এই নশ্বর পৃথিবীর অবিনশ্বর মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কালোত্তীর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বলেন-“নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি নির্মিত হয়, সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর হেদায়েতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল। তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং ইব্রাহিম আ.-এর ইবাদতের স্থান। আর তার অবস্থা হচ্ছে এই, যে তার মধ্যে প্রবেশ করেছে-সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। মানুষের মধ্য থেকে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন এই গৃহের হজ্জ সম্পন্ন করে। এটি তাদের ওপর আল্লাহর অধিকার। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ মেনে চলতে অস্বীকার করে-তার জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ তায়ালা বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।” [সূরা আল-ইমরান- ৯৬ ও ৯৭]
বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালা কত চমৎকার করে হজ্জের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। এরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আ.-কে লোকদের মাঝে হজ্জের ঘোষণা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ প্রদান করেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-“আর মানুষের মাঝে হজ্জের জন্য ঘোষণা প্রচার করো। তারা দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে।’ [সূরা হজ্জ- ২৭]
হজ্জ এর অর্থ হলো- আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে শরিয়তের নির্ধারিত নিয়ম অনুসারে নিদির্ষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থান-তথা বায়তুল্লাহ শরীফ এবং সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহের জিয়ারত করা। হজ্জ ইসলামের পঞ্চ রুকনের অন্যতম একটি রুকন। যারা অর্থিক ও শারীরিক দিক থেকে সামর্থবান-তাদের ওপর জীবনে একবার হজ্জ করা ফরজ।
প্রাচীনকাল থেকেই আল্লাহ প্রেমিক বান্দারা বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ করে আসছেন। হযরত আদম আ. আল্লাহ পাকের হুকুমে এবং হযরত জিবরাঈল আ.-এর দেখানো পদ্ধতিতে বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করেছেন। এর পর থেকে এ ঘরের তাওয়াফ ও জিয়ারত অব্যাহত থাকে। হযরত নুহ আ.-এর সময়কার মহাপ্লাবন এবং তুফানে বায়তুল্লাহ শরীফ লোক চক্ষুর অন্তরালে চাপা পড়ে যায়। এর পর আল্লাহর হুকুমে হযরত ইব্রাহিম আ. কাবা শরীফ পুনর্নিমাণ করেন এবং আল্লাহর হুকুমে হযরত ইব্রাহিম আ. এবং হযরত ইসমাঈল আ. কাবা শরীফের তাওয়াফসহ হজ্জের যাবতীয় কর্মকান্ড সমাধা করেন। অতঃপর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন গোটা বিশ্ব জাহানকে হযরত ইব্রাহিম আ.-এর সামনে তুলে ধরেন এবং তিনি আল্লাহর হুকুমে ‘মাকামে ইব্রাহিম’ অথবা ‘জাবালে আবু কুবাইস’ নামক পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দুই কানে আঙ্গুল রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ করে ঘোষণা করেন- “হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর সেই গৃহের হজ্জ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন কর।” হযরত ইব্রাহিম আ.-এর সেই আহবান থেকেই হজ্জের উৎপত্তি। সেই আহবান থেকে আজ পর্যন্ত কয়েক হাজার বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ-লক্ষ মানুষ এসে কাবাঘরের তাওয়াফ করে যাচ্ছে। কেউ স্থল পথে, কেউ জল পথে অথবা কেউ আকাশ পথে এসে হজ্জ করছে। দিন যত যাচ্ছে-বায়তুল্লাহর পানে আগমণকারীর সংখ্যা ততই বাড়ছে। এমনকি হযরত ইব্রাহিম আ.-এর পরে যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছেনÑসবাই বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফসহ হজ্জের যাবতীয় কাজ সমাধা করেছেন। [তাফসীরে ইবনে কাসীর]
জাহেলিয়াতের যুগেও লোকেরা বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ ও জিয়ারত করত। তবে তারা তাওয়াফ করত জাহেলী নিয়মে। এতে অনেক অশ্লীল কর্মকাণ্ডও তারা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। নবম হিজরীতে রাসূল সা.-এর নির্দেশে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর নেতৃত্বে সাহাবায়ে কেরামের একটি দল হজ্জ পালন করেন। আর এ বছর থেকেই ইসলামের বিধান অনুসারে এবং হযরত ইব্রাহিম আ. প্রবর্তিত নিয়ম অনুসারে হজ্জের বিধি-বিধান প্রবর্তন করা হয়।
মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হল পবিত্র হজ্জ। ইসলামী জীবন দর্শনের ওপর পূর্ণ অটল ও অবিচল থাকা হলো হজ্জের প্রধান শিক্ষা। মুসলমানরা পরকালকে বিশ্বাস করে, সাদা-কালো, ধনী-গরীব, আমীর-ফকীর, রাজা-প্রজা ও দেশ-গোত্রের ভেদাভেদ ইসলামে নেই। সব মুসলমান একে অপরের ভাই, একই আল্লাহর বান্দা, একই রাসূলের আদর্শের অনুসারী বা উম্মত, একই কুরআনের বিশ্বাসী, একই কাবার প্রভুর অনুগত। এ বিশ্বাসের এক বাস্তব অনুশীলন হল পবিত্র হজ্জ। হজ্জের একটি অন্যতম তাৎপর্য ও শিক্ষা হলো গোটা উম্মাহ তথা মুসলিম মিল্লাতের বৃহত্তর ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখা বা প্রতিষ্ঠা করা এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা। হজ্জের মধ্যে ধর্মীয় ও পার্থিব অনেক উপকার রয়েছে, যা সংক্ষেপে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-“যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্বরণ করে।” [সূরা হজ্জ-২৮]
হজ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফযিলত হলো- রাসূল সা. বলেন-“তোমরা হজ্জ ও ওমরা পালন কর; কারণ হজ্জ ও ওমরা দু’টি জিনিসকে ধ্বংস করে দেয়-দারিদ্রতা এবং গুনাহ।” একারণে হজ্জ করে কেউ দেউলিয়া হয়েছে-এমন নজীর কোথাও পাওয়া যাবে না। সুতরাং যাদের আর্থিক সামর্থ এবং শারীরিক শক্তি রয়েছে, তাদের জন্য আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করার চেয়ে মহৎ এবং কল্যাণকর কাজ দুনিয়াতে আর কিছু নেই।
পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ঘর হল কাবা গৃহ তথা মসজিদে হারাম। পবিত্র কুরআনে কাবাগৃহকে ‘বাইতে আতিক’ তথা স্বাধীন মুক্ত ঘর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর অর্থ হলো এ ঘরের এত মর্যাদা যে, দুনিয়ার কোন পরাশক্তি বা কোন কাফের অত্যাচারী এ ঘর ধ্বংস করতে পারবে না। রাসূল সা. বলেছেন-“আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কাবা ঘরকে কাফের ও অত্যাচারীদের অধিকার থেকে মুক্ত করে দিয়েছে।” ইয়েমেনের খৃষ্টান রাজা আবরাহা পবিত্র কাবা ঘরের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজ দেশে একখানা কাবা নির্মাণ করেছিলেন; কিন্তু কেউ সেই কাবা জিয়ারতের জন্য পা বাড়ায়নি। অবশেষে তিনি বিশাল এক হস্তী বাহিনী নিয়ে কাবাঘর ধ্বংস করার জন্য এসেছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আবাবীল নামক এক প্রকার ছোট্ট পাখী দ্বারা তাকে দলবলসহ ধ্বংস করে দেন। এসবের নিদর্শন স্বরূপ হেরেম শরীফের ভিতরে এখনো অনেক আবাবীল পাখি অবস্থান করে, এরাও সেই আবাবীলের বংশধর বলে জনশ্রুতি আছে। হয়ত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কাবাঘর এবং পবিত্র মক্কা নগরীর নিরাপত্তার জন্য এখনো সেই আবাবীলদের নিয়োজিত রেখেছেনÑযারা অত্যাচারী আবরাহাকে ধ্বংস করেছিল।
মক্কা থেকে ৯ মাইল দূরে হেরেমের সীমানার বাইরে আরাফার ময়দান অবস্থিত। এখানে হযরত আদম ও হাওয়ার দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে মিলন (সাক্ষাত) ঘটেছিল-এজন্য এ ময়দান-কে আরাফার ময়দান বলা হয়। এখানে হযরত ইব্রাহিম আ.-এর প্রতিষ্ঠিত একখানা বিরাট মসজিদ রয়েছে। একে বলা হয় মসজিদে নামিরাহ। ময়দানের এক প্রান্থে অবস্থিত জাবালে রহমাত-যেখানে হেরা গুহা অবস্থিত। জ্বিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ এ ময়দানে মুসলমানদের বিরাট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সুবিশাল সম্মেলনে ভাষণ দেন ইমামুল মু’মিনীন বা মুসলমানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। এভাষণের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হলোÑমুসলিম বিশ্বের ঐক্য সংহতি এবং বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। এখানে মুসলমানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববাসীকে আহবান জানান। সকল প্রকার হানাহানি, বিবাদ-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে বিশ্বনবীর উম্মতদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উপদেশ প্রদান করেন। ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির সুমহান আদর্শ তুলে ধরেন বিশ্বের সামনে। সে ভাষণ শ্রবণ করাও হজ্জের একটি অবশ্যপালনীয় বিষয়।
হজ্জ শুধু পরকালীন কল্যাণই বয়ে আনে না; বরং ইহকালের কল্যাণের বার্তাও নিয়ে আসে। যেমন-আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. বলেন-“তোমরা হজ্জ ও ওমরাহ বিলম্ব না করে পরস্পর সম্পাদন করো। কারণ, এ দুটো ইবাদত দারিদ্র্য ও পাপসমূহকে এমনভাবে দূর করে, যেভাবে হাপর লৌহ ও স্বর্ণ-রৌপ্যের ময়লা দূর করে দেয়। [মিশকাত- ১০২৬] হজ্জ মুসলিম মিল্লাতের জন্য সৌভাগ্যের পরশ পাথরের ন্যায়। কেননা, রাসূল সা. বলেছেন, হজ্জ ব্যক্তির পূর্বের গুনাহ ধ্বংস করে দেয়। রাসূল সা. আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জের ইচ্ছা করেছে, তিনি যেন তাড়াতাড়ি তা সম্পাদন করেন। [মিশকাত- ২০১৫]
হজ্জ হচ্ছে গোটা মুসলিম মিল্লাতের ঐক্যের মহাসম্মেলন-যাতে সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানদের রক্ত, বর্ণ, ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখার বিভিন্নতা ভুলে এককেন্দ্রিক হওয়ার পথ খুঁজে পায়। এর মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের চিত্র ফুটে ওঠে। এটি মুসলমানদের মধ্যে ঈমানি জজবা ও ইসলামী চেতনা সৃষ্টি করে।