নজরুল কাব্যে বিশ্বনবীর আবির্ভাব

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যজগতের এক মহানায়ক। সাহিত্যের সকল শাখা-প্রশাখায় নজরুলের সরব লেখনী স্বাধীনচেতায় গর্জন দিয়েছে স্বতন্ত্রভাবে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান দু’জাতি তথা মুসলিম হিন্দুর ঐতিহ্য অনুসরণে কলম চালনায় তার জুড়ি নেই। বিশেষ করে মুসলিম জাতির ক্রান্তিকালে তিনি ধুমকেতুর মত আগমন করে জেগে উঠার ডাক দিলেন, লিখলেন, গাইলেন। এই ঐতিহ্যের চিন্তা-চেতনা, লেখা, গাওয়া একসাথে সবার পক্ষে অসম্ভব। নজরুল এ অসম্ভবকে সম্ভব করে বাস্তবতায় রূপ দিলেন বাংলা কাব্য কাননে। একসময় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের না’ত বা প্রশংসামূলক কাব্য রচনায় মত্ত হলেন এভাবে-
জেগে উঠ্ তুই রে ভোরের পাখী
নিশি-প্রভাতের কবি!
লোহিত সাগরে সিনান করিয়া
উদিল আরব-রবি।
বিশ্বনবী রাহমাতুল্লিল আলামীনের আগমন উপলক্ষে তাঁর ‘অবতরণিকা’ কবিতায় গেয়ে উঠলেন-
আরব ছাপিয়া উঠিল আবার
ব্যোম পথে ‘দীন্’ ‘দীন’,
কাবার মিনারে আবার আসিল
নবীন মুয়াজ্জিন!
প্রিয়নবী রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনে বিশ্ববাসীর জাগরণ অনুভূত হল। আরবের পশু-পাখি, লতা-পাতা, বালিকণা এমনকি সাহারা মরুভূমিও উতলে উঠল সাগরসম। জাতীয় কবির ভাষায় বলা যায়-
বয়ে যায় ঢল ধরে না কো জল
আজি ‘জমজম’ কূপে
‘সাহারা’ আজিকে উথলিয়া ওঠে
অতীত সাগর রূপে।
একই কবিতায় অন্যত্র লিখেন-
খুশীতে বেদনা-ডালিম, ডাঁশায়
ফাটিয়া পড়িছে ভূঁয়ে,
ঝরে রসধারা নারঙ্গী শেউ
আপেল আঙ্গুর ছুঁয়ে।

‘মুহাম্মদ’ নামে বিশ্বে আর কারো নাম ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। বিশ্বনবীর দাদা আব্দুল মুত্তালিব আদর করে নাম রাখলেন ‘মুহাম্মদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অভিনব এ নাম মোবারকের এবং অপেক্ষমান ব্যক্তি সত্ত্বার প্রসঙ্গ টেনে নজরুল বললেন-
অভিনব নাম শুনিল রে-ধরা সেদিন ‘মোহাম্মদ!’
এতদিন পরে এল ধরার প্রশংসিত ও ‘প্রেমাষ্পদ!’
নুরে মুজাস্সাম রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র নূরের আলোয় আলোকিত সারা জাহান। যে আলোর পরশে বেহেশত জ্যোতিহীন। জাতীয় কবির ভাষায় তা ফুটে উঠেছে এভাবে-
নহে আরবের নহে এশিয়ার,-
বিশ্বে সে একদিন,
ধূলির ধরার জ্যোতিতে হ’ল গো
বেহেশ্ত জ্যোতিহীন!
বিশ্ব যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, মানবতা নির্বাসিত, ঠিক এমনি এক মুহূর্তে সিরাজাম মুনীরা রূপে স্রষ্টার সর্বপ্রথম সৃষ্টি, তাঁর প্রিয়তম বন্ধু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভাগমন। রাসূল প্রেমিক নজরুলের লেখায় ভেসে উঠল-
আঁধার নিখিলে এল আবার
আদি পাতের সে সম্পদ
নূথন সূর্য্য উদিল ঐ
মোহাম্মদ! মোহাম্মদ!
হযরত আব্দুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠপুত্র সৌভাগ্যবান মহানপুরুষ খাজা আব্দুল্লাহর গৃহে যার আগমন। নজরুল কাব্যে তারই শিহরণ-
দশ দিক ছাপি ওঠে আহ্বান ‘ধন্য ধন্য মুত্তালিব!’
তব কনিষ্ঠ পুত্র ধন্য আব্দুল্লাহ্ খোশ-নসীব।
হযরত ঈসা (আ.)’র প্রায় পাঁচশত বৎসর পর বারই রবিউল আউয়ালে সোমবার সুবহে সাদিকের সময় বিশ্বনবী’র আবির্ভাব ঘটে এ ধূলার ধরণীতে। এ ব্যাপারে নজরুল তার দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন ‘স্বপ্ন’ শীর্ষক কবিতায়-
রবিউল আউওল চাঁদ শুক্লা নবমীর তিথিতে
ধেয়ানের অতিথ্ এল সেই প্রভাতে এই ক্ষিতিতে!
মসীহের পঞ্চশত সপ্ততি এক বর্ষ পরে
সোমবার জ্যৈষ্ঠ প্রথম-ধরার মানব-প্রাণের তরে
আসিলেন বন্ধু খোদার মহান উদার শ্রেষ্ঠ নবী,
‘মার্হাবা সৈয়দে মক্কী মদনী আল্-আরবী।’
পরিশেষে আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের ‘অনাগত’ কবিতার শেষ দু’টো পঙক্তি দিয়ে যবনিকা টানছি।
ধন্য মক্কা, ধন্য আরব, ধন্য এশিয়া পুণ্য দেশ,
তোমাতে আসিল প্রথম নবী গো, তোমাতে আসিল নবীর শেষ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *