চেয়ে আছি মাদীনার পানে কবে হবে যিয়ারতে মাদীনা

যিয়ারতে মাদীনা। মাদীনার যিয়ারত। যিয়ারত অর্থ সফর পরিদর্শন সাক্ষাত। অতএব যিয়ারত যদি হয় মাদীনা মুনাওয়ারার, রওজা মুতাহহারার- তাহলে সেই যিয়ারত এতই মূল্যবান ও পবিত্র, যা প্রতিটি মুমীন হৃদয়ের কাক্সিক্ষত স্বপ্ন। যিয়ারতে মাদীনার স্বপ্ন দেখতে দেখতে কারো জীবন শেষ হয়ে যায়, কারো জীবন পূর্ণ হয় মাদীনার যিয়ারত হতে হতে। যিয়ারতের তামান্না যার পূর্ণ হয় আর যায় হয় না, সবারই বিশ^াস- এ যিয়ারত নসীব হলে ভাগ্যের তারকারা আরো জ¦লে উঠবে, দিবা-নিশির সব কিছু প্রাণবন্ত হবে। খাঁচার পাখির মুখে ‘ইয়া নাবী… ইয়া রাসুল… ইয়া হাবীব…’ জপ বেড়ে যাবে। তাওহীদের সাথে রেসালাতের অমীয় যে কালিমা, বারবার প্রতিধ্বনিত হবে। তবে এটারও সুযোগ আছে, প্রেমের সাগরে ডুব দেওয়ার জন্য, প্রেমাষ্পদের দর্শনে অধীর হওয়ার জন্য, যিয়ারতটাই আবশ্যক নয়। নইলে এ পৃথিবী ক্লান্ত হয়ে যেতো কপালপোড়াদের তালিকা করতে করতে। তাহলে শর্তটা কি? শর্তটা কঠিন কোন কিছু না বরং কমন একটি নাম, ঈমান বা বিশ^াস… এই ঈমানের মিজানে যারা স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারবে, তারাই সফল। তাই যারা যিয়ারতে মাদীনায় রওনা হোন, তাদের জন্য বিশেষ একটা প্রাপ্তি এই যে, বিশ^াসে মজবুতী আসে। প্রেমে জোয়ার আসে। স্বপ্ন আরো জেগে ওঠে। তবু, নসীব কার কার হবে, রব্বে কারীম কাকে কাকে কবুল করবেন, আল্লাহর রাসুলের নজরে করম কার ভাগ্যে নসীব হবে- বলা যায় না। তাই তো বঞ্চিত হতে যাওয়া হৃদয়েও তামান্নাগুলো জেগে জেগে ওঠে। তাই চলুন, যিয়ারতে মাদীনা সম্পর্কে কিছু জেনে রাখার চেষ্টা করি…
আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৬৪নং আয়াতে ইরশাদ করছেন, “আর যখন তারা স্বীয় আত্মার উপর জুলুম করেছিলো, তখন যদি আপনার কাছে আসতো অত:পর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং রসুলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও মেহেরবান রূপে পেতো।”
সুুবহানাল্লাহ! এই আয়াতে কারীমার অন্যতম নির্দেশনা এই যে, যারা অপরাধ করেছে, তারা যদি নবীজী পাকের কাছে আসার পর ক্ষমাপ্রার্থনা করতো, সেই সাথে তিনিও তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন, তাহলে আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দিতেন। তাহলে আমাদের মতো গুনাহগার উম্মাতদের কতবার হাজিরা দিতে হবে নবী পাকের দরবারে- কোন ইয়ত্তা আছে!
এখন যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, আয়াতটা তো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবিতাবস্থায় প্রযোজ্য; এখন নয়। কিন্তু কোন নবীপ্রেমিক এটা মানতে পারে না। ব্যক্তির সঠিক আকলেও এটা ধর্তব্য হয় না। কারণ, সহজ যুক্তি তো এই যে, নবীজীর শান শুধু জীবদ্দশায় নয়, হতেই পারে না। বরং তাঁর শান ছিলো সৃষ্টির পূর্ব থেকেই, থাকবে অনন্তকাল। তাহলে কিভাবে নবীজীর জিসমী মৃত্যুর পর তাঁর শানের ব্যত্যয় ঘটতে পারে? তাছাড়া নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো হায়াতুন্নবী বা জিন্দা নবী। তিনি কবর শরীফে শুয়ে শুয়ে তামাম উম্মাতের খবর নিতে পারেন, হাল হাকীকত জানতে পারেন।
বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া সম্ভব যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর কেউ এসেছে রওজা পাকে, অত:পর যিয়ারত করেছে, তাঁর উছিলা দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে এবং ক্ষমাপ্রাপ্তির বুকভরা আশা নিয়ে রওজা থেকে ফিরে এসেছে। পরবর্তীতে সে ক্ষমার সুসংবাদও পেয়েছে। অথবা যিয়ারত করতে এসেছে আর নবীজী স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন।
বেশি দূর যেতে হবে না, হাতের কাছেই-উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে কাছীরের তাফসীর পড়ে দেখুন, জ¦লন্ত উদাহরণখানা কালির পাতায় জ¦লজ¦ল করছে। ঘটনাটি তুলে ধরা হলো, ঘটনার সাক্ষি আল্লামা উতবী র. বর্ণনা করেন, একবার আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা শরীফের কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে বলতে লাগলো, ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ বলেছেন, ‘আর যখন তারা স্বীয় আত্মার উপর জুলুম করেছিলো, তখন যদি আপনার কাছে আসতো অত:পর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতো এবং রসুলও যদি তাদেরকে ক্ষমা করিয়ে দিতেন, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও মেহেরবান রূপে পেতো।’ আজ আমি আপনার সুপারিশের অসীলা দিয়ে আল্লাহর নিকট হতে ক্ষমা লাভের জন্য এসেছি। এ পর্যন্ত বলে সে নি¤েœাক্ত কবিতাটি পাঠ করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। (কবিতাটির অনুবাদ দেওয়া হলো)-‘যাদের অস্তীসমূহ প্রান্তরে পতিত হয়েছে, আর সে অস্তী সমূহের সৌভাগ্যে নি¤œভূমি ও উচ্চভূমি সবই সুরভিত হয়েছে। তুমি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। হে শ্রেষ্ঠতম, যে কবরে তুমি শায়িত রয়েছো, আমার প্রাণ তাঁর জন্য উৎসর্গ হোক। যাতে পবিত্রতা, দানশীলতা ও মহানুভবতা রয়েছে। তুমি হচ্ছো সুপারিশকারী। পুলসিরাতে আমরা তোমার সুপারিশ কামনা করি। যখন পদস্খলন হবে, আর তোমার সাথীদ্বয় যারা তোমাকে ভুলে নি, এ জগত যতদিন আছে ততদিন আমার পক্ষ থেকে তোমায় সালাম।’

এরপর আল্লামা উতবী র. বলেন, কিছুক্ষণ পর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে দেখলাম, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে লক্ষ্য করে বলছেন, হে উতবী! তুমি ঐ গ্রাম্য লোকটির সাথে দেখা করো বা মিলিত হও, অত:পর তুমি তাকে এই সুসংবাদ পৌঁছিয়ে দাও যে, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
এরপর আমরা হাদীসের কিতাবে চোখ বুলাই। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারত করবে, তার জন্য আমার শাফাআত ওয়াজিব হয়ে যাবে অথবা শাফাআত হালাল বা শুদ্ধ হয়ে যাবে।’ এভাবে একটি দুটি নয়; অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান নবীজীর রওজা মুবারক যিয়ারত করার ব্যাপারে।
কত স্পষ্ট আয়াতে কারীমা! কত স্পষ্ট হাদীসে মুস্তফা! তারপরো ইসলামের শত্রু যারা, তাদের কাজই হলো অন্যদের খোচা মারা। তাদের পক্ষে যে দলীল যায়, শুধু সেটাই তারা দেখে, অন্যগুলো দেখবে না বা সমন্বয় করবে না। সত্য হলো, এ সমস্ত মানুষগুলো ইলমে নববীর জ্ঞান আহরণ করে না এবং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর সাহাবাগণ কিভাবে হাদীসের সমন্বয় করতেন, আয়াত থেকে কিভাবে বিধান ইস্তিম্বাত করতেন কিংবা ফিকহী মাসআলা উদ্ধার করতেন- এটা ইলমের বিরাট একটা জগত। এ জগত থেকে তারা দূরে বিক্ষিপ্ত হতভাগার মতো, এরা কপালপোড়াদের মতো বঞ্চিত হক্কানী মাশায়েখ উলামাদের সোহবতে দরস গ্রহণ করা থেকে। যাইহোক, উপরোক্ত যিয়ারতে মাদীনার বিরোধিতা করে এভাবে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিনটি মসজিদ ব্যতীত সফর করা জায়েজ নেই। তাহলো, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা।’
কিন্তু এটির সাথে রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবর যিয়ারতকে মিলালে হবে না। কারণ এটি ভিন্ন বিষয়। কারণ কবর যিয়ারতের অনুমতির ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত আছে। আবার যদি এটাও বলা হয় যে, রওজা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর নিষিদ্ধ। মূলত: তা নয়। বরং ঐ হাদীস দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মসজিদের সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে সফর করার ব্যাপারে। আর সাধারণ ভাবে সফর নিষেধ নয়। তা না হলে সকল ধরণের সফরই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এ ব্যাখ্যাটি পাবেন বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ উমদাতুল ক্বারী কিতাবের ৩/৬৮২ পৃষ্ঠায়। কিন্তু নবীজী উপরে পূর্বে উল্লেখিত হাদীসে বলেই দিয়েছেন, যে আমার রওজা যিয়ারত করবে, তার জন্য শাফাআত জরুরী হয়ে যাবে। আবার কবর যিয়ারতের অনুমতি বহাল থাকার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখনিঃসৃত হাদীসও রয়েছে। কবর যিয়ারত যদি করা যায় এবং নবীর রওজা শরীফ অথবা কোন মুসলমানের কবর দূরে হয়, তাহলে যেতে যেতে পারিভাষিক সফরের পর্যায়ে পড়ে গেলে তাতে কিছু করার থাকবে না। কারণ, কবর যিয়ারত নিষেধ নয়।
যাইহোক, এব্যাপারে দলীলসমেত আরো দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। যাদের বিশ^াস কম, তারা অবশ্যই উলামার সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিবেন। আল্লাহ পাক হেফাজত করুন।
পরিশেষে, যিয়ারতে মাদীনা আমাদের সকলেরই হৃদয়ের তামান্না। আমরা সবসময় উদগ্রীব থাকি, মাওলা কখন কবুল করবেন হতভাগাদের, রাসুল রহমাতুল্লিল আলামীন কবে আমাদের মেজবান হবেন? আর আমরা তো এটাই বিশ^াস করি যে,

“এই জীবনের পূর্ণতা তোমারি প্রাপ্তিতে;
হে কামলিওয়ালা…”

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *