পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন আল্লামা ফুলতলী

মাওলানা আকরাম খাঁ ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত কালকে বাঙালী মুসলিমদের পতন যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন। পলাশীর পতনের পরে বাংলার তথা সারা ভারতের মুসলিম জীবনে যে পতনের স্রোত বইতে থাকে, তাতে মুসলিমরা তিলেতিলে অধঃপতনের চরম স্তরে গিয়ে পৌছে। তবে সে অধঃপতনের যুগে তাদের সমাজে যে প্রতিভার বিকাশ হয়েছিলো এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে তারা নানা গবেষণা করে তার ফল প্রকাশ করেন; তা এক আচশ্চর্যজনক বিষয় বলেও একটা দৃঢ় সত্য। সে পতন যুগেও সূফী-দরবেশ ও আউলিয়ায়ে কিরামগণ মানব জীবন এবং তার উৎপত্তি-পরিণাম সম্পর্কে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সূফী-দরবেশগণ তাদের অভিজ্ঞতার ফল প্রকাশ করে আপন জীবনের সার্থক চিহ্ন রেখে গেছেন এই জগতে। এদের সাধনার এ ফলকে আমরা আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে ঐতিহ্য বলে গণ্য করি। এদের মধ্যে অন্যতম একজন মহান মনীষী হলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামিল, রঈসুল কুররা ওয়াল মুফাসসিরিন, উস্তাদুল মুহাদ্দিসিন, সুলতানুল আরিফিন, শামছুল উলামা হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহমতুল্লাহি আলাইহি। আমাদের কাছে খুবই পরিচিত এক নাম “আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী।” তার ধ্যান-ধারণা নিয়ে, তার জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। গবেষণা চলছে, চলবে। বলাবাহুল্য; আল্লামা ফুলতলীর বহুবিধ জীবনের প্রতিটি দিকই গবেষণার দাবি রাখে।
ইহ ও পরকালীন মুক্তির জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসুলগণের আগমন ঘটেছিলো এ ধরাধামে। শেষ নবী নুরে মুজাসসাম হযরত মুহাম্মাদূর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ায় আসার মধ্য দিয়ে নবী-রাসুল আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। আর কোন নবী বা রাসুল আসবেন না এ জগতে। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন প্রচারে ও পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে নবীদের উত্তারাধীকার আউলিয়ায়ে কেরাম, উলামায়ে কিরামগণ যুগে যুগে আগমন করবেন। ইয়েমেনের অধিবাসী হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামনী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইসলাম প্রচারে আসলেন সিলেট। তাঁর পবিত্র পদধুলি পেয়ে সিলেট হয়ে গেলো আধ্যাত্মিক রাজধানী। সিলেটের জমিনে হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর স্বার্থক উত্তর পুরুষ হচ্ছেন জামানার শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ, শামছুল উলামা হযরত আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহমতুল্লাহি আলাইহি। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি ১৯১৩ সালে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বাদেদেওরাইল পরগণার ঐতিহ্যবাহী ফুলতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল মজিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সুযোগ্য সন্তান, আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহমতুল্লাহি আলাইহি সিরাতে-সুরতে ছিলেন একজন ইনসানে কামিল। তিনি যেমনি ইসলামের একজন সফল খাদেম ছিলেন, তেমনি সমাজ সংস্কারক ও মানবতাবাদি ছিলেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দিশারী ছিলেন। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহমতুল্লাহি হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি-এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহ কামাল রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বংশধর। তিনি আমলে সালিহের মাধ্যমে তাযকিয়ায়ে নাফসের মেহনতে উচ্চাসনে আসীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।
পারিবারিক জীবনে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহমতুল্লাহি আলাইহি ১৩৪৫ বাংলায় স্বীয় পীর ও মুর্শিদ কুতবুল আউলিয়া হযরত মাওলানা আবু ইউসুফ শাহ মুহাম্মাদ ইয়াকুব বদরপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর তৃতীয় কন্যা মুহতারামা খাদিজা-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি একসময় ইবাদত বন্দেগীতে নিমজ্জিত হলে সংসার বিরাগ সৃষ্টি হয়। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহমতুল্লাহি আলাইহি তখন তাঁর শ্বশুর ও মুরশিদ হযরত বদরপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নির্দেশে ফুলতলী গ্রামের মরহুম আব্দুর রশিদ খানের কন্যা মুহতারামা নেহারুন নেছার সাথে দ্বিতীয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ফুলতলী ছাহেবের সাতজন সাহেবজাদা ও তিনজন ছাহেবজাদী রয়েছেন। তারা হলেন যথাক্রমে-


হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী (বর্তমান গদিনিশিন)
মাওলানা নজমুদ্দীন চৌধুরী
মোছাম্মত করিমুন্নেছা চৌধুরী
মাওলানা শিহাব উদ্দীন চৌধুরী
মোছাম্মত মাহতাবুন্নেছা চৌধুরী
মোছাম্মত আফতাবুন্নেছা চৌধুরী
মাওলানা মুফতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী
মাওলানা কমর উদ্দীন চৌধুরী
হাফিয মাওলানা ফখর উদ্দীন চৌধুরী
মাওলানা হুছাম উদ্দীন চৌধুরী।
হযরত আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী রহমতুল্লাহি আলাইহি’র সাতজন ছাহেবজাদাই স্ব-স্ব মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। যা বর্তমান সময়ে উদাহরণ হিসেবে যেকোন পরিবারে খুঁজে পাওয়াও কঠিন বিষয়। যেমন- অনেক মানুষ দেখেছি, যাদের ৫/৭জন এমনকি দশের অধিকও ছেলেসন্তান আছেন, কিন্তু শত চেষ্টা করে একজন ছেলেকেও আলেম বানানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর সাতজন ছেলেই হক্কানি আলেম, হাফিজ, মুফতী, মুহাদ্দিস, লেখক-গবেষক ইত্যাদি। দ্বীনি, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পিতার পথ অনুসরণ করে তারাও আজ দ্বীনের একেকজন মহান খাদেম। ফুলতলী ছাহেবের অনেক কারামত এবং অলৌকিক ঘটনার কথা আমরা জানি। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কারামতের কথা যদি বর্ণনা করতে হয়; তাহলে বলতে হবে যে, তার সাতজন ছেলে, সাতজনই জননন্দিত আলেম। এমনকি ইতিমধ্যে ফুলতলী ছাহেবের কয়েকজন নাতিও আজ স্বনামধন্য আলেমে পরিণত। তারাও আজ তাদের নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত।
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মুরিদান-মুহিব্বিন, শুভাকাক্সিক্ষ ও ছাত্রদেরকে একটি পরিবারের সদস্য ভাবতেন। তাই তো তিনি মোনাজাতে হাত তুলেই বলতে-‘ইয়া আল্লাহ! আমার রূহানী-জিসমানি আওলাদদেরকে তোমার হাওলা করলাম।’
মহান আল্লাহ যেন এই মকবুল ওলীর দরজা বুলন্দ করেন এবং তাঁরই রূহানী ফায়েজ দিয়ে আমাদের ধন্য করেন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *