বিতর্ক

০৮. হজরত ওসমান (রা.) ও হজরত ইবনে মাসউদ (রা.)-এর কথোপকথন বিতর্ক
অন্তিম রোগ শয্যায় ইবনে কাসীর (রহ.) ইবনে আসাকিরের বরাত দিয়ে এ ঘটনা বর্ণনা করেন যে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত ছিলেন তখন আমীরুল মু’মেনীন হজরত ওসমান (রা.) তাঁকে দেখতে যান। তখন তাঁদের মধ্যে শিক্ষাপ্রদ কথোপকথন হয়। তা নিম্নে উদ্ধৃত করা হল।
হজরত ওসমান (রা.) : আপনার সুখটা কী?
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) : আমার পাপ সমূহই আমার অসুখ।
হজরত ওসমান (রা.) : আপনার বাসনা কী?
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) : আমার পালনকর্তার রহমত কামনা করি।
হজরত ওসমান (রা.) : আমি আপনার জন্যে কেন চিকিৎসক ডাকব কী?
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) : চিকিৎসকই আমাকে রোগাক্রান্ত করেছেন।
হজরত ওসমান (রা.) : আমি আপনার জন্য সরকারি বায়তুল মাল থেকে কোন উপটৌকন পাঠিয়ে দেব কী?
হজরত ইবনে মাসউদ : এর কোন প্রয়োজন নেই।
হজরত ওসমান (রা.) : উপটৌকন গ্রহণ করুন। তা আপনার পর আপনার কন্যাদের উপকারে আসবে।
হজরত ইবনে মাসউদ : আপনি চিন্তা করেছেন যে, আমার কন্যারা দারিদ্র ও উপবাসে পতিত হবে। কিন্তু আমি এরূপ চিন্তা করি না। কারণ আমি আমার কন্যাদেরকে জোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছি যে, তারা যেন প্রতি রাত্রে সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করে। আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-যে ব্যক্তি প্রতি রাত্রে সুরা ওয়াকিয়া পাঠ করে, সে কখনও উপবাস করবে না।
ইবনে কাছীর এ রেওয়ায়েত উদ্বুদ্ধ করার পর অন্যান্য সনদ ও কিতাব থেকেও এর সমর্থন পেশ করেছেন। (মা’আরিফুল কুরআন)
০৯. ধৈর্য ও ক্ষমার দৃষ্টান্ত
বনী উমাইয়ার রাজত্ব ও খিলাফত বিলুপ্তির পর যখন আব্বাসীয় খলীফা মনসুরের যুগ এল তখন কেউ তাকে জানাল, অমুক ব্যক্তির নিকট বনী উমাইয়ার প্রচুর মাল-সম্পদ গচ্ছিত আছে। খলীফা মনুসরের নির্দেশে সেই ব্যক্তিকে বন্দী করে রাজদরবারে হাজির করা হল। খলিফা মনুসর তাকে বললেন, আমি শুনেছি বনী উমাইয়ার অনেক আমানত এবং মাল-সম্পদ তোমার নিকটে গচ্ছিত রয়েছে। এ সমস্ত আমানত এবং মালসম্পদ আমার নিকট হাজির কর। উক্ত ব্যক্তি ছিল অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। সে অত্যন্ত নির্ভিক এবং স্বাভাবিকভাবে বলল,
বন্দি : হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি বনী উমাইয়ার উত্তরাধিকারী?
মনুসর : না।
বন্দি : আপনি বনী উমাইয়াদের অসীয়তকৃত ব্যক্তি না তত্ত্বাবধায়ক?
মনসুর : কিছুই না।
বন্দি : আপনি যখন তাদের অসীয়তকৃত ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক বা উত্তরাধিকারী কিছুই না হন তাহলে আপনার কী অধিকার রয়েছে যে, তাদের ধন-সম্পদের খোঁজ-খবর নিবেন?
মনসুর : (কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে চিন্তা ভাবনার পর বললেন) কথা হল, বনী উমাইয়াগণ জন সাধারণের উপর জুলুম-অত্যাচার করে অন্যায়ভাবে তাদের মাল-সম্পদ কুক্ষিগত করেছিল। এখন আমি তাদের প্রতিনিধি। তাই আমি চাচ্ছি জনসাধারণের কুক্ষিগত তাদের মাল-সম্পদ জালেমদের কব্জা থেকে ছিনিয়ে এনে সরকারি ট্রেজারিতে জমা করব।
বন্দি : আমীরুল মুমিনীন! আপনার এ ঘোষণা ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষণ না আপনি আপনার এ দাবির পক্ষে শরীয়ত সম্মত কোন স্বাক্ষী পেশ করবেন যে, বনী উমাইয়াদের যে মাল-সম্পদ আমার নিকট রক্ষিত আছ তা তাদের জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে সংগৃহিত। কারণ নিঃসন্দেহে বনী উমাইয়াদের নিকট এমন মাল-সম্পদও ছিল যার মধ্যে জুলুম-অত্যাচারের নামগন্ধও ছিল না।
মনসুর : (কিছুক্ষণ মাথা ঝুকিয়ে এবং চিন্তামগ্ন থেকে) উজির রবীকে লক্ষ্য করে বললেন, হে রবী! এ ব্যক্তির কথা ঠিক। এ সম্পদে আমাদের কোন অধিকার নেই। (এরপর হাস্যোজ্জ্বল ও প্রফুল্ল চিত্তে বন্দীকে বললেন) আপনার আরও কিছু বলার আছে কী?
বন্দি : জি হ্যাঁ! আমার দুটি কথা আছে। প্রথমত : শীঘ্রই আপনি আমার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দেন যেন তারা আমার নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দের কথা জেনে নিশ্চিন্ত হতে পারে। কারণ আমার অনুপস্থিতিতে আমার বাড়ির লোকের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রয়েছে। দ্বিতীয়ত : যে ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে আপনার কাছে অভিযোগ ও অপবাদ দিয়েছে তাকে ডেকে আনুন। আমি হলফ করে বলতে পারি আমার নিকট বনি উমাইয়াদের গচ্ছিত কোন সম্পদ নেই। তারপরও যেহেতু আপনার দরবারে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তখন আমার সেই উত্তরটি আমার মুক্তির ব্যাপারে দ্রুত কাজ করবে যা আমি আপনার দরবারে পেশ করেছি।
নসুর : (উজিরের প্রতি ইঙ্গিত করে) যে ব্যক্তি খবর দিয়েছিল তাকে ডাকুন। রবী উজির তাড়াতাড়ি সেই ব্যক্তিকে দরবারে উপস্থিত করলেন।
বন্দি : (আগন্তুক ব্যক্তিকে দেখে) আমীরুল মু’মিনীন! এ ব্যক্তি আমার গোলাম। সে আমার তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
মনসুর : (গোলামের প্রতি রাগত স্বরে) সত্যি করে বল, প্রকৃত ঘটনা কী?
গোলাম : (অসহায় ভাবে) জাহাপনা! ঘটনা তা-ই যা উনি বলেছেন। বাস্তবিকই আমি তার গোলাম। আর উনি যে পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রার কথা বলেছেন আমি তা নিয়েই পলায়ন করেছিলাম।
মনসুর : (বন্দীর প্রতি লক্ষ্য করে) আমি সুপারিশ করছি, গোলামকে আপনি ক্ষমা করে দিন।
বন্দি : আমীরুল মুমিনীন! আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা যা নিয়ে সে পলায়ন করেছিল তাও মাফ করে দিলাম। এখন আমার পক্ষ থেকে নগদ আরো তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রা তাকে দান করলাম।
মনসুর : (আশ্চর্যান্বিত হয়ে) এর চেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে?
ইহার পর থেকে আমীরুল মুমিনীন মনসুর সর্বদাই এ ব্যক্তির ক্ষমা করার ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করতেন যে, ইহা ক্ষমা ও দয়াদ্র হৃদয়ের একটি বেনজীব দৃষ্টান্ত। (কাশকুল)

১০. ইহুদীদের নিষ্ফল বিতর্ক
বিজ্ঞ তাত্ত্বিক, তার্কিক ও গবেষক পণ্ডিত মদিনা মুনাওয়ারায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে উপস্থিত হলেন। ইহুদী, নাছারা বস্তুবাদী, মানিবাদী ও মুর্তিপুজকদের প্রতি দলের পাঁচজন করে পঁচিশজন লোক ছিল।
তন্মধ্যে ইহুদীরা বলল, আমরা বিশ্বাস করি উয়াইর পয়গাম্বর আল্লাহর পুত্র। এ ব্যাপারে আপনার সাথ আমরা বিতর্ক করতে এসেছি। এ বিতর্কে যদি আমরা জিতে যাই তাহলে আমরা ধরে নিব যে, আপনিও আমাদের আক্বীদা বিশ্বাস পোষণ করেন আর আমরা যে, আপনার চেয়ে অগ্রবর্তী ও হকদার তা প্রমাণিত হবে। তখন যদি আপনি আমাদের সাথে একমত না হন তাহলে আমরা আপনার সাথ বিরোধিতা ও শত্র“তা করতে বাধ্য হব।
ইহুদীদের সাথে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচনা শুরু করলেন।
নবী করিম (সা.) : আপনারা কী চান আমি কোন প্রকার যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই আপনাদের কথা মেনে নেই?
ইহুদী দল : না।
নবী করীম (সা.) : উযাইর যে আল্লাহর পুত্র এ ব্যাপারে আপনাদের যুক্তি প্রমাণ কী?
ইহুদী দল : তাওরাত কিতাব সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল এবং একে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষমতা কারো ছিল না। উযাইরই একে পুনরুজ্জীবিত করেন। এ কারণেই তাকে আমরা আল্লাহর পুত্র বলে থাকি।
নবী করিম (সা.) : এ যুক্তি বলে যদি উযাইর আল্লাহর সন্তান হয়ে থাকেন, তাহলে হজরত মুসা (আ.) যিনি তাওরাতন এনেছিলেন এবং অনেক মুজেযারও অধিকারী, যাঁর কথা আপনারাও মানেন, তার তো আল্লাহর পুত্র হওয়ার যোগ্যতা অনেক বেশি। সুতরাং হজরত মুসা (আ.) যেখানে আরো অনেক উচ্চ মর্যাদার অধিকারী তাকে কেন ওরকম (আল্লাহর পুত্র) বলছেন না?
এ ছাড়া পুত্র হওয়ার অর্থ বুঝাতে কী আপনারা এ কতা বলছেন যে, তিনি অন্যান্য পিতা-পুত্রের মত বৈবাহিক ও দাম্পত্য সম্পর্কে মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিলেন? যদি আপনারা আল্লাহকে বস্তুগত, শরীরী ও জাগতিক সৃষ্টির মতই মনে করে থাকেন তাহলে তো এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আপনারা আল্লাহকে সৃষ্ট ও আরেক স্রষ্টার মুখাপেক্ষী বলে মনে করছেন?
ইহুদী দল : উযাইরকে পুত্র বলতে এবং জন্মগ্রহণ সম্পর্কে আমরা ওরকম মনে করি না। কারণ, আপনি যেমন বলছেন, এ ধরনের অর্থ করা হলে তা কুফুরি ও অজ্ঞতার শামিল হবে বরং আমাদের কথার তাৎপর্য হচ্ছে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন। যেমন আমাদের কোন কোন আলেম তাদের সেরা মেধাবী ছাত্রদের কাউকে অন্যদের সামনে তুলে ধরার জন্য এ কথা বলে সম্বোধন করেন যে, ‘হে পুত্র আমার’ কিংবা সে আমার পুত্র’। বুঝাই যাচ্ছে যে, এ ধরনের পুত্র বলতে দাম্পত্য সম্পর্কের ফলশ্র“তি নয়। কেননা, ছাত্র অন্যের সন্তান, শিক্ষকের সাথে তার পৈতৃক সম্পর্ক নেই। ঠিক, এরকম-ই মহান আল্লাহ পাক বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের জন্যে উযাইরকে ‘স্বীয় পুত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। আমরাও এই অর্থেই তাকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে থাকি।
নবী করীম (সা.) : আপনাদের এ কথার জবাব আগেই দিয়ে দিয়েছি এ বলে যে, এ ধরনের যুক্তির কারণে যদি আমরা উযাইরকে আল্লাহর পুত্র বলে জানি তাহলে উযাইরের চেয়ে বড়ো নবী তথা হজরত মুসা (আ.) ও আল্লাহর পুত্র বলে অভিহিত হবেন।
মহান আল্লাহপাক কখনো কখনো মানুষকে তাদের যুক্তি ও স্বীকারোক্তির বলে দোষী সাব্যস্ত করে থাকেন। আপনাদের স্বীকারোক্তি ও যুক্তি বলছে যে, হজরত মুসা (আ.) কে উযাইরের ব্যাপারে যা বলেন তার চেয়েও বেশি কিছু বলে থাকেন। আপনারা উপমা দিয়েছেন ও নমুনা হিসেবে বলেছেন যে, কোন শ্কিষক তার সাথে রক্ত সম্পর্কের বাইরের কোন ছাত্রকে সম্মান দেখানোর জন্যে বলে থাকেন। হে আমার পুত্র’ বা সে আমার সন্তান। যুক্তি যদি এটাই হয়ে থাকে তাহলে আপনারা এ কথাও নিশ্চয়ই জেনে নেবেন যে, ওই শিক্ষক আরো প্রিয়তম কোন ছাত্রকে বলবেন, সে আমার ভাই এবং আরো বেশি প্রিয়তম কাউকে বলবেন, সে আমার শিক্ষক বা শেখ কিংবা যে আমার পিতা বা প্রভু।
এ সমস্ত বাক্য সম্মানসূচক ও মর্যাদাময়। যার সম্মান যতবেশি তাকে আরো উচ্চ বাক্য ও পরিভাষায় সম্বোধন করতে হবে। তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই উচিত মনে করবেন যে, ‘মুসা (আ.) আল্লাহর ভাই কিংবা শিক্ষক বা প্রভু অথবা পিতা। কেননা হজরত মুসা (আ.) এর মান-মর্যাদা উযাইরের চেয়ে বেশি ও উর্ধ্বে।
এখন আমার জিজ্ঞাসা, আপনারা কী এটা জায়েজ মনে করেন যে, হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর ভাই বা পিতা, চাচা কিংবা শিক্ষক অথবা প্রভু এবং আল্লাহ সম্মানের নিদর্শন হিসেবে হজরত মুসা (আ.) বলবেন, হে পিতা!, হে শিক্ষক!, হে চাচা, হে প্রভু। এবং…’
ইহুদীরা কী জবাব দিবেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারা বিস্মিত-হতবাক হয়ে জানালেন, আপনি আমাদের এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দিন।
নবী করিম (সা.) : নিশ্চয়ই। যদি আপনারা পবিত্র, খাঁটি ও ইনসাফপূর্ণ অন্তরে চিন্তা-ভাবনা করেন তাহলে মহান আল্লাহ পাক আপনাদের সত্যপথে দিকে নির্দেশ দিবেন।’
নাস্তিকের যুক্তি খণ্ডন, সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, ২৭ জুন, ১৯৯৯ ইংরেজি।
১১. প্লেটোর মুখ থেকে মহাসত্যের ঘোষণা
বর্ণিত আছে যে, যখন মহান আল্লাহপাক হজরত মুসা (আ.) কে নবী হিসেবে প্রেরণ করলেন তখন তাঁর সম্পর্কে কেউ আফলাতুন প্লেটো মহাদার্শনিকে বলল, হে মহা বৈজ্ঞানিক! আপনার শিষ্য হজরত মুসা (আ.) যাবতীয় উপকরণের স্রষ্টার সাথে কথোপকথন করেন। হজরত মুসা (আ.) কে ডাকলেন।
প্লেটো : হে বৎস! তুমি কি স্রষ্টার সাথে কথোপকথন কর?
মুসা (আ.) : হ্যাঁ।
প্লেটো : তুমি এ খতা কোন্ প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে বল?
মুসা (আ.) : মহৎ সৌভাগ্যই আমার প্রমাণ ও যুক্তি।
প্লেটো : তুমি কোন্ দিক থেকে আওয়াজ শ্রবণ কর?
মুসা (আ.) : চতুর্দিক থেকে?
প্লেটো : প্রত্যেক নবীর কাজে মুজেযা বা অলৌকিক ঘটনা থাকে। তোমার কাছে কী আছে?
মুসা (আ.) : অবশ্যই আমার কাছে ও তা আছে। এ বলে স্বীয় লাঠিখানা মাটিতে ফেলে দিলেন। তৎক্ষণাৎ তা অজগর সাপে পরিণত হয়ে গেল।
জনৈক নাস্তিক : সরন্দীপ নামক দ্বীপে একপ্রকার খড়িপয়দা হয়, যখন উহা এ দেশে আনা হয় তা সাপ হয়ে যায়।
মুসা (আ.) : তুমি ওই খড়ি নিয়ে এস। যদি তোমর কথা সত্য হয় তাহলে তা তোমার হাতেও সাপ হয়ে যাবে। আর যদি না হয় তাহলে তুমি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হবে। এ কতা শুনে উক্ত নাস্তিক কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে গেল।
অতঃপর প্লেটো জন সমক্ষে ঘোষণা করলেন যে, এ ব্যক্তি নবী। তোমরা তাঁর অনুসরণ কর। অন্যথায় তোমরা বিপদে পড়বে। কেননা এ ব্যক্তি মহৎ সৌভাগ্য ও অলৌকিক ঘটনাবলী মহান আল্লাহ পাক হতে সংগ্রহ করেছেন। (বাদশাহ হতে চান না আল্লাহর ওলী?) মূল : ইমাম গায্যালী (রহ.)
১২. ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) ও জাহাম ইবনে সাফওয়ান
ইমাম আজম আবু হানিফা রহ. ও জাহাম ইবনে সাফাওয়ানের মধ্যে যে বাক-যুক্ত হয়েছিল, তাতে ঈমান সম্পর্কে ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এর অভিমত প্রতিফলিত হয়েছে এবং এতে তিনি বিস্তারিত দলীল-প্রমাণও উপস্থাপন করেছেন।
একবার জাহাম ইবনে সাফওয়ান কথাবার্তা বলার উদ্দেশ্যে ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) এর খেদমতে হাজির হলে সাক্ষাতের সময় জাহাম বলল, কতেক মাসয়ালার বিষয়ে আপনার সাথে দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদানের জন্য আমি এসেছি।
ইমাম আজম : তোমার সাথে কথা বলা লজ্জার ব্যাপার এবং তোমরা যে সব বিষয়ে আত্মনিয়োগ করেছো, তাতে অংশ গ্রহণ আগুনে প্রবেশ সদৃশ্য।
জাহাম : আপনার সাথে আমার সাক্ষাৎ এবং কোনরূপ আলাপ-আলোচনা ব্যতিতই এই অভিমত ব্যক্ত করলেন?
ইমাম আজম : তোমাদের যে সব অভিমত ও অভিব্যক্তি আমার পর্যন্ত পৌঁছেছে, তা কোন মুসলমানের অভিমত হতে পারে না।
জাহাম : আপনি না জেনে শুনে আমার ব্যাপারে ফয়সালা দিচ্ছেন?
ইমাম আজম : তোমাদের ব্যাপারে এসব অভিমত সুপ্রসিদ্ধ। সাধারণ-অসাধারণ সকল মানুষই তা জানে। সুতরাং আমি সম্পূর্ণ আস্থার সাথেই তোমার বিরুদ্ধে যা বলার বলছি।
জাহাম : আমি আপনাকে শুধু ঈমানের স্বরূপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছি।
ইমাম আজম : তুমি এখনও ঈমানের স্বরূপ জানতে পারনি যে, প্রশ্নের প্রয়োজন পড়ল?
জাহাম : কেন নয়? অবশ্য ঈমানের একটা দিকের ব্যাপারে আমার সন্দেহ হচ্ছে, তা দূরীভুত করতে চাই।
ইমাম আজম : ঈমানের মাঝে সন্দেহ করা কুফুরী।
জাহাম : আপনার জন্য মোটেই সমীচিন হবে না যে, আপনি আমার কুফুরীর কারন অবহিত করবেন না।
ইমাম আজম : বল, কী জিজ্ঞেস করতে চাও?
জাহাম : বেশ বলুন তো, এক ব্যক্তি তার অন্তর দ্বারা মহান আল্লাহ পাককে চিনল এবং জানল যে, তিনি এক, একক, তাঁর সমতূল্য ও সমকক্ষ কেউ নেই, তাঁর গুণাবলী ও সে অবগত। কোন বস্তু তাঁর সদৃশ্য নেই। একথা সে ব্যক্তিও মানে কিন্তু এসব মুখে স্বীকার ব্যতিতই সে মরে গেল। এ ব্যক্তির মৃত্যু কী কুফুরীর হল অথবা ইসলামের উপর?
ইমাম আজম : এ ব্যক্তি কাফির, সুতরাং জাহান্নামী। যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তরের উপলব্ধির সাথে মুখের স্বীকৃতি সমন্বয় না হবে।
জাহাম : কেমন করে মুমিন নয়; যখন সে মহান আল্লাহ পাককে তাঁর গুণাবলী সহ উপলব্ধি করল।
ইমাম আজম : যদি তুমি পবিত্র কুরআনে বিশ্বাসী হও এবং ইসলামী শরীয়তের ইজ্জতে বলে গ্রহণ করো, তবে আমি পবিত্র কুরআনের দলীল পেশ করব। আর যদি এমনকি না হয়, তবে আমি তোমার সাথে সে পরিমাণেই কথা বলব, যেভাবে ইসলাম বিরোধীদের সাথে হয়ে থাকে।
জাহাম : আমি কুরআনের উপর বিশ্বাসী এবং একে হুজুত বলে বিশ্বাস করি।
ইমাম আজম : মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ঈমানের সম্পর্ক দুটি অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত করেছেন। একটি হল হৃদয়-মন, দ্বিতীয়টি হল ভাষা ও উচ্চারণ। সুতরাং ইরশাদ হচ্ছে-“রাসুলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা যখন তারা শ্রবণ করে তখন তারা সত্য উপলব্ধি করে তার জন্যে তাদের চক্ষু অশ্র“ বিগতিল দেখবে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা বিশ্বাস করছি। সুতরাং তুমি আমাদেরকে সাক্ষ্যবহদের তালিকাভূক্ত কর। আল্লাহর পক্ষ হতে আমাদের নিকট আগত সত্য আমরা বিশ্বাস স্থাপন না করার কী কারণ থাকতে পারে যখন আমরা প্রত্যাশা করি যে, আল্লাহ আমাদেরকে সৎকর্ম পরায়নদের অন্তর্ভুক্ত করুন এবং তাদের এই কথার জন্য আল্লাহ তাদের পুরষ্কার নির্দিষ্ট করেছেন জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। তারা সেখানে স্থায়ী হবে। এই হল সৎকর্মপরায়ণদের পুরষ্কার।” (সুরা মায়িদা : ৮৩-৮৫)
ইমা আ’যম (রহ.) বললেন, এ আয়াতে মহান আল্লাহ পাককে উপলব্ধি বা জানা এবং স্বীকৃতিকে জান্নাতি হওয়ার কারণ বলেছেন এবং হৃদয় ও মুখের উচ্চারণ বা স্বীকৃতিকে মু’মিন হওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন।
মহান আল্লাহ পাক আরও ইরশাদ করেন-‘তোমরা বল, আমরা আল্লাহতে ঈমান রাখি এবং ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে মুসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণকারী। তোমরা যাতে ঈমান এনেছ, তারা যদি সেরূপ ঈমান আনে, তবে নিশ্চয়ই তারা সৎপথ পাবে। (সুরা বাকারা : ১৩৬-৩৭)
আরও ইরশাদ করেন-‘আর তাদেরকে তিনি তাক্বওয়ার বাক্যে সুদৃঢ় করলেন। (সুরা কাত্তাহ : ২৬)
আরও ইরশাদ করেন-‘তাদেরকে পবিত্র বাক্যের অনুগামী করা হয়েছিল। (সুরা হাজ্জ : ২৪)
আরও ইরশাদ ফরমান-তাঁরই দিকে পবিত্র বাণী সমূহ আরোহন করে। (সুরা ফাতির : ১০)
আরও এরশাদ ফরমান-‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী, তাদেরকে ইহজীবন ও পরজীবনে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন। (সুরা ইবরাহীম : ২৭)
এখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী শুন :
লা-ইলামা ইল্লাল্লাহু বল, সফলকাম হবে।
এ হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, কামিয়াবী ও সফলতা উপলব্ধি ও জানার মধ্যে নয় বরং এতে বলা বা স্বীকৃতিও সম্পৃক্ত রয়েছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ ফরমান-‘যে ব্যক্তি মুখে ….. বলল, এবং সে ব্যক্তি হৃদয়েও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে, তবে সে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। এখানে তিনি বলেননি যে, যে ব্যক্তি অন্তরে আল্লাহর পরিচিতি উপলব্ধি করল, তাকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে বলেছেন, যে ব্যক্তি মুখে কালিমা ………… বলবে।
যদি হৃদয়ের উপলব্ধি যথেষ্ট হতো এবং মুখে স্বীকৃতির কোনো প্রয়োজন না হতো, তবে মুখে আল্লাহর অস্বীকৃতি ও অস্বীকারকারী ও আল্লাহর পরিচিত উপলব্ধি করে বা জেনে মু’মিন হয়ে যেত। এমতাবস্থায় ইবলিস শয়তানেরও মু’মিন হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। কেননা মহান আল্লাহ পাকের পরিচিতি ও উপলব্ধি তার মধ্যে ছিল। সে সম্যক অবগত ছিল মহান আল্লাহ পাক তার সৃষ্টিকর্তা, জীবন দানকারী এবং তাকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতকারী। যেমন ইবলি বলেছিল : ‘হেম আমার পরওয়ারদেগার! আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন। (সুরা হিজর : ৩৯)
তারপর বলেছিল : এবং আমাকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। (সুরা হিজর : ৩৬)
আরও বলেছিল, আপনি আমাকে অগ্নি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে মাটি হতে। (সুরা দাদ : ৭৬)
যদি শুধু মহান আল্লাহ পাকের পরিচিতি জানা ও উপলব্ধিই ঈমান হত, তবে কাফির সম্প্রদায়ের পরিচিতি জানার পরও মুখে অস্বীকৃতি সত্ত্বেও তারা মু’মিন হত। অথচ মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন-‘বিশ্বাস করা সত্ত্বেও তারা অস্বীকার করেছিল। (সুরা নামল : ১৪)
এ আয়াতে মহান আল্লাহ পাকের একত্ববাদে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও তাদেরকে মু’মিন বলা হল না। কেননা তারা মুখে অস্বীকার করেছিল।
মহান আল্লাহ পাক আরও এরশাদ ফরমান-‘তারা মহান আল্লাহ পাকের নিয়মতরাজী সম্পর্কে জেনেও অস্বীকার করেছিল। আর তাদের অধিকাংশ মোটেই মানত না।’ (সুরা নাহল : ৮৩)
মহান আল্লাহপাক আরও এরশাদ ফরমান-‘বল! কে তোমাদেরকে আকাশ ও পৃথিবী হতে জীবিকা সরবরাহ করেন অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন, কে জীবিতকে মৃত হতে নির্গত করেন এবং কে মৃতকে জীবিত হতে নির্গত করেন এবং কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রিত করেন? তখন তারা বলবে, আল্লাহ। বল! তবুও কী তোমরা সাবধান হবে না? তিনিই আল্লাহ তোমাদের সত্য প্রতিপালক। (সুরা ইউনুস : ৩১-৩২)
উপর্যুক্ত আয়াত সমূহের মর্মবাণীর উপর চিন্তা করলে স্পষ্ট বুঝা যাবে যে, চিন্তার ও উপলব্ধি থাকা সত্ত্বেও তাদের ‘জানাটা’ কী অকাট্যভাবে নিষ্ফল ও বেকার?
মহান আল্লাহপাক এরশাদ করেন-‘তারা আপনাকে এমনভাবে চিনে যেমনি তাদের সন্তানদের চিনে। (সুরা বাকারা : ১৪৬)
এ আয়াত দ্বারাও জানা যাচ্ছে, অস্বীকারকারীদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জেনে নেওয়াই যথেষ্ঠ ছিল না, যখন তারা নবুয়ত ও সিরালাতকে মানছিল না এবং তারা এ বাস্তবতাকে গোপন করে রেখেছিল এবং অস্বীকার করে যাচ্ছিল।
যখন ইমাম আজম আবু হানীফা (রহ.) এসব দলীল প্রমাণ উপস্থাপন করলেন তখন জাহাম বলল, আপনি আমার হৃদয়ের রাজ্যকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। পূণরায় আমি আপনার সান্নিধ্যে হাজির হব। কিন্তু জাহাম আর ফিরে এল না। (আলমানাকিব লিলহক্কী ১ম খণ্ড পৃ: ১৪৫-৪৮)
১২. দাহ্হাক লা-জবাব হয়ে গেল
দাহ্হাক ইবনে কায়িস খারিজী, যে ব্যক্তি উমাইয়া ফেলাফতে বিদ্রোহ করেছিল। একদা সে কুফার মসজিদে এল এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর দু’হুকুম সাব্যস্তের ব্যাপারে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে গেল।
দাহ্হাক : হে ইমাম আজম! আপনি তওবা করুন।
ইমাম আজম (রহ.) : কোন্ গুণাহ থেকে তওবা করব?
দাহ্হাক : ‘দু’ হুজুম সাব্যস্ত থেকে।
ইমাম আজম (রহ.) : তুমি কি আমার সাথ বিতর্ক করবে অথবা আমাকে হত্যা করবে?
দাহ্হাক : বিতর্ক করব।
ইমাম আজম (রহ.) : যদি আমরা পরস্পর মত বিরোধে পড়ি তবে আমাদের মধ্যে কে তৃতীয় ব্যক্তি হবে?
দাহ্হাক : যাকে ইচ্ছে, তৃতীয় ব্যক্তি বানিয়ে নেন।
ইমাম আজম (রহ.) : (দাহ্হাকের একজন সাথীকে লক্ষ্য করে বললেন) আপনি এখানে আসুন এবং আমাদের মধ্যে মতবিরোধ অবস্থায় মিমাংসা করবেন। তারপর ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) দাহ্হাককে বললেন, এ অবস্থা কী তুমি পছন্দ করলে?
দাহ্হাক : হ্যাঁ।
ইমাম আজম (রহ.) : দু’ হুকুম সাব্যস্তকে তুমি নিজেই ফয়সালা করে দিলে।
দাহ্হাক : লা জবাব হয়ে চুপ হয়ে গেল। (ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.)
১৩. কাযী ইবনে শুবরুমা অসীয়ত মেনে নিলেন
এক ব্যক্তি মৃত্যুর সময় ইমাম আজম আবু হানীফা (রহ.) সম্পর্কে তাঁর অনুপস্থিতিতে অসিয়ত করলেন। কাজী ইবনে শুবরুমার আদালতে এ বিষয়টি উত্থাপিত হল। ইমাম আজম আবু হানীফা (রহ.) স্বাক্ষী পেশ করলেন যে, অমুক ব্যক্তি মৃত্যুর সময় আমার অনুকুলে অসীয়ত করেছেন।
কাজী ইবনে শুবরুমা : আবু হানীফা! আপনি কী শপথ করবেন যে, আপনার স্বাক্ষী সত্য বলছে?
ইমাম আজম (রহ.) : আমার উপর কসম আপতিত হচ্ছে না। কেননা আমি সে সময় উপস্থিত ছিলাম না।
কাজী ইবনে শুবরুমা : আপনার অনুমান কাজে আসবে না।
ইমাম আজম (রহ.) : ঠিক আছে, বলুন তো, কো অন্ধ ব্যক্তির মাথা কেউ ফাটিয়ে দিল এবং এ ব্যাপারে দু’জন স্বাক্ষী স্বাক্ষ্য প্রদান করল। তবে কী অন্ধ লোকটি শপথ করে বলবে যে, এদের স্বাক্ষ্য প্রদান সত্য? অথচ সে তো দেখেনি।
ইবনে শুবরুমা কোন জবাব দিতে না পেরে অসীয়ত মেনে নিলেন। (ইমাম আজম আবু হানীফা (রহ.)
১৪. হজরত কাসাঈ (রহ.)-এর বিচক্ষণতা
একদা মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বাণী (রহ.) স্বীয় খালাতো ভাই হজরত কাসাঈ নাহুবিদকে জিজ্ঞেস করলেন-
মুহাম্মদ : আপনি কেন ইলমে ফিক্হ বিষয়ে মনোযোগী হন না?
কাসাঈ : ইলমে নাহু সবচেয়ে মজবুত ইলিম। সুতরাং ইলমে নাহু সব ইলিমের প্রতি রাস্তা দেখায়। তাই আমি ইলমে ফিক্হ এর প্রতি মনোযোগী না হয়ে ইলমে নাহু এর প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছি।
মুহাম্মদ : আমি আপনাকে একটি মাসয়ালা জিজ্ঞেস করব। আপনি তা ইলমে নাহুর এর মাধ্যমে জবাব দিবেন।
কাসাঈ : জিজ্ঞেস করুন।
মুহাম্মদ : যে ব্যক্তি নামাজে সেজদা… ভুলে যায় তার হুকুম কী?
কাসাঈ : (কিছুক্ষণ চিন্তা করে) তার জন্যে কোন সেজদা নেই।
মুহাম্মদ : নাহু শাস্ত্রের কোন অধ্যায় থেকে মাসয়ালাটির ফয়সালা দিলেন?
কাসাঈ : নাহু শাস্ত্রের একটি উসুল হচ্ছে-যে শব্দকে তাসগীর করা হয়েছে, তা দ্বিতীয়বার তাসগীরে করা হয় না। সুতরাং সেজদা সাহু নামাজে ভুলে গেল দ্বিতীয়বার সেজদা সাহু দেওয়ার বিধান নেই।
হজরত ইমাম কাসাঈ (রহ.)-এর প্রজ্ঞাপূর্ণ জবাব শুনে মুহম্মদ ইবনে হাসান শায়বানী (রহ.) বিমোহিত হয়ে গেলেন। (বাহরুবরায়েক শরহে কানযুয দাক্কায়েক্ক)
১৫. ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও জনৈক ব্যক্তি
একদা জনৈক ব্যক্তি সায়্যিদুনা হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা (রহ.) কে নিম্নোক্ত বিষয়ে বিজ্ঞেস করল।
জনৈক ব্যক্তি : ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের পথে কোন্ জিনিস সবচেয়ে সাহায্যকারী?
ইমাম আজম (রহ.) : একাকীত্ব গ্রহণ করা।
জনৈক ব্যক্তি : একাকীত্ব কীভাবে গ্রহণ করা যায়?
ইমাম আজম (রহ.) : সম্পর্কিত এবং সম্পর্কিত নয় এমন বিষয় থেকে যথাসাধ্য কম সম্পর্ক রাখা।
জনৈক ব্যক্তি : কীভাবে কম সম্পর্ক রাখা যায়?
ইমাম আজম (রহ.) : যে জিনিসের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু গ্রহণ করা, অতিরিক্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। (মলফুযাতে ইমাম আবু হানিফা (রহ.))
১৬. এক বেদুইনের প্রশ্নের উত্তর
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের আনুমানিক দশদিন পর এক বেদুইন মসজিদে নববীতে এসে উপস্থিত হল। উক্ত বেদুইন নবী করীম ……. এর ইন্তেকালের উপর আফসোস করে বলল, নবী করীম …. এর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি কে? হজরত আবু বকর (রা.) হজরত আলী (রা.) এর দিকে ইশারা করে বললেন, ইনিই নবী করীম (সা.) এর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। বেদুইন হজরত আলী (রা.)-এর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে তাঁকে সালাম দিল। হজরত আলী (রা.) বেদুইনের সালামের জবাব দান পূর্বক তার নাম ধরে ডাক দিলেন। বেদুইন যখন তার নাম হজরত আলী (রা.) এর মুখে শুনতে পেল তখন সে হয়রান হয়ে গেল। সে আলী (রা.) কে সম্বোধন করে বলল, আপনি কীভাবে আমার নাম সম্পর্কে অবগত হলেন? হজরত আলী (রা.) বললেন, আমাকে নবী করীম (সা.) তোমার নাম এবং তোমার অবস্থা সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। নবী করীম (সা.) তোমা রনাম ‘মদর’ বলেছেন। তুমি আরবদের সাথে সম্পর্ক রাখ। তুমি স্বীয় গোত্রকে নবী করীম (সা.)-এর আগমনের সংবাদ দিয়েছে যে, তেহামায় এমন ব্যক্তি আবির্ভূত হবেন যার চেহারা মুবারক চন্দ্র হতে উজ্জ্বল হবে। তাঁর কথাবার্তা মধু থেকে মিষ্ট হবে। তিনি খচ্ছরের উপর সওয়াব হবেন। নিজেই নিজের কাপড় এবং জুতা পরিধান করবেন। ব্যভিচার, মদপান এবং অন্যায় হত্যাকে হারাম ঘোষণা দিবেন। তিনি সর্বশেষ নবী হবেন। তিনি রামাদ্বান মাসে রোজা রাখবেন। বাইতুল্লাহ শরীফের হজ্জ করবেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন। হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তাঁর উপর ঈমান আন এবং তাঁকে সত্য বলে জান। অতঃপর তোমার এ সমস্ত বক্তব্য শুনে তোমার সম্প্রদায় তোমাকে জেলখানায় প্রবেশ করাবে। যখন নবী করীম (সা.) এর ইন্তেকাল হয়ে গেল তখন তোমার সম্প্রদায় বন্যার পানিতে ডুবে গেল। আর তুমি জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসলে। অতঃপর তোমার কানে অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসল হে মদর! নবী করীম (সা.) এর ইন্তেকাল হয়ে গেছে। সুতরাং তুমি তাঁর সাহাবায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে মদীনা শরীফ গমন কর এবং নবী করীম (সা.) এর জিয়ারত কর।
যখন বেদুইন ব্যক্তি হজরত আলী (রা.)-এর জবান মুবারক থেকে উপর্যুক্ত বক্তব্য শুনল তখন তার দুচোখ বেয়ে অশ্র“ প্রবাহিত হতে লাগল। সে সামনে অগ্রসর হয়ে হজরত আলী (রা.)-এর হাত মুবারকে চুম্বন দিয়ে আরজ করল আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। হজরত আলী (রা.) বললেন, ঠিক আছে, তুমি আমাকে প্রশ্ন কর। ইনশাআল্লাহ আমি তোমার প্রশ্ন গুলোর সঠিক জবাব দেওয়ার চেষ্টা করব।
বেদুইন : এ কেন পুরুষ যার পিতা-মাতা নেই?
হজরত আলী (রা.) : হজরত আদম (আ.)।
বেদুইন : এ কোন্ মহিলা যিনি পিতা-মাতা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছেন?
হজরত আলী (রা.) : হজরত হাওয়া (আ.)।
বেদুইন : এ কোন্ পুরুষ যিনি পিতা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছেন?
হজরত আলী (রা.) : হজরত ঈসা (আ.)।
বেদুইন : এ কোন্ কবর যে কবরটি তার অধিবাসীকে নিয়ে ভ্রমণ করেছিল?
হজরত আলী (রা.) : এ মাছ যে মাছটি তার পেটের মধ্যে তার অধিবাসী হজরত ইউনুস (আ.) কে নিয়ে তিনদিন এদিক-সেদিক ভ্রমণ করেছিল।
বেদুইন : এ কোন্ জিনিস যেটি একবার খেয়েছিল, দ্বিতীয়বার খায়নি?
হজরত আলী (রা.) : ইহা হজরত মুসা (আ.) এর লাঠি যা সাপ হয়ে ফেরআউনের সমস্ত যাদুকরদের যাদুকে খেয়ে ফেলেছিল।
বেদুইন : পৃথিবীর কোন্ স্থানটি যাতে সূর্যের আলো একবার পড়েছিল?
হজরত আলী (রা.) : ইহা হচ্ছে নীলনদের ওই স্থানটি যা হজরত মুসা (আ.) এর লাঠির আঘাতে প্রকাশ হয়েছিল।
বেদুইন : এ কোন্ পাথর যা থেকে প্রাণী বের হয়েছিল?
হজরত আলী (রা.) : ইহা ওই পাথর যা থেকে হজরত সালেহ (আ.)-এর উটনি বের হয়েছিল।
বেদুইন : উনি কোন্ মহিলা যিনি তিন ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চা প্রসব করেছিলেন?
হজরত আলী (রা.) : হজরত মারইয়াম (আ.)
বেদুইন : কোন্ দু’বন্ধু যারা পরস্পর কখনও শত্র“ হয় না?
হজরত আলী (রা.) : শরীর ও প্রাণ।
বেদুইন : কোন্ দু’ শত্র“ যারা পরস্পর কখনও বন্ধু হয় না?
হজরত আলী (রা.) : জীবন ও মৃত্যু।
বেদুইন : জিনিস কী এবং জিনিস নয় কী?
হজরত আলী (রা.) : জিনিস মুমিন এবং জিনিস নয় কাফির।
বেদুইন : মাতৃগর্ভে প্রথম কোন্ অঙ্গটি তৈরি হয়?
হজরত আলী (রা.) : শাহাদত আঙ্গুলী।
বেদুইন : কবরের মধ্যে সর্ব প্রথম কোন্ অঙ্গটি মাটিতে পরিণত হয়?
হজরত আলী (রা.) : মাথার হাড্ডি।
হজরত আলী (রা.) বেদুইনের কত প্রশ্নগুলোর যথাযথ জবাব প্রদান করলেন, এতে বেদুইন ব্যক্তি বিমোহিত হয়ে হজরত আলী (রা.) কে চুম্বন করতে লাগল।
খোদাভীতির উজ্জ্বল নমুনা

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *