্ঞাপূর্ণ সমাধানে উপর্যুক্ত বিতর্কের বিষয়টি সুন্দরভাবে মীমাংসা লাভ করে। (ইমাম আযম রহ.)

০২. আল্লাহর খাস মহল
একবার হজে গমনের পথে সৈয়দ নাসেরী নামে এক ব্যক্তি বাগদাদে এসে হযরত বাগদাদী (র.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গ আলোচনা হয়।
জুনাইদ বাগদাদী (র.) : আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
সৈয়দ নাসেরী : গীলান থেকে।
জুনাইদ বাগদাদী (র.) : আপনি কোন বংশের লোক?
সৈয়দ নাসেরী : হযরত আলী (রা.)-এর তিনি দু’ খানি তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করতেন। একখানি তরবারি ব্যবহৃত হত নফসের বিরুদ্ধে। অপরখানি কাফেরদের মোকাবেলায়।
জুনাইদ বাগদাদী (র.) : আপনি কোন্ তরবারি চালনা করেন?
সৈয়দ নাসেরী : (এ কথা শুনে সৈয়দ নাসেরী আর স্থির থাকতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে শুরু করলেন) বললেন, আমার এবারের হজ এখানেই সম্পন্ন হল। দয়া করে আমাকে মহান আল্লাহ পাকের পথ দেখিয়ে দিন।
জুনাইদ বাগদাদী : আপনার বুকখানি হল মহান আল্লাহ পাকের খাস মহল। কাজেই এর মধ্যে কোন অপবিত্র জিনিসকে স্থান দিবেন না।
তার কথা শেষ হতে না হতেই সৈয়দ নাসেরী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। (তাযকেরাতুল আউলিয়া)

০৩. তথ্যবহুল জবাব
জুনাইদ বাগদাদী (র.) কে তাঁর শিষ্যবৃন্দ কয়েকটি প্রশ্ন করেন। জুনাইদ বাগদাদী (র.) সে প্রশ্নগুলোর অত্যন্ত তথ্যবহুল জবাব প্রদান করেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হল-
শিষ্যবৃন্দ : মোরাকাবা এবং লজ্জার মধ্যে পার্থক্য কী?
জুনাইদ বাগদাদী (র.) : অদৃশ্য বস্তু লাভ করার উদ্দেশ্যে প্রতীক্ষা করা হল মোরাকাবা। আর লজ্জা হল উপস্থিতির ক্ষেত্রে শরম প্রদর্শন করা।
শিষ্যবৃন্দ : সাধনার মূল কথা কী?
জুনাইদ বাগদাদী (র.) : সৃষ্টিজগত থেকে মনকে সরিয়ে নেওয়া, স্বভাব ও রিপুর অনুসরণ থেকে বিরত থাকা, মানবীয় গুণ থেকে রিপুকে সংহার করা, রিপুর কামনা-বাসনা থেকে দূরে অবস্থান করা, মা’রেফাতের গুণ-বৈশিষ্ট্যের উপর নিজেকে সু-প্রতিষ্ঠিত করা, আল্লাহর তত্ত্বজ্ঞানে দৃঢ় হওয়া, যে সব বস্তু রোজ কিয়ামতে উপকার দিবে সে সব বস্তুর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, সবাইকে উপদেশ দান করা, আল্লাহর হক যথারীতি আদায় করা ও শরীয়তের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করা।
শিষ্যবৃন্দ : তাওহীদ কী?
জুনাইদ বাগদাদী (র.) : তাওহীদ হল, মহান আল্লাহ পাকের একত্ববাদে নিজেকে নিমজ্জিত করে নিজেকে লুকিয়ে ফেলা।
শিষ্যবৃন্দ : ফানা ও বাক্বা কী?
জুনাইদ বাগদাদী (র.) : ফানা ও ধ্বংস হল, মহান আল্লাহপাক ছাড়া সৃষ্টির সবকিছুই ধ্বংশশীল বলে বিশ্বাস করা। আর বাক্বা স্থায়িত্ব। আর স্থায়িত্ব একমাত্র মহান আল্লাহ পাকের জন্য বলে বিশ্বাস রাখা। (তাযকেরাতুল আউলিয়া)

০৪. নির্ভিক জবাব
বাগদাদের খলিফা মনসুরের খেলাফতকালে সাওয়ার বিন আব্দুল্লাহ (র.) বসরা শহরের কাজি ছিলেন। কিছু লোক খলিফা মনসুরের নিকট তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিল যে, তিনি মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাবান্বিত হয়ে মুখ চেয়ে বিচার-ফয়সালা করেন। খলিফা মনসুর তাঁকে তাঁর দরবারে আহ্বান করলেন। কাজি সাহেব যখন খলিফার দরবারে আগমন করে খলিফার সম্মুখে দণ্ডায়মান হলেন তখন খলিফার হাঁচি এসে গেল। কিন্তু কাজি সাহেব খলিফার হাঁচির উপর ‘ইয়ার হামুকাল্লাহ’ বললেন না। এতে খলিফা কাজি সাহেবকে ধমক দিয়ে বললেন-
খলিফা : আপনি আমার হাঁচির উপর ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললেন না কেন?
কাজি সাহেব : আমি এজন্যে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ পড়িনি যেহেতু আপনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলেননি। খলিফা : আমি মনে মনে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে নিয়েছি।
কাজি সাহেব : আমিও মনে মনে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ পড়ে নিয়েছি।
খলিফা মনসুর কাজি সাওয়ার বিন আব্দুল্লাহ (র.) এর নির্ভিক জবাব শুনে মুগ্ধ হয়ে বললেন, আপনি আপনার দায়িত্বে বহাল থেকে কাজ চালিয়ে যান। আপনি যখন আমাকে ভয় না করে সত্যের উপর নির্ভিক ও অবিচল থাকলেন তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল, আপনি কোন লোকের ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাবান্বিত হয়ে মুখ চেয়ে কোন বিচার-ফয়সালা করেননি। লোকেরা শুধু আপনার উপরে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। (ফয়দ্বানে সুন্নত)

১৯. রাজত্বের মূল্য এক গ্লাস পানি
বর্ণিত আছে যে, একবার হযরত ইবনে সাম্মাক (র.) বাগদাদের খলিফা হারুনুর রশীদের দরবারে উপস্থিত হলেন। এ মুহূর্তে খলিফার পানির পিপাসা দেখা দিল। তিনি পানি চাইলেন। খাদিম পানির গ্লাস খলিফার হাতে দিল। তখন খলিফা ও ইবনে সাম্মাক (র.) মধ্যে একটা বিতর্কের সূচনা হয়। নিম্নে তা উল্লেখিত হল-
ইবনে সাম্মাক (র.) : জাহাপানা! একটু থামুন, আমাকে বলুন যদি পিপাসার সময় পানি না মিলে আর আপনি পানির পিপাসায় কাতর হয়ে যান তাহলে আপনি এ এক গ্লাস পানি কত মূল্য দিয়ে খরিদ করবেন?
খলিফা : অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে।
ইবনে সাম্মাক (র). : যদি এ পানি আপনার পেটের মধ্যে চলে যায় এবং আপনার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় এবং তা বের না হয় তাহলে আপনি এর চিকিৎসার কত টাকা খরচ করবেন?
খলিফা : সম্পূর্ণ রাজত্ব।
ইবনে সাম্মাক (র.) : আমীরুল মু’মেনীন! যে রাজত্বের মূল্য এক গ্লাস পানি এবং উহার প্রস্রাব এমন রাজত্বের প্রতি আকর্ষিত থাকা কী একজন বিবেকমান মানুষের কাজ?
ইবনে সাম্মাক (রহ.)-এর এমন সারগর্ভ বক্তব্য শুনে খলিফা হারুনুর রশীদ অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করলেন এবং তাঁর কথার কোন উত্তর দিতে পারলেন না। (তারীখুল খুলাফা)
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *