দ্বিতীয় উমর শ্রদ্ধাস্পদেষু

একজন পরিচয়হীন মুসলমানের সশ্রদ্ধ সালাম আপনার কাছে পৌঁছে যাক। আশা নয়; বিশ্বাস করি, জান্নাতুল ফিরদৌসে ভালো আছেন আপনি। মুসলিম উম্মাহ ভালো নেই।
উম্মতের অবস্থা আপনার অজানা নয়। খোলাফায়ে রাশিদীনের স্বর্ণযুগ শেষ হওয়ামাত্র এ উম্মত প্রথম ধাক্কা খেয়েছিল। তবু মু’আবিয়া (রা.) যতদিন ছিলেন, ততদিন অবস্থা ভালো ছিল। কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের পর সব সম্ভাবনা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। ইয়াযিদের হাতে সাধিত অবর্ণনীয় ক্ষতির ভার এ উম্মত আজও বহন করে চলছে। কারবালায় আমরা হারিয়েছি ইমাম হোসাইন (রা.)-কে। হাররার যুদ্ধে পবিত্র মদীনা নগরী রক্তবন্যায় ভেসেছে। আপনি জানেন, আমরাও জানি, ইমাম হোসাইনের এক ফোঁটা রক্তের কাছে আমাদের সমস্ত দুরাবস্থা নগণ্য। কিন্তু আমরা অবাক হই, মাত্র আড়াই বছরে আপনি কিভাবে এতো বিশৃঙ্খলা সামাল দিয়েছিলেন? ৯৯ হিজরিতে যখন আপনি খেলাফতে অধিষ্ঠিত হলেন, ততদিনে মুসলিম উম্মাহর রঙ পাল্টে গেছে। এটি সত্য যে, উমাইয়া শাসনামলে মুসলমানরা অভাবনীয় গতিতে পৃথিবী বিজয় করেছিল। আমি সেসব মহান বিজয়কে অস্বীকার করছি না। কিন্তু ইসলাম কি কেবল রাজ্য বিজয়ের নাম? কেবল রাজ্য বিজয় তো চেঙ্গিস খানও করেছেন। যে আদর্শ আল্লাহর নবী (সা.) আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন, সে আদর্শ বনু উমাইয়ার মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। মুসলিম উম্মাহর সেই আদর্শিক দৈন্যতার যুগে আল্লাহ আপনাকে উম্মতের জন্য উপহারস্বরূপ প্রেরণ করলেন। আপনি এসে উমাইয়া রাজবংশের রাষ্ট্রীয় উৎপীড়নের লাগাম টেনে দিলেন। জায়গির প্রথা রদ করলেন, আমীর-উমরা কর্তৃক দখলকৃত অবৈধ সম্পদ ফিরিয়ে আনলেন, বিদ্রোহ এবং গৃহবিবাদ স্থিমিত করলেন, কর আদায় ও বন্টন ব্যবস্থা পুনর্গঠন করলেন, মুক্ত দাস ও অনারব মুসলিমদের ওপর থেকে জিযিয়া কর বাতিল করলেন, অমুসলিমদের অধিকারদানে সচেষ্ট হলেন, সীমান্ত প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করলেন। কথাগুলো আমি খুব সহজে বলে ফেললাম। কিন্তু এগুলো সম্পাদন করতে আপনাকে কতটুকু রক্ত পানি করতে হয়েছিল, তা কেবল আপনি জানেন। সে সময় মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারবর্গকে গালাগালি করা হতো। আপনি অসীম দৃঢ়তায় সে জগন্য সংস্কৃতির বিষদাঁত ভেঙ্গে দিলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সফল একটি শিক্ষা-আন্দোলনের মাধ্যমে আপনি মুসলিম উম্মাহর হাতে তুলে দিলেন হাদীস শাস্ত্রের প্রথম লিখিত সংকলন। আমরা আপনার কাছে চিরঋণী। সেদিনও ঋণী ছিলাম, আজও ঋণী হয়ে আছি। আপনার দরবারে ন্যায়বিচার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। অপরাধ করে কেউ ছাড়া পায়নি। নিরপরাধী শাস্তি পায়নি।
আপনার পরে উম্মত আবার পথ হারালো। আব্বাসিরা ক্ষমতায় আসার পর মুসলিম উম্মাহ কিছুটা ভালো আশা করেছিল। কিন্তু সে ভালোও মনমাতানো কিছু ছিলনা। খলিফা হারূন ও মুতাওয়াক্কিলের মতো উত্তম শাসক যেমন ছিলেন; মনসুর, মু’তাসিম ও ওয়াসিকের মতো যালিমও সেখানে ছিলেন। তবু আমরা উমাইয়া-আব্বাসি শাসনকে আপন মনে করি। কারণ তখন উম্মত একিভূত ছিল, সুসংহত ছিল, বলশালী ছিল, চেতনাসমৃদ্ধ ছিল, প্রতিবাদী ছিল, জ্ঞান-গরিমায় সাবলিল ছিল। ভালো খারাপ মিলিয়ে চলছিল। মুসলিম উম্মাহ একদিকে যেমন ক্রুসেডের নিষ্ঠুরতা দেখেছিল, অপরদিকে সালাহুদ্দীন আইয়ুবীকেও হাতে পেয়েছিল। কিন্তু ১২৫৮ সালে মোঙ্গলদের ভয়ংকর আঘাতে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। এটি দ্বিতীয় কারবালা ছিল নাকি প্রথম কিয়ামত, সে হিসেব আমরা আজও মিলাতে পারিনি। তবু আল্লাহ করুণা করলেন। মামলুক ও আটোমানদের হাতে উম্মত পুনর্গঠিত হলো। চলল ৬ শতাব্দীর বেশি সময়। এরপর আঘাত হানল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তছনছ হয়ে গেল মুসলিম উম্মাহর ঐক্য। অটোমান খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ার পর এ উম্মত প্রথমবারের মতো অঁঃযড়ৎরঃু ঈৎরংরং বা কর্তৃত্ব সংকটের মুখামুখি হলো।
আমি এখানে মুসলিম দেশগুলোর কথা বলছিনা ; উম্মতের কথা বলছি। দেশ তো রয়েছে অর্ধশতাধিক। কোনো কোনো দেশ অনেক সমৃদ্ধ, ভালো শাসনব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর উম্মতের অবস্থা অথৈবচ! আদর্শিক দৈন্যতা, বহুমুখী ষড়যন্ত্র ও সুশাসনের অভাবে মুসলিম দেশগুলোর অবস্থাও যায়যায়। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন- তালিকা অনেক লম্বা। আল-কুদসের প্রশ্নেও মুসলমানরা আজ একমত নয়। খোদ আরবের রাজা-বাদশারা দখলদার ইসরায়েলের সাথে ‘গভীর সম্পর্ক’ স্থাপন করছেন! হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনা। ছোট-বড়, খ্যাত-অখ্যাত শত ধরণের যুলুম চলছে মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশে। স্বাধীন হয়েও অনেক মুসলিম দেশের নাগরিক আজ পরাধীন, বাস্তুহারা।
কিছু অত্যুৎসাহী মূর্খ ব্যক্তি জঙ্গিবাদের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মুসলমানদেরকে পদেপদে লাঞ্চিত হতে হচ্ছে। জ্ঞানের সাথে শাসনের সম্পর্ক খুব ক্ষীণ, বিচারের সাথে বিবেকের তালাক হয়ে গেছে, ন্যায় স্বয়ং অন্যায়ের সাথে আপোষ করেছে! চোখের সামনে স্পষ্ট অন্যায় হতে দেখি, ৮ বছরের শিশুকে গণধর্ষণের শিকার হতে দেখি, ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে পশুর মতো মরতে দেখি, প্রত্যেক জুম’আয় মাসজিদুল আকসাকে রক্তাক্ত হতে দেখি- কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকে না।
এ পত্র আমি উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর নিকট লিখিনি, যদিও তিনি সেরা যুগের সেরা শাসক। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ কিংবা সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর কাছেও লিখিনি, যদিও তাঁরা বিজয়ী সেনানী। আপনার কাছে লিখছি। কারণ আজ বিজয় চাচ্ছিনা; আজ চাচ্ছি সংস্কার ও নবায়ন। আজ চাচ্ছি পুনর্জাগরণ। তাই আপনার কথা মনে পড়ছে বারবার।
জানি, আপনি আর পৃথিবীতে আসবেন না। তবুও লিখছি। যদি আমাদের কথাগুলো আপনার কানে পৌঁছায়, তবে আমাদের জন্য এই দু’আটুকু করবেন- হয় আমাদের মেরুদণ্ড সোজা হোক ; নতুবা কিয়ামত চলে আসুক। মনের ভেতর অহেতুক ভীতি এবং তীব্র অপরাধবোধ নিয়ে আর কতদিন বাঁচব?

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *