তাকদির প্রসঙ্গ

তাকদিরের উপর ঈমান : ‘কাদর’ হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত মাপকাঠি, যা তিনি মাখলুকের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। তন্মধ্যে জীবন, মৃত্যু, রিযিক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
তাকদিরে বিশ্বাস স্থাপনের মূলে রয়েছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তায়ালাকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও চূড়ান্ত ফয়সালাকারী হিসেবে মেনে নেয়া। তবে আল্লাহ যেহেতু মানুষকে ভাল-মন্দ যাচাইয়ের জন্য বিবেক ও বুদ্ধিমত্তা এবং তৎসঙ্গে হেদায়াত স্বরূপ নবী-রাসুল ও আসমানি কিতাব প্রেরণ করেছেন, সুতরাং ভাল-মন্দ সব কাজের স্রষ্টা আল্লাহ হলেও ভাল-মন্দ যাচাই করে এর কর্তা হচ্ছে সৃষ্টি জীব, বিশেষত মানুষ। বিষয়টি আপতদৃষ্টের জটিল ও পরস্পরবিরোধী মনে হলেও আসলে তা খুব জটিল নয়।
প্রথমত, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তায়ালা সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। তাঁর জ্ঞান তাঁর সত্ত্বার মতোই অসীম ও অনাদি। সুতরাং তিনি আমাদের পূর্বাপর অবস্থা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরিজ্ঞাত। আর তিনি তাঁর খোদায়ী জ্ঞান ও শক্তি দ্বারা সবকিছু লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তবে দ্রষ্টব্য বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ আমাদের পূর্বাপরবৃত্ত লিখে রেখেছেন বলে আমরা ভালো কিংবা মন্দ কাজ করিনা; বরং আমরা যা করছি ও করব, আল্লাহ তা অগ্রীম জানেন বলে তিনি লিখে রেখেছেন। অর্থাৎ তাঁর লেখনি আমাদেরকে ভালো কিংবা মন্দ পথে পরিচালিত করে না, বরং আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা ও বাছাই-সক্ষমতা দ্বারাই আমরা নিজেদের পথ বেছে নেই। সুতরাং আল্লাহ আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন, এ যুক্তি দিয়ে যথেচ্ছা জীবন-যাপন করার এখতিয়ার আমাদেরকে দেয়া হয়নি। আমরা অবশ্যই জিজ্ঞেসিত হবো আমাদের কৃতকর্মের জন্য।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন তা আমরা জানি না, কস্মিনকালেও জানতে পারব না। কিন্তু অপরপক্ষে তিনি আমাদের জন্য সকল পথ ও পন্থা খুলে রেখেছেন। এসব পথ ও পন্থার নিশ্চিত পরিণামও আমরা জানি। সুতরাং যে বিষয় সামনে দৃশ্যমান তা ব্যতিরেকে অদৃষ্টের পেছনে ছুটবার কোন যৌক্তিকতা নেই।
সাহাবায়ে কেরাম রাসুলকে (স.) প্রশ্ন করেছিলেন, যদি সবকিছু লিখাই থাকে তবে আমাদের আমল করার যৌক্তিকতা কী? রাসুল (স.) জবাব দিলেন, কী লেখা আছে তা কি তোমরা জান? তাঁরা জবাব দিলেন, জানি না। রাসুল (স.) বললেন, তাহলে নেক আমল করো (অর্থাৎ ঐ পথটি তো দৃশ্যমান)।
একটি উদাহরণ পেশ করছি। মনে করুন, আমি আমার বাসায় আমার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে দাওয়াত করলাম এবং কারা কারা আসবেন তাদের নামের দুটি তালিকা করলাম। আমি দাওয়াতনামায় ঘোষণা দিলাম যে, আগমন-ইচ্ছু ব্যক্তিদের দুটি তালিকা আছে। একটি তালিকা ক আরেকটি তালিকা খ। ক তালিকাটি গোপন এবং এতে কেবল আমার পছন্দসই ব্যক্তিবর্গকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। তবে খ তালিকা সার্বজনীন। যার ইচ্ছা এতে নাম লেখাতে পারেন। তবে নাম লেখানোর দুটি শর্ত রয়েছে। উক্ত শর্তদুটি পূর্ণ করতে পারলে যেকোন ব্যক্তি খ তালিকায় প্রবিষ্ট হবেন।

এখন যে ব্যক্তি মনেপ্রাণে আমার দাওয়াতে আসতে চায় সে চিন্তা করবে, ক তালিকায় আছি কিনা জানি না। সেটি গোপন। তবে খ যেহেতু খোলা আছে সুতরাং আমি খ তালিকায় প্রবিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করি। সে দুটি শর্তই পূর্ণ করল এবং খ তালিকায় প্রবিষ্ট হয়ে দাওয়াতে আসল।
আরেক ব্যক্তি, যে দাওয়াতে আসতে ততটা ইচ্ছুক নয়, সে চিন্তা করবে, হয়তো আমি ক তালিকায় আছি, হয়তো নেই। যদি থাকি তাহলে গেলাম আর না থাকলে বাদ দেই। সে খ তালিকায় প্রবিষ্ট হওয়ার কোনরূপ প্রচেষ্টাই করলনা।
দাওয়াতের দিন আমি আমার তালিকা প্রকাশ করলাম। সবাই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল, যারা খ তালিকার শর্ত পূর্ণ করে এসেছে তাদের নাম ক তালিকায়ও রয়েছে। আর যারা খ তালিকায় প্রবিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেনি (এবং প্রবিষ্ট হতে পারেনি) তাদের নাম ক তালিকায়ও নেই। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এটি কিভাবে সম্ভব? ক তালিকা তো তুমি আগেই করে রেখেছিলে!
আমি জবাব দিলাম, আমি তো জানতাম কারা কারা আমাকে ভালবাসে। কারা কারা আমার দাওয়াতে আসতে অধিকতর উদগ্রীব। সুতরাং আমি আমার পূর্বজ্ঞান থেকেই ক তালিকা করেছিলাম। তবে আমার তালিকা তোমাদেরকে আসতে কিংবা না আসতে বাধিত করেনি। তোমাদের ভাগ্য তোমাদের প্রচেষ্টার দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছে।
সুবাহানাল্লাহ! এ যদি হয় মানুষের পূর্বজ্ঞান, তাহলে খোদ জ্ঞানের স্রষ্টা আল্লাহ আলীমুল হাকিমের জ্ঞান সম্বন্ধে আমাদের কী ধারণা? জ্ঞানবানদের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট।
তাকদির বা পূর্বনির্ধারণ সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থিত হয়, আমার মতে, কর্মের দায়ভার না নেয়ার প্রবণতা থেকে। একটি উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্নে আল্লাহ আদম (আ.) এবং ইবলিসকে দুটি আদেশ দিয়েছিলেন। দুজনই ব্যত্যয় ঘটিয়েছিল। ইবলিসকে বলেছিলেন আদমকে (আ.) সেজদা করার জন্য, সে করেনি। অপরদিকে আদমকে (আ.) বলেছিলেন একটি বৃক্ষ থেকে দূরে থাকতে। তিনি তা পালন করেননি। দুজনকেই শাস্তির মুখামুখি হতে হয়েছিল। তবে কুরআন শরিফের বর্ণনানুযায়ী, ইবলিস তার শাস্তি মেনে নিতে না পেরে যুক্তি প্রদান করেছিল যে, তুমি তো আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলে যে আমি এসব করব, সুতরাং আমার দোষ কী? এবং ইবলিস তার যুক্তিতে ঠিক ছিল, কারণ আল্লাহর পরিকল্পনার অতীত কিছুই ঘটে না। অপরপক্ষে আদম (আ.) নিজের শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছিলেন এবং করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজের দোষ স্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, আল্লাহ, আমরা (তিনি ও হাওয়া) আমাদের আত্মার উপর (তোমার নাফরমানির দ্বারা) যুলুম করেছি।
কথা হচ্ছে, আদম (আ.)ও জানতেন যে এটি ছিল আল্লাহর পরিকল্পনার অধিন। তবে তিনি এটিও জানতেন যে, তাঁকে পূর্বেই হেদায়াত দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তোমরা উক্ত বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়োনা। তবুও তাঁরা হয়েছেন এবং ফল ভক্ষণ করেছেন। এজন্য তিনি স্বীয় কর্মের দায়ভার নিজ কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন। সুবাহানাল্লাহ! জ্ঞানীদের জন্য ইঙ্গিতই যথেষ্ট।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে যাদের কাছে তাকদির সম্পর্কিত ধারণা পরিষ্কার হয়ে গেছে তাঁরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে, তাকদির সংক্রান্ত সন্দেহ ও কানাঘুষা অর্থই হচ্ছে দায়ভার চাপানোর পায়তারা। নির্ধারিত তাকদিরে যেমন আমাদেরকে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে, তেমনি এটিও ভুলে গেলে চলবেনা যে, আমাদেরকে কিন্তু ভাল-মন্দ বলে দেয়া হয়েছে এবং বাছাই করার সক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। সুতরাং বুঝতে হবে যে, নির্ধারিত তাকদির সম্বন্ধে নয়, বরং স্বাধীন ইচ্ছায় বেছে নেয়া জীবন ও কর্ম সম্বন্ধেই আমরা জিজ্ঞেসিত হবো। আমাদেরকে আমাদের পিতা আদমের (আ.) নিকট থেকে তাকদিরের পাঠ নিতে হবে। আমাদের শত্রু ইবলিসের নিকট থেকে নয়। কারণ তার জীবনদর্শনই হচ্ছে আদম সন্তানকে পথভ্রষ্ট করা। তাকদির সংক্রান্ত বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে- ১. আল্লাহর পূর্বাপর জ্ঞানে বিশ্বাস করা। ২. আল্লাহর লিখনে বিশ্বাস করা। ৩. আল্লাহর ইচ্ছা ও সে ইচ্ছাকে কার্যে পর্যবসিত করার অসীম ক্ষমতায় বিশ্বাস করা। ৪. আমাদের কাজের স্রষ্টা হলেন আল্লাহ এবং কর্তা হচ্ছি আমরা- এ তত্ত্বে বিশ্বাস করা। ৫. মানুষের বিবেক, স্বাধীন ইচ্ছা ও বাছাই-সক্ষমতায় বিশ্বাস করা।

Comments

comments

About

Check Also

আল্লামা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল

ঊনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে যে কয়জন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ এ ভারত উপমহাদেশে কাব্য ও …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *