ঘুষ ও দুর্নীতি : দেশের উন্নতির পথে বড় অন্তরায়

ঘুষ ও দুর্নীতি যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশের দুর্নীতির আওতা ও পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, একে কয়েক লাইনের একটি প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ঘুষ ও দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ কোন কাজ! দুর্নীতি বলতে সাধারণ অর্থে আমরা বুঝি; স্বাভাবিক নিয়ম নীতির গতি ধারাকে লঙ্ঘন করে কোন কাজ করা যা কোন ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয়স্বার্থ চরিতার্থ করা। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি এক ভয়াবহ অভিশাপ। বার্লিন ভিত্তিক দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা “অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল” পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা “’ট্রান্সপারেনসি ইন্টারন্যাশনাল” পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের অন্যতম একটি দেশ বলে চিহ্নিত করেছে। ২৯ জানুয়ারী ২০১৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০০ এর মধ্যে ২৬ স্কোর পেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯ তম!! এর আগের বছরও অর্থ্যাৎ, ২০১৮ সালে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশে ১৮০ টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম ছিল। অথচ ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৩ তম। টি আই (ঞও) এর ২০১৯ সালের জরিপে দেখা যায়, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩ তম! অথচ ২০১৭ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭ তম। উল্লেখ্য (ঞও) টিআই’র দুর্নীতির ধারণা সূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছিল তালিকার এক নম্বরে! বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘুষ দুর্নীতি এক ভয়াবহ অভিশাপ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো দুর্নীতি মুক্ত হওয়া। বর্তমান বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে বইছে দুর্নীতির কালো অধ্যায়, সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কালো থাবার প্রভাবে আচ্ছন্ন প্রতিটি নাগরিকের জীবন। সর্বনাশা এই ব্যাধি দেশকে আজ হুমকির সম্মুখীন করেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ নীতি, শিল্প বাণিজ্য, ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রেই চলছে দুর্নীতির তাণ্ডব লীলা।


দৈনিক সমকাল পত্রিকার ২৬ মার্চ ২০১৮ সালের রিপোর্টে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন: দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে দুর্নীতিই আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান বাধা। দুর্নীতি যে কোনো দেশেরই উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক সাম্য ও গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দুর্নীতি রয়েছে। এই দুর্নীতির ব্যাপকতা, প্রকৃতি, মাত্রা, ক্ষেত্র এবং কৌশল ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘুষ দুর্নীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (ঞওই) ২০১৭ সালে সরকারের ১৫টি সেবাখাতে ঘুষ দুর্নীতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় সেবাখাতে ২০১৭ সালে মোট ঘুষের পরিমান ১০ হাজার ৬৮৮.৯ কোটি টাকা। এটা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৩.৪ ভাগ এবং জিডিপির ০.৫ ভাগ। ২০১৫ সালের বছরের তুলনায় এটা ২১.২ ভাগ বেড়েছে। সাধারণ মানুষ কেন ঘুষ দেয়? এর জবাবে ঞওই এর নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম “ডয়চে ভেলেকে” বলেন, ‘গবেষণায় যে ৬৯ শতাংশ মানুষ কোনো না কেনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন তাদের ৮৯ শতাংশ বলেছেন তারা ঘুষ দিতে বাধ্য। কারণ তারা যদি ঘুষ না দেন তাহলে সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (ঞওই) এর নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে (উবঁঃংপযব ডবষষব) এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশের দুর্নীতির সম্ভাব্য কারণগুলোও তুলে ধরেন অন্যতম কারণগুলো হলো :
(ক) দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার এবং এর বাস্তবায়নের মিল না থাকা।
(খ) হাইপ্রোফাইলদের (রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের) দুর্নীতি চিহ্নিত না করা!
(গ) সরকার ও রাজনৈতিক দল সহ উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারা
(ঘ) আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি পাওয়া।
(ঙ) ভূমি-নদী-খালবিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না কমা।
(চ) অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া।
(ছ) দুর্বল জবাবদিহিতা।
(জ) দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব।
(ঝ) দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন। অর্থাৎ দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধে সবার জন্য আইন সমান, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া
(ঞ) গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করা ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ‘‘দুর্নীতির জন্য ৯০ ভাগ দায়ী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁদের নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, রাতারাতি ধনী হওয়ার আকাঙ্খাই দুর্নীতির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর ফরাস উদ্দিন বলেন, দুর্নীতি থেকে উত্তরণের একটি সুচিন্তিত পথ হলো, দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকিয়ে আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ, সকল সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিকদের সদিচ্ছা ছাড়া কখনো দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না ।
একটি দুর্নীতিমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়া ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। কিন্তু আজ দেশের অবস্থা এতোই নাজুক; দুর্নীতি যেন সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান। ১৯৭১ সালের ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আমরা অর্জন করেছি তাকে দুর্নীতির হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। শুধুমাত্র সরকার বা রাজনৈতিক দলের নয়, সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদেরকেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আজ যে দুর্নীতি দাপটের সাথে সমাজে বিরাজ করছে তাকে সমূলে উৎখাত করতে হবে আমাদের। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মত দুর্নীতির বিরুদ্ধে আজ থেকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে, তবেই আমরা ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।

তথ্যসূত্র:
১: যুগান্তর ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯
২: https://www.dw.com.29thjanuary2019.
৩: সমকাল ২৬ মার্চ ২০১৮।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *