ফুল, ফল ও ফসলের হেমন্ত

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের এই লাল সবুজের বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতি দু’মাস অন্তর অন্তর এক একটি ঋতু পরিবর্তন হয়! আগমন করে নিজস্ব বহুমুখী বৈচিত্র্যতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ঋতু। আমাদের এই রূপবতী বাংলাদেশে বারো মাসে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ছয়টি ঋতুর পালা বদল হয় প্রতি বছর!
তাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি কে বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ। এই ঋতু পরিবর্তনের মধ্যে যেমন রয়েছে নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা ঠিক তেমনি রয়েছে প্রতিটি ঋতুর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা সৌন্দর্যতা। বাংলার অপার সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ বিমোহিত হয় আমাদের প্রকৃতিপ্রেমী অন্তরদৃষ্টি ও বিদেশীয় দৃষ্টি। তাই ভালোবাসার টানে বিদেশি পর্যটকগণ ছুটে আসে পৃথিবীর মানচিত্রে ক্ষুদ্র এক লাল সবুজের প্রিয় আঙ্গিনায়। মুখে মুখে গুঞ্জরিত হয় সোনার বাংলা ধ্বনি। যার প্রতিটি ধুলিকণা যেন সোনার মতোই দামী। অথবা ফুল, ফল ও ফসলের উর্বরভূমি প্রিয় বাংলাদেশ। এ সবুজের বাংলা আমাদের তনুমন কে পুলকিত করে ষড়ঋতুর রূপের মাধুরী বা সৌন্দর্যের কমনীয়তায়। আর এ ষড়ঋতুর অনন্য ঋতু হলো রূপের রাণী সুখের বাণী পরম প্রিয় হেমন্তকাল!
স্নিগ্ধ হেমন্তকাল যেন আমাদের কে একটু বেশিই বিমুগ্ধ করে। সকালে ধানগাছের ডগায় যে শিশির জমে থাকে তা হেমন্তের মায়াবী রূপের এক ঝলক সৌন্দর্যেরই পূর্বাভাস জানান দেয়। সকালের প্রথম রোদের বর্ণচ্ছটায় গাছের পাতাগুলো যেন হেসে ওঠে। দৃষ্টিসীমা যত দূর যায়, দেখা যায়, আলোকোজ্জ্বল অপূর্ব একটি সকাল তার অভাবনীয় সৌন্দর্য নিয়ে যেন অপেক্ষমান। গাছের নরম-কচি পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টি রোদ আর সুনীল আকাশ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। হেমন্তের রাতে মেঘমুক্ত আকাশে ফালি ফালি জোছনার আলো অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই ঠিকরে পড়ে। কালের চাকায় ভর করে আবারো আমাদের মাঝে সমাগত প্রিয় হেমন্তকাল। হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রহর। শরতের কাশফুল মাটিতে নুইয়ে পড়ার পরপরই হেমন্তের আগমন ঘটে। এর পরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয়ে শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তে সকালবেলা আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারি দিকের মাঠঘাট।

খুব সুন্দর দুধেল জোসনার মতো মনে হয় সকালের প্রকৃতিটা কে। হেমন্তে শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি নানা ধরনের ফুল ফোটে। হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের আমেজ। ফুল যেন আমাদের সৌন্দর্যের অবয়ব ও পবিত্রতার প্রতীক! ফুল মনে প্রশান্তি আনে আর শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফুল এখন যেকোনো আনন্দ উৎসব বা অনুষ্ঠানে আজকাল অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
বাংলার মাটি অত্যন্ত উর্বর বলে সামান্য পরিশ্রমেই ফলমূল ফলানো যায়। বছরে ছয়টি ঋতু পালাক্রমে প্রকৃতিকে আপন মনে সাজিয়ে নেয়! উপহার দেয় রূপ, রস, গন্ধেভরা সুস্বাদু বিভিন্ন ফল। এ হেমন্তকে তাই উৎসবের ঋতু বললেও ভুল হবে না। হেমন্তে বিভিন্ন ধরনের ফলের সমারোহ ঘটে। এ ঋতুর বিশেষ কিছু ফল হলো কামরাঙা, চালতা, আমলকি ও ডালিম। নারিকেল এ ঋতুর প্রধান ফল।
সুতরাং গৃহিণীর পিঠার তালিকায় থাকে নারিকেলের তৈরি পিঠা বানায়, আর সে কষ্ট আনন্দময় হয়ে ওঠে সকালে তা পড়শিদের মাঝে বিতরণ করে। যা আমাদের রসনায় তৃপ্তিসাধন করে।
কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এ দু’মাস জুড়ে বাংলার প্রকৃতিতে স্বীয় বৈশিষ্ট্যতা নিয়ে আবির্ভূত হয় ফসলের ঋতু হেমন্তকাল। আর এ হেমন্তকাল জুড়েই আমরা দেখতে পাই আমন ধানের খেত, যা খুবই সুন্দর ও নয়নকাড়া, কচিকাঁচা ধানগাছগুলো সতেজ হতে আরম্ভ করে ক্রমেই। পানির উপর মাথা তুলে দাঁড়ানোর দৃশ্য সত্যি খুব বিস্ময়ামুগ্ধকর। সারা মাঠ যেন সবুজে সবুজে ছেয়ে যায়। বাতাস বয়ে যায় মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ঢেউ খেলে যায় নিরুদ্দেশ অজানায়, সুন্দরের এ হাতছানি যেন খুবই মনোরম ও মনোলোভা। ভাবুক হৃদয়ে ঝড়তুলে মুগ্ধতার ছোঁয়ায় ও ভালোবাসার অসীম মায়ায়। ধানগুলো যখন পাকে সারাটি মাঠে তখন সোনালী সূর্যের মতো চিকচিক করতে থাকে। ঠিক যেন সূর্য কিরণের মিষ্টতায় অপরূপ সৌন্দর্যের দৃশ্য সৃষ্টি করে।
আগেকার দিনে বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষের দিকে বোনা আমন ধানের গাছ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক মাসে ধান পরিপক্ক হয়। কৃষকেরা এই সময় খুশিমনে পাকাধান কেটে ঘরে তোলে। নতুন ধানের পিঠা-পুলি আর খেজুরের রসে রসিয়ে রসিয়ে প্রয়োজন মতো আয়োজন করে নবান্ন উৎসব। পল্লী জীবন বয়ে আনে নানারকম আনন্দের হাতছানি। গত হয়ে যাওয়া সব কবি সাধকরা লিখেছেন কতশত কাব্য/কবিতা পাতা ঝরা এই হেমন্তের অন্তরস্থিত প্রকৃতি নিয়ে।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *