খোদাভীতির উজ্জ্বল নমুনা

(পূর্ব প্রকাশের পর)
৩৮. আল্লামা কাযরুনী বাকরী রহ. বলেন, হজরত সায়্যিদ আহমদ রেফায়ী কবীর রহ. একদিন পায়ে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিলেন। সালেকীনদের বিরাট জামাত তাঁর সাথে ছিলেন। এমতাবস্থায় এক ইয়াহুদী আলিমদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, আজ আমি এ লোকটিকে (সায়্যিদ আহমদ রেফায়ীকে) পরীক্ষা করব। যদি তাঁর মধ্যে আমিত্বভাব পরিলক্ষিত হয় তবে তো তাঁর সাথে কোনো কথাই নেই। অন্যথায় (আমিত্বভাব না পেলে) আমি ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর মুরীদ হয়ে যাবো। অতঃপর যখন হজরত সায়্যিদ আহমদ রেফায়ী কবীর রহ. ইয়াহুদীর নিকট পৌঁছলেন, তখন ইয়াহুদী তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল-ইয়া সায়্যিদী! আ-আন্তা আফদ্বালু আম্ হাজাল্ কাল্বু? অর্থাৎ হে মাননীয়, আপনি উত্তম না এ কুকুরটি উত্তম? হজরত সায়্যিদ আহমদ রেফায়ী রহ. ছিলেন ধৈর্য্যরে পাহাড়। তিনি কিছুমাত্র নারাজ হলেন না বরং অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন, ইয়া আখাল্ ইয়াহুদী। ইন, আবারতুস সিরাত্বা সালিমান ফাআনা আফদ্বালু মিনহু, ওয়াইল্লা ফালা। অর্থাৎ ‘হে ইয়াহুদী ভাই, যদি আমি নিরাপদে পুলসিরাত পার হতে পারি তবে তো আমি উত্তম, অন্যথায় নয়। ’ উত্তর শুনে ইয়াহুদীর অন্তর কেঁপে উঠল এবং ক্রন্দন শুরু করে দিল এবং পরিবার পরিজনসহ ইসলাম গ্রহণ করে হজরত সায়্যিদ আহমদ রেফায়ী (রহ)’র মুরীদ তথা সালেকীনদের অন্তর্ভুক্ত হলো। (হায়াতে রেফায়ী রহ.)

৩৯. একদিন হজরত হাসান বসরী রহ. এক মৃত ব্যক্তির জানাযার নামাজে উপস্থিত হয়ে নামাজ শেষে মৃত দেহ দাফন করলেন, অতঃপর উক্ত মৃত ব্যক্তির কবরের পাশে বসে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর চোখের পানিতে কবরের মাটি একেবারে ভিজে কাদাময় হয়ে গেল। হজরত হাসান বসরী রহ. তখন উপস্থিত সকলকে সম্বোধন করে বললেন, ‘ভাই সব! এ কবরই দুনিয়ার শেষ ঘর এবং পরকালের প্রথম ঘর বলে মনে করিও। এ অস্থায়ী দুনিয়ায় কেন তোমরা আমোদ-প্রমোদ-আহলাদে মত্ত্ব থাক এবং আপন মাবুদের ভয়ে বিচলিত হচ্ছ না?’ (তাজকিরাতুল আওলিয়া)

৪০. একবার হজরত হাসান বসরী রহ. কোন এক মসজিদের ছাদের উপর বসে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিতে বুক ভিজিয়ে ফেললেন। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, হুজুর! এ পানি পবিত্র কি অপবিত্র? হজরত হাসান বসরী রহ. বললেন, ‘এ পানি অপবিত্র, ধুয়ে ফেলুন, কারণ এটা পাপীর চোখের পানি। ’ (তাজকিরাতুল আওলিয়া)

৪১. সূরা আরাফের ২০১নং আয়াতের তাফসীরে আল্লামা হাফিজ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাসীর রহ. লিখেন, বর্ণিত আছে যে, একজন যুবক মসজিদে বসে ইবাদত করতো। একটি মহিলা যুবকটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তাকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে মহিলা একদিন যুবকের বাড়িতে এসেই পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে যুবকটির মনে পবিত্র কুরআনের (ইন্নাল লাজিনাত তাক্বাও ইজা মাসসাহুম ত্বা-ইফাতুম মিনাশ শাইত্বানি তাজাক্কারু ফাইজাহুম মুসসিরুন) অর্থ: যাদের মনে ভয় রয়েছে, তাদের উপর শয়তানের আগমন ঘটায় সঙ্গে সঙ্গে তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং এখনই তাদের বিবেচনাশক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে।
এ আয়াতটির কথা স্বরণ হয়ে যায় এবং তৎক্ষণাৎ সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে আবার সে এ আয়াতটি পাঠ করে এবং এবার সে মারাই যায়। হজরত ওমর (রাদ্বি) এসে তার পিতার নিকট সমবেদনা প্রকাশ করলেন। রাত্রিকালে তাকে দাফন করা হয়। হজরত ওমর (রাদ্বি.) তাঁর কয়েকজন সাথীকে নিয়ে যুবকের কবরের কাছে গমন করেন এবং তার জানাজার নামাজ আদায় করেন। হজরত ওমর তাকে সম্বোধন করে বললেন-হে যুবক! ওয়ালিমান খা-ফা মাক্কামা রাব্বিহী জান্নাতান। (অর্থ- যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করল তার জন্য দুটি জান্নাত রয়েছে) এ আয়াতটি শুনে যুবকটি কবরের মধ্য থেকেই উত্তর দিলো এভাবে-হে ওমর! মহামহিমান্বিত আল্লাহ তায়ালা আমাকে দুটি জান্নাতই দান করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর)

৪২. হজরত মালিক বিন দিনার রহ. হজ্জ করার জন্য বসরা নগরী থেকে পায়ে হাঁটা শুরু করলে কেউ আরজ করল যে, আপনি সাওয়ারি বা বাহনে চড়ে কেন হজ্জে যান না? উত্তরে বললেন, পলাতক গোলাম মনিবের দরবারে ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য কি সাওয়ারি নিয়ে যায়? আল্লাহ তায়ালার শপথ! যদি আমি মক্কা শরীফে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হেঁচড়ে হেঁচড়ে যাই তাও আদবের খেলাফ হবে। এটাই মালিক বিন দিনারের খোদাভীতির নমুনা। (আখলাকুস সালিহীন)

৪৩. হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাদ্বি)-কে প্রশ্ন করা হলো, ভয়কারী কারা? তিনি বলেন, যাদের অন্তর ভয়ের কারণে পুড়ে গেছে এবং যাদের চক্ষু ক্রন্দনরত থাকে। তিনি আরো বললেন যে, যখন মৃত্যু আমাদের পিছনে ছুটছে, কবর আমাদের আগে আগে, কিয়ামত আমাদের জন্য অপেক্ষমান, জাহান্নাম আমাদের রাস্তা এবং মহান রাব্বুল ইজ্জতের সামনে দণ্ডায়মান হতে হবে, তখন আমরা কিভাবে আনন্দ-খুশি করতে পারি? (আখলাকুস সালেহীন)
(আগের পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *