বিজ্ঞানের সমন্বয়ে মিরাজের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী- সরওয়ারে কায়েনাত, ইমামুল মুরসালীন, রহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অগণিত মোযেজার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একটি মুযেজা হচ্ছে মিরাজ। তাঁর ৫২ বছর বয়সে, নবুয়াতের ১২ তম বর্ষে, রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতের কিছু অংশে এই ভ্রমণ তিনি সম্পন্ন করেন।
প্রিয় নবী স. এর এই রাতের ভ্রমণের রয়েছে দুটি স্তর । একটি হচ্ছে ইসরা, যা হাতীমে কাবা থেকে বাইতুল মাকদাস পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে সেখান থেকে ঊর্ধ্বাকাশে মিরাজ। সরাসরি আকাশে না উঠিয়ে আল্লাহ তাকে কেন বাইতুল মাকদাসে ইসরা করালেন? এর কারণ আমরা বুঝতে পারি তখন, যখন দেখি মক্কার কাফির নেতৃবৃন্দ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কাবার সামনে জসসমক্ষে বাইতুল মাকদাস সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছিল। এবং নবী স. যে এক মাসের দূরত্বের সেই বাইতুল মাকদাসে ঠিকই ভ্রমণ করেছেন, তা কাফিররা যাচাই করতে পারল। এ অংশের ভ্রমণ ছিল কাফিরদের জ্ঞানসীমার মধ্যে। সরাসরি আসমানে ভ্রমণ করে আসলে কাফিরদের জ্ঞানে তা যাচাই করতে পারতো না। তাই আল্লাহ পাক সুরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াতে ইসরা এর উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয় অংশের ভ্রমণে প্রিয় নবী স. বাইতুল মাকদাস হতে জিবরাইল আ. এর সাথে পুনরায় বোরাকে চড়ে সেখান থেকে সাত আসমান তথা সিদরাতুল মুন্তাহা পাড়ি দিয়ে মহান আল্লাহর ডাকে হাজির হন। ‘ফাকাবা কাওছাইনে আও আদনা’ এর মাকামে তিনি আল্লাহ পাকের খাছ সান্নিধ্য লাভ করে বেহেশত, দোযখ, আরশ, কুরশি, লওহ, কলম প্রভৃতি পরিদর্শন করে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য অবহিত হয়ে আবার রাতের মধ্যেই পৃথিবীতে ফিরে আসেন। যার বিস্তারিত বিবরণ স্পষ্টভাবে তিনি নিজে দিয়েছেন এবং আলকুরআনের প্রায় একশ’ আয়াতে পরোক্ষভাবে বিবরণ দেয়া হয়েছে। শত শত হাদীসে মিরাজের বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ দেয়া হয়েছে। মিরাজ কেন হয়েছে? কি উপলক্ষ্যে হয়েছে? স্বপ্নযোগে নাকি সশরীরে হয়েছে? মহাশূন্য পাড়ি দেয়া কিভাবে মানুষের জন্য সম্ভব হল? এ সফরের ফলাফল বা সার্থকতা কী? মিরাজ থেকে পৃথিবীবাসীর শিক্ষণীয় কী? ইত্যাদি অগণিত প্রশ্ন হতে বিজ্ঞান শুধু একটি প্রশ্ন নিয়েই ব্যাখ্যা বা আলোচনা করতে প্রয়াসী। আর তা হল মহাশূন্য- মহাকাশ পাড়ি দেয়া, আবার পৃথিবীতে ফিরে মানুষের জন্য আসা সম্ভব কিনা?
যদি বলি পুরা ব্যাপারটাই সংঘটিত হয়েছে মহান আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতে। তাহলে ব্যাখ্যাটি হয়ে দাঁড়ায় ঈমানভিত্তিক, বিজ্ঞানভিত্তিক নয়। আর মুমিন মাত্রই মহান আল্লাহর কুদরত বিশ্বাস করেন। মহান আল্লাহ তো যা খুশি তা-ই করতে পারেন, ঘটাতে পারেন। তিনি ‘কুন ফাইয়াকুন’ এর মালিক। তার কাছে অসাধ্য কিছুই নেই। কিন্তু যিনি মুমেন নয়, তিনি তো বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু যৌক্তিকতা তালাশ করবেন। মহাকাশ নিয়ে একের পর এক অনেক প্রশ্ন করবেন। আর জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এর আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশিত হবার পর অনেক প্রশ্নের উত্তরই তারা পেয়ে গেছেন। বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করছে যে, সেকেন্ডে ৬.৯০ কিলোমিটার বেগে কোন ব¯ুÍকে মহাকাশে নিক্ষেপ করলে সে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অতিক্রম করে যেতে পারে।
মহাকাশের বিভিন্ন উল্কা ও তার আক্রমণ থেকে রেহাই পাবার জন্য যে বিশেষ ধরণের পোষাক বা বাহন দরকার, নবী স. কে বেহেশত থেকে সে ধরণের পোষাকই হয়তো সরবরাহ করা হয়েছিল। ভিন্ন জগতে ভ্রমণের জন্য যে পরিমাণ সাহস সঞ্চয় করা দরকার না হয় সে বেহুঁশ হয়ে পড়বে; সে জন্যই প্রিয় নবী স. এর বক্ষ বিদারণ করে রহমাত ও হিকমাত বোঝাই করে দেয়া হয়েছিল। মহাকাশ ভ্রমণে স্থির থাকার মত সাহস তার হৃৎপিণ্ডে বোঝাই করার পরেই তাকে বোরাক নামের বিজলী গতি সম্পন্ন বাহনে আরোহণ করানো হয়েছিল। বক্ষ ফেঁড়ে হৃৎপিণ্ড বাইরে এনে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করা বিজ্ঞানের এ আধুনিক যুগে প্রমাণিত ও সহজ ব্যাপার। সুতরাং মিরাজ সশরীরেই ঘটেছিল। যদি স্বপ্নযোগে হত, তাহলে বোরাক নামক বাহন আল্লাহ পাঠাতেন না। কারণ ঘুমন্ত দেহকে রেখে রূহ নিয়ে ভ্রমণ হল স্বপ্ন। রূহ নেয়ার জন্য বোরাক বা রফরফ কোন বাহন এর দরকার ছিল না। সুতরাং নিঃসন্দেহে মিরাজে তিনি সশরীরেই গিয়েছেন। তবে এ কথা সত্য যে, সশরীরে মিরাজ হয়েছে একবার আর স্বাপ্নিকভাবে মিরাজ হয়েছে ৩৩ বার।

সকল নবীর উপর মুহাম্মদ স. এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করার যে কয়টি পয়েন্ট আছে, তার মধ্যে মিরাজ অন্যতম। হযরত আদম আ. বেহেশত হতে সকল আসমান পাড়ি দিয়ে সশরীরে পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন। কিন্তু আর সশরীরে আকাশে আর উঠেননি। অপরদিকে হযরত ইদ্রিস আ. সশরীরে বেহেশতে উঠেছেন আকাশ থেকে আর নামেননি। আর একজন নবী হযরত ঈসা আ. আকাশে সশরীরে দ্বিতীয় আসমানে উঠেছেন আবার নামবেন। ঈসা আ. এর ওঠা নামাটা আংশিক। কিন্তু শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ স. একই সাথে সশরীরে আরশ পর্যন্ত উঠেছেন আবার নেমেছেন। তার মোযেজা সকল কালের, সকল মানুষের এবং সকল শক্তির উপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।
এর পরেও যদি প্রশ্ন ওঠে যে, নবী স. আল্লাহ পাকের সাক্ষাতে যাওয়া সম্ভব হল কি করে? কুরআনই তো আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে মূসা আ. কে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘লান তারানি’ তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। তবে এ আয়াতটির প্রতি একটু নজর করলেই আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ শুধু মূসা আ. কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন যে, তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। আমাকে কেউ দেখতে পারবে না, এমন কথা কিন্তু আল্লাহ তায়ালা বলেননি। বরং আমাদের সবাই আল্লাহকে দেখতে পারবো বলে হাদীসে প্রিয় নবী স. সু সংবাদ দিয়ে বলেছেন-
‘তোমরা তোমাদের রবকে দেখতে পাবে যেমন করে পূর্ণিমার রাতে চাঁদকে দেখতে পাও।’ সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ২৫৫৪। মিরাজের এই চতুর্মুখী তত্ত্ব, তথ্য ও ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি? বৈজ্ঞানিকগণ আজ এমন নক্ষত্রের সন্ধান পান, যার আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে ১০০ কোটি বছর। আর এসব তো প্রথম আসমানের ব্যাপার মাত্র। তাহলে সাত আসমানের উপর সিদরাতুল মুন্তাহা, আরশ, কুরশি, লৌহ, কলম এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আসবে কিভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর এর আগে আমাদের বুঝতে হবে মুযেজা কী ও বিজ্ঞান কী? মুযেজা শব্দের অর্থ হচ্ছে সকল শক্তি, সামর্থ্যকে অক্ষমকারী তথা পরাজিতকারী। যদি বিজ্ঞান পুরো মিরাজের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়, তাহলে সে আর পরাজয় বরণকারী হল কিভাবে? আল্লাহ মানুষকে যে সামান্য জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন, সেই বিবেক বুদ্ধির ফসল হচ্ছে বিজ্ঞান। ফসল যেমন নিত্য নতুন করে ফলে। বিজ্ঞানের তেমন নিত্য নতুন তত্ত্ব-তথ্য আপডেট হতে থাকে।
তাফসীরে কুরতুবীতে মুযেজার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। যার একটি হচ্ছে- তা আল্লাহর কুদরতের প্রকাশ। আর আল্লাহর কুদরতের কি কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হতে পারে? উদাহরণস্বরূপ পাথর ফেটে গিয়ে হযরত সালেহ আ. এর জন্য উট বেরিয়ে আসছিল। অথচ পাথর ভাঙলে উট পাওয়া যাবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হতে পারে? নমরুদের আগুনের কূপে তিনদিন পর্যন্ত হযরত ইবরাহীম আ. অক্ষত অবস্থায় থেকে বেরিয়ে আসলেন। কোন বৈজ্ঞানিক কি এটা পরীক্ষা করতেও যাবে যে, অন্তত একদিন আগুনের কূপে নেমে দেখি? হযরত ইসা আ. এর হাতের ছোঁয়ায় জন্মান্ধ ভাল হয়ে যেত। অন্ধের চোখে কারো হাতের ছোঁয়া লাগলে সে দৃষ্টি ফিরে পাবে এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি? কোন খ্রিস্টান বৈজ্ঞানিক বাইবেলে উল্লেখিত ঈসা আ. এর এই মোযেজাকে অস্বীকার করবে? না এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে?
মোটকথা কস্মিনকালেও মোযেজার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিয়ে হবে না। তবে এ কথা ধ্রুব সত্য যে বিজ্ঞান যতই উন্নত হচ্ছে এবং হবে কুরআনের সাথে ততই সমন্বয় হয়ে যাচ্ছে এবং হবে। বিজ্ঞান যতই তার সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে নতুন সত্য আবিষ্কার করছে, ততই কুরআনের সাথে তার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে তাই আমার বিজ্ঞানের আরো উৎকর্ষ আশা করছি যে দিন কুরআন আর বিজ্ঞান প্রায় একাকার হয়ে যাবে। যেমনটা ইতোপূর্বে হাজারো বিষয়ে হয়ে গেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের জন্যে মিরাজের যথার্থতা উপলব্ধি করে মিরাজের উপহার আল্লাহ প্রদত্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *