প্রতিবেশীর অধিকার : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধানের নাম। একজন মানুষ তার জীবন চলার পথে যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে তার সবগুলোরই যৌক্তিক সমাধান পেশ করেছে ইসলাম। একটি ভারসাম্যপুর্ণ সমাজ গঠনে ইসলামের দিকনির্দেশনা অত্যন্ত বিজ্ঞান সম্মত এবং গঠনমূলক। আমরা আলোচ্য নিবন্ধে প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
প্রতিবেশী শব্দটির আরবি প্রতিশব্দ জার। এটির শাব্দিক অর্থ প্রতিবেশী, পাড়াপড়শী ইত্যাদি।
পরিভাষায় বলতে পারি, আমাদের বাসা বাড়ির চারপাশে যেসব লোকজন বসবাস করেন তারা আমাদের প্রতিবেশী। চাই তারা নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করুক বা ভাড়া বাসায় বসবাস করুক। আর হাদিসের বর্ণনা মতে নিজ বাড়ির চারপাশের চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত যারা বসবাস করেন তারা একে অপরের প্রতিবেশী। বতর্মান সময়ে বহুতলবিশিষ্ট ফ্ল্যাটে বসবাসকারীরাও পরস্পর পরস্পরের প্রতিবেশী।
হাদীসের বর্ণনামতে হক বা অধিকারের আলোকে প্রতিবেশী তিন শ্রেণীর হয়ে থাকে। যেমন রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, কোন কোন প্রতিবেশী রয়েছে, যাদের হক মাত্র একটি। এমন কোন কোন প্রতিবেশী রয়েছে যাদের হক দুটি এবং এমন কতক প্রতিবেশী রয়েছে যাদের হক তিনটি। নিচে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া হলো-
১. এক হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী তারা, যারা প্রতিবেশী কিন্তু আতœীয় নয় এবং অমুসলিম।
২. দুই হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী তারা, যারা প্রতিবেশী হওয়ার সাথে সাথে মুসলমান কিন্তু আতœীয় নয়।
৩. তিন হক বিশিষ্ট প্রতিবেশী তারা, যারা প্রতিবেশী হওয়ার সাথে সাথে মুসলমান এবং আতœীয়ও বটে।
প্রতিবেশীর হক আদায়ের গুরুত্ব : প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ প্রদর্শন এবং পরস্পরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করা প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। এ বিষয়ের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন-আর ইবাদত কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। আর পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকট আতœীয়, ইয়াতিম-মিসকিন, আতœীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীদের সাথেও ভালো ব্যবহার করো। (সূরা আন নিসা, আয়াত-৩৬)।
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন-জারি-যিল-কুরবা বলতে তাদেরকে বুঝায়, যারা প্রতিবেশী হওয়ার সাথে সাথে আতœীয়ও বটে। আর জারিল-জুনুব বলতে শুধুমাত্র সেসব প্রতিবেশীকে বুঝায় যাদের সাথে আতœীয়তার কোন সম্পর্ক নেই।
কোন কোন তাফসীরকারকের মতে, জারি যিল-কুরবা এমন প্রতিবেশীকে বলা হয়, যারা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং মুসলমান। আর জারিল-জুনুব বলা হয় অমুসলিম প্রতিবেশীকে। (তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন)।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত। তাঁরা বলেন, নবী করীম সা. বলেছেন, জিব্রাঈল আ. প্রতিনিয়তই আমাকে প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে তাকীদ দিচ্ছিলেন। এমনকি আমার ধারণা জন্মেছিল যে হয়তো প্রতিবেশীকে আমার সম্পত্তিতে হকদার করা হবে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। আলোচ্য হাদীস দ্বারা প্রতিবেশীর অধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানা যায়।
হাদিসের আলোকে প্রতিবেশীর হক : প্রতিবেশীর হকের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহর কসম সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়। সাহাবীগণের একজন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! লোকটি কে? জবাবে রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, যার অনিষ্ট হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না। (সহীহুল বুখারী ও মিশকাত)।
আলোচ্য হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রতিবেশীর হক অনিষ্টকারী কোন ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলমান হতে পারেন না। তাই আমাদের উচিত প্রতিবেশীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে আরো বেশি যতœশীল হওয়া।
প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করা নৈতিক দায়িত্ব। তাদেরকে কোন প্রকার কষ্ট না দেয়া, তাদের উপকার করা, দান করা এবং যথাসম্ভব গরীব প্রতিবেশীর দুঃখ-কষ্টে অংশীদার হওয়া ঈমানী দায়িত্ব। যেমন রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, সে ব্যক্তি প্রকৃত ঈমানদার নয়, যে নিজে তৃপ্তি সহকারে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (বায়হাকী ও মিশকাত)।
প্রতিবেশীর অধিকার আদায়ে যতœশীল হওয়ার তাকীদ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন, যখন তুমি তরকারি পাকাবে, তখন তাতে কিছু অতিরিক্ত পানি দিবে, যাতে করে তুমি প্রতিবেশীকে কিছু হাদিয়া দিতে পার। (সহীহ মুসলিম)।
এ ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সা. মুসলিম নারীদের উদ্বুদ্ধ করে আরো বলেন, হে মুসলিম রমনীরা! তোমরা প্রতিবেশীর বাড়িতে সামান্য বস্তু পাঠানোকে তুচ্ছ মনে করবে না। এমনকি তা যদি বকরির পায়ের সামান্য অংশও হয়। (সহীহ বুখারী)।


প্রতিবেশীর হক আদায়ের গুরুত্ব কত বেশি নিচের হাদিস থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন একজন লোক রাসুলুল্লাহ সা. এর দরবারে এসে নিবেদন করল, হে আল্লাহর রাসুল! অমুক স্ত্রী লোকটি অধিক নফল সালাত আদায়, অধিক রোযা পালন ও অধিক দান খয়রাতের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদেরকে জিহ্বা দ্বারা কষ্ট দেয়। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, সে জাহান্নামী। সে আবার আরজ করল, হে আল্লাহর রাসুল! অমুক স্ত্রী লোকটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, সে নফল সালাত কম আদায় করে, নফল রোযা কম রাখে এবং দানও করে কম কিন্তু সে মুখের ভাষা দিয়ে কাউকে কষ্ট দেয় না। রাসুলুল্লাহ সা: বললেন, সে জান্নাতবাসীনী। (মিশকাত)।
আলোচ্য হাদিস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, প্রতিবেশীর হক নষ্টের কারণে কাউকে জাহান্নামে যেতে হতে পারে। তাই আমাদের প্রতিবেশীর হক আদায়ে আরো যতœশীল হতে হবে।
রাসুলুল্লাহ সা. প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আরো বলেছেন, কিয়ামতের দিন যে দুজন ব্যক্তির মামলা সর্বপ্রথম পেশ করা হবে, তারা হলো দুজন প্রতিবেশী। (মিশকাত)।
এ নিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম সা. এর নিকট আরজ করল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ভালো করছি নাকি মন্দ করছি তা কি করে জানব? নবী করীম সা. বললেন, যখন তোমার প্রতিবেশীদের বলতে শুনবে যে, তুমি ভালো করছ, তবে প্রকৃতই তুমি ভালো করছ। আর যখন প্রতিবেশী বলবে তুমি মন্দ করছ, তবে মনে করবে ঠিকই তুমি মন্দ করছ। (ইবনে মাজাহ)।
রাসুলুল্লাহ সা. আরো বলেছেন, যার অনিষ্ট থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (সহীহ মুসলিম)।
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কে কোন ধর্মের অনুসারী, কোন মতের মানুষ, কোন বর্ণের ব্যক্তি, সে গরীব নাকি ধনী, শিক্ষিত নাকি বোকা তা ভাবতে বলা হয়নি। কোন প্রকার গোত্র বা বর্ণের ভেদাভেদ দূরীভূত করে মানব কল্যাণের কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে। একজন মুমিনকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করতে। জগতের সকল মানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ ও মানবীয় আচরণ প্রদর্শনে ইসলাম গুরুত্ব আরোপ করেছে বেশ কঠোরভাবে। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে সকল প্রকারের প্রতিবেশীর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করা। যা ঈমানের দাবিও বটে।
উপরোক্ত হাদিসের আলোকে আমরা প্রতিবেশীর হকের বিষয়ে যা জানতে পারলাম ব্যক্তিগত জীবনে আমরা যদি তা আমলে আনতে পারি তবেই সুন্দর একটি পৃথিবী গড়তে সহজ হবে। ইসলামের সুমহান আদর্শের বদৌলতে এই দুনিয়া হয়ে উঠবে একটি সুখী সুন্দর স্বপ্নীল বসুন্ধরা। তাই আসুন আমরা ইসলামকে জানি। ইসলামের আদর্শকে বুঝতে চেষ্টা করি। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরেই এ ব্যাপারে যতœশীল ভুমিকা রাখি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে প্রতিবেশীর হক আদায়ের ব্যাপারে আরো বেশি যতœশীল হওয়ার তাওফিক দিন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *