খোদাভীতির উজ্জ্বল নমুনা

(পূর্ব প্রকাশের পর)
৪৮. আবু তালিব মক্কী (রহ.) ‘কুওয়াতুল কুলুব’ কিতাবে ২৫তম অধ্যায়ের শুরুতে তার কোন এক বন্ধুর ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে-‘আমাদের কাছে একজন ফকির এলো। আমি আমার এক প্রতিবেশির নিকট থেকে বকরীর ভূনা বাচ্ছা ক্রয় করে সে ফকিরসহ খেতে বসলাম। আমাদের খাওয়া-দাওয়া আরম্ভ হল। আমার সাথের ফকির লোক সে গোশত থেকে এক টুকরা মুখে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে বমি করে দিয়ে বলতে লাগলো আপনারা খান, আমি খাব না। কারণ এতে আমার সন্দেহ আছে। সে জন্য আমি খাব না। আমি বললাম, তুমি না খেলে আমিও খাব না। সে বলল, আমি খাবই না, এ কথা বলে চলে গেল। শেষ মেষ আমিও খেলাম এবং পরস্পর কথাবার্তা বলতে লাগলাম যে লোকটি কেন তা খায়নি? পরামর্শ হল যে প্রতিবেশির কাছ থেকে এটি ক্রয় করা হয়েছে তার কাছে জিজ্ঞেস করে দেখি। হয়তো কোন কথা জানতে পারা যাবে। যেহেতু আমার বিশ্বাস ছিল এতে কোন একটি ব্যাপার ছিল, যে কারণে সে লোকটি তা খায়নি। আমি যে পড়শীর কাছে জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কিসের গোশত ছিল? পড়শী কোন উত্তর দিচ্ছিল না। আমরা ভালোভাবে জিজ্ঞেস করতে থাকলে বেশ কিছুক্ষণ পর সে বলল, এটা ছিল মৃত বকরীর বাচ্ছা। আমি টাকার লোভে তা ভূনা করে আপনার কাছে বিক্রি করেছি।’
বর্ণনাকারী বলেন, ‘আমি জানতে পেরে সে ভূনাকৃত গোশত কুকুরকে দিয়ে দিলাম। তারপর সে ফকির (বুজুর্গ) লোকটির খোঁজে বের হলাম। তাকে পেয়ে জানতে চাইলাম জনাব, কি কারণে আপনি এ গোশত খেলেন না? তিনি বললেন, প্রায় বিশ বৎসর থেকে গোশতের প্রতি আমার মোটেও আগ্রহ হয় না। অর্থাৎ বিশ বছরের মাঝে আমি অতি অল্প পরিমাণে গোশত খেয়েছি। অথচ অধিকাংশ সময় আমার সম্মুখে গোশত থাকত কিন্তু খেতে আমার মন চাইত না। তবে আজ ভূনা করা গোশত আমার সামনে রাখার পর আমার মনে সীমাহীন আগ্রহ জন্মাল। অথচ গোশতের প্রতি এত আগ্রহ ইতোপূর্বে আমার আর হয়নি। এ জন্য দ্রুত আমার মনে আসল যে, হতে পারে এই গোশতে কোন ত্র“টি আছে। এ কারণে আমি তা খেতে অস্বীকৃতি জানালাম।’ (হায়াতুল হায়ওয়ান)
৪৯. মসনভী শরীফে আল্লামা রূমী (রহ.) চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাদ্বি.)-এর তাকওয়া বা খোদাভীতির একটি ঘটনা উল্লেখ করেন এভাবে-কোন এক যুদ্ধে হযরত আলী (রাদ্বি.) শত্র“কে কাবু করে তার বুকে চড়ে বসলেন। শত্র“টি বাঁচার কোন উপায় না পেয়ে ঘৃণার নিদর্শন স্বরূপ হযরত আলী (রাদ্বি.)-এর চেহারার মধ্যে থুথু নিক্ষেপ করল। এতে হযরত আলীর রাগ চরম আকার ধারণ করে সমস্ত চেহারা লাল হয়ে গেল। কিন্তু শত্র“কে কোনো প্রকার শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিলেন। শেরে খোদা হযরত আলীর এমন অস্বাভাবিক উদারতা দেখে শত্র“ ব্যক্তি যারপর নাই বিস্মিত হল এবং জিজ্ঞাসা করল; হে আলী, আপনি এত সুযোগ পাওয়ার পরও এবং শত্র“ কর্তৃক থুথু দ্বারা অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে কোনো প্রকার শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিলেন কেন? দয়া করে রহস্যটা আমাকে বলুন। উত্তরে হযরত আলী (রাদ্বি.) বললেন, আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি এর একমাত্র কারণ হল খোদাভীতি।
জেনে রাখো, আমি তোমাকে প্রথমে হত্যা করতে উদ্যত ছিলাম; তুমি ইসলামের শত্র“ বলেই। আর যখন তুমি আমার চেহারায় থুথু নিক্ষেপ করেছো তখন আমার মনে যে চরম রাগের সৃষ্টি হয়েছিল তা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত অপমানের কারণে। আর সেই অবস্থায় যদি আমি তোমাকে হত্যা করি এমতাবস্থায় আল্লাহ পাক কিয়ামতের ময়দানে জিজ্ঞাসা করবেন আলী! তুমি ঐদিন তোমাকে থুথু নিক্ষেপ করার কারণে অমুক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে, তখন আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে লজ্জিত হবো এই ভয়ে আমি তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি। হযরত আলীর মুখে ইসলামের সুন্দর আদর্শ ও খোদাভীতির কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে উক্ত লোক পড়ে নিল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। (দরসে কুরআনে করীম)

৫০. হযরত আনাস (রাদ্বি.) বলেন, ‘একবার আমি এক বাগানে গেলাম। দেয়ালের এ প্রান্ত থেকেই ওপ্রান্তে অবস্থানরত হযরত ওমর (রাদ্বি.)’র আওয়াজ শুনেত পেলাম। তিনি বলেছেন, ‘হে ওমর! কোথায় তুমি, কোথায় আমিরুল মু’মিনীনের মর্যাদা ও সম্মান। আল্লাহকে ভয় কর, অন্যথায় তিনি শাস্তি দিবেন।’ (তারীখুল খুলাফা)
৫১. হযরত সালেম বিন আব্দুল্লাহ বলেন, একদিন হযরত ওমর উটের পেটের নিন্মদেশে সৃষ্ট ক্ষতস্থান পরিস্কার করতে করতে বললেন, ‘আমার ভীষণ ভয় করছে; আল্লাহ তায়ালা যদি কিয়ামত দিবসে উটের পরিচর্যার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন।’ (তারীখুল খুলাফা)
৫২. হযরত ওমর ফারুক (রাদ্বি.) (তাঁর খিলাফতের সময়) রাতের আঁধারে মদীনা শরীফের অলিগলি চষে ফিরতেন। এক রাতে তিনি এক মহিলাকে দরজা বন্ধ করে এ কবিতা আবৃত্তি করতে শুনেন-‘রাত প্রলম্বিত হয়েছে। তারকারাজী বাসর সাজিয়েছে। আমাকে জাগ্রত রেখেছে। আমার সাথে কেউ নেই যার সাথে আমি শুয়ে যাব। এ তীব্র বাসনা! আল্লাহর কসম! শাস্তির ভয় না থাকলে পশুর মতো আচরণ ও বিচরণ করতাম। কিন্তু আমি আল্লাহর পর্যবেক্ষণকে ভয় পাচ্ছি, যার ফেরেশতাদ্বয় (কিয়ামান কাতিবীন) কোনো সময় গাফেল নন।’
পরদিনই হযরত ওমর (রাদ্বি.) রণাঙ্গনগুলোতে সিপাহসালারদের এই মর্মে চিঠি লিখলেন যে, কোনো পুরুষ সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে চার মাসের বেশি থাকতে পারবে না। (তারীখুল খুলাফা)।

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *